Advertisement
০৩ মে ২০২৪

আশার আলো কি সত্যিই আছে

মৃদুলা রমেশও সংখ্যাগরিষ্ঠের মত গ্রহণ করেছেন। বইয়ের বিষয়, জলবায়ু সঙ্কটের সম্যক তাৎপর্য বোঝানো এবং এই পরিস্থিতিতে ভারতবাসী কী করতে পারে তার রূপরেখা নির্দেশ।

অনিবার্য: রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সম্মেলনের প্রাক্কালে প্রদর্শিত আর্ট ইনস্টলেশন ‘দ্য পাল্‌স অব দি আর্থ’। কোপেনহাগেন, ২০০৯

অনিবার্য: রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সম্মেলনের প্রাক্কালে প্রদর্শিত আর্ট ইনস্টলেশন ‘দ্য পাল্‌স অব দি আর্থ’। কোপেনহাগেন, ২০০৯

শান্তনু চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৯ ০৭:৪০
Share: Save:

সংখ্যাগরিষ্ঠতা অভ্রান্ততার গ্যারান্টি নয়। বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্রেও। তবে বিশেষজ্ঞরা একমত না হলে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি হলে, সাধারণ ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতই গ্রাহ্য হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রবল হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও সহজ হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা ও নিদান সংক্রান্ত প্রশ্নের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বিষয়জ্ঞ বিজ্ঞানীদের অধিকাংশ বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে এবং ঘটছে অতিরিক্ত গ্রিনহাউজ় গ্যাস নিঃসরণের জন্য। উল্টো মতের বিশেষজ্ঞের সংখ্যা অনেক কম।

মৃদুলা রমেশও সংখ্যাগরিষ্ঠের মত গ্রহণ করেছেন। বইয়ের বিষয়, জলবায়ু সঙ্কটের সম্যক তাৎপর্য বোঝানো এবং এই পরিস্থিতিতে ভারতবাসী কী করতে পারে তার রূপরেখা নির্দেশ। বিষয়টি সম্পর্কে সকলেরই কিছুটা জানা দরকার। কিন্তু মৃদুলা সে দায়িত্ব নেননি। তাঁর লক্ষ প্রধানত উচ্চশিক্ষিত পাঠককুল, যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নীতি বা জনমত প্রভাবিত করতে পারবেন। চমৎকার লেখেন মৃদুলা! তথ্যে ভরপুর, পরিসংখ্যানে ঠাসা রচনা ক্লান্তিকর হওয়া দূরস্থান, প্রায় থ্রিলারের মতোই জমাটি।

গোড়ায় জলবায়ু সঙ্কটের বিজ্ঞানের সংক্ষিপ্ত আলোচনা। এর পরে, সঙ্কটের মোকাবিলার পথে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বাধার আলোচনা। জলবায়ু সঙ্কটে সব দেশ একই রকম ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারও কিছু লাভও হতে পারে। তাই, সবার গরজ এক রকম নয়। তা ছাড়া, জলবায়ু সঙ্কট সামলাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বিশেষ কয়েকটি অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থে ঘা দেবে— যেমন কিনা পেট্রোলিয়াম গোষ্ঠী। জানা গল্প। কিন্তু, বলার গুণে একঘেয়ে হয়নি।

দ্য ক্লাইমেট সলিউশন: ইন্ডিয়াজ় ক্লাইমেট চেঞ্জ ক্রাইসিস অ্যান্ড হোয়াট উই ক্যান ডু অ্যাবাউট ইট
মৃদুলা রমেশ
৫৫০.০০, অ্যাশে ইন্ডিয়া

পদক্ষেপ করার পথে নানান বাধা: সঙ্কীর্ণ স্বার্থের, অজ্ঞতার, অভ্যাসের, মানসিকতার। তাই, সঙ্কট ঠেকানো যায়নি। তাপমাত্রা বেড়েছে। আরও বাড়বে। ভাগ্য নেহাত ভাল হলে বৃদ্ধি লাগামছাড়া হবে না। ফলে, এখন প্রশ্ন শুধু গ্রিনহাউজ় গ্যাস নিঃসরণ কমানোর বা কার্বন শুষে নেওয়ার নয়। সে সব তো আছেই। প্রশ্ন হল, পরিবর্তনশীল জলবায়ুর ঠেলা সামলানো যাবে কী ভাবে?

বইটির জোরের জায়গা হল, ভারতের ক্ষেত্রে পরিবর্তনশীল জলবায়ুর অভিঘাতের নানান দিকের শিক্ষণীয় আলোচনা। লেখিকা দেখিয়েছেন যে জলবায়ু সঙ্কট ব্যতিরেকেও ভারতে পরিবেশের বহু গুরুতর সমস্যা আছে। আছে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির নানান অমঙ্গলের দিক— কঠিন দারিদ্র, ব্যাপক দুর্নীতি প্রভৃতি। কিন্তু, বহু ক্ষেত্রেই, হয় জলবায়ু সঙ্কট বিদ্যমান সমস্যাকে বাড়াচ্ছে কিংবা বিদ্যমান সমস্যা পরিবর্তনশীল জলবায়ু-জনিত বিপত্তি মোকাবিলার পথে বাধা হচ্ছে। অনেক উদাহরণ আছে। একটি সবার চেনা। শহরে এবং শহরপ্রান্তে নীচু জমি ও জলাজমি বুজিয়ে প্রোমোটারির ফলে জল নিষ্কাশনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। আর তার উপর চড়াও হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বেমক্কা অতিবৃষ্টি। শহর ডুবছে। আর রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মচারী, প্রোমোটার চক্রের আঁতাত পদক্ষেপ করার পথে বাধা হচ্ছে। এ জাতীয় নানান অবিমৃষ্যকারিতার প্রতিফলের উদাহরণস্বরূপ সাম্প্রতিক বানভাসি কেরলের কথা পাঠকের মনে পড়বে।

পঞ্জাব ধান চাষের জায়গা নয়। তবু ধান চাষ করে তারা ভূগর্ভস্থ জল হারাচ্ছে। ভোটদরদি সরকার পাম্পসেটের জন্য নিখরচায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে চাষির বর্তমান আয় ও ভবিষ্যৎ সর্বনাশ নিশ্চিত করছে। ভারতবর্ষের অর্থনীতি, কৃষিনীতি, জলনীতি মামুলি কাণ্ডজ্ঞানের পরিপন্থী— সুপরিচিত উদাহরণগুলি সুনিপুণ ভাবে আলোচনা করেছেন মৃদুলা। ভূগর্ভস্থ জল শেষ হচ্ছে, মাটি নষ্ট হচ্ছে, চাষির দুর্বলতা ও নির্ভরশীলতা বাড়ছে। পরিবর্তনশীল জলবায়ু অনাবৃষ্টির কারণে জলসঙ্কট ও অতিবৃষ্টিজনিত ভূমিক্ষয় বাড়িয়ে সমস্যা আরও দুরূহ করছে।

নির্বুদ্ধিতা ও অবিমৃষ্যকারিতা সর্বত্র। কিন্তু সর্বজনীন নয়। রাজেন্দ্র সিংহদের চেষ্টায়, গ্রামবুড়োদের পরামর্শ মেনে আলওয়ারের মানুষ কী ভাবে বৃষ্টির জল ধরে চির খরা দূর করেছে, ভারতের কয়েকটি শহর জঞ্জালের পৃথগীকরণ করে কী ভাবে তার প্রতিটি অংশ পুনর্ব্যবহারের পথে এগোচ্ছে, শশিকান্ত দলভি কী ভাবে পুনেতে বৃষ্টির জল ধরার আন্দোলন তৈরি করছেন, গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মুনাফাকে কী ভাবে ব্যবহার করা যায়, তার নিদর্শন কম নয়। বিদেশের দিকেও তাকিয়েছেন মৃদুলা। যেমন, নানা দেশে সৌর ও বায়ু প্রযুক্তির উন্নতি, ইজ়রায়েল কী ভাবে জলের ব্যক্তিগত মালিকানা তুলে দিয়ে ও প্রতিটি বিন্দুকে সুবিবেচকের মতো ব্যবহার করে মরুভূমিকে সুফলা করতে পেরেছে; সিঙ্গাপুরের কোম্পানিরা পরিবেশবন্ধু প্রযুক্তি তৈরির চেষ্টা শুধু নয়, সংশ্লিষ্ট গবেষণার উপযুক্ত পরিমণ্ডল গড়ার চেষ্টা করছে।

বিশ্বজোড়া পরিবেশ সঙ্কটের পেছনে জীবাশ্ম জ্বালানি-চালিত পুঁজিবাদের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে পরোক্ষ ভাবে মেনে নিয়েছেন লেখিকা। তবু, সঙ্কটের মোকাবিলায় মুনাফার ভূমিকাকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। নিজে একটি বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থার অন্যতম কর্তা। ব্যবসা-বাণিজ্যকে সমাধান কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় স্থান দেবেন এটা আশ্চর্য নয়। কিন্তু, একই সঙ্গে, প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অন্তত বেশ খানিকটা সামাজিক/সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তাকেও খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। পরিবেশবন্ধু নিদর্শনগুলির শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে জলবায়ু সঙ্কট লাঘবের এবং সঙ্কটজনিত সমস্যা মোকাবিলার কর্মসূচি বাতলাতে চেয়েছেন। গ্রন্থশেষে, ব্যক্তি নাগরিক, সংস্থা ও সরকারের কর্তব্যের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেওয়া হয়েছে।

যা সুপারিশ করেছেন, তার বেশ খানিকটা বাস্তবায়িত হলে সঙ্কট মোকাবিলায় আমরা কিছুটা সক্ষম হব। কিন্তু তা হবে কি? মুনাফা-রোজগার-অভ্যাস-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন-সাধনা-পুরুষার্থের যে ভুবনে আমাদের বাস, বাসিন্দা হয়ে তার কতটুকু পালটানো যায়, সেটা নিয়েই সংশয়। আইপিসিসির সর্বশেষ সতর্কবার্তার নিহিত তাৎপর্য বোধহয় তাই। ফলে, অনেকেই আশায় বুক বাঁধতে নারাজ। বলেন, দুনিয়াজোড়া বিপর্যয় ঘটার পর হয়তো অন্য ভাবে বাঁচার কথা পাত্তা পাবে।

মৃদুলা অবশ্য এ সব বুনিয়াদি জল্পনায় সময় ব্যয় করেননি। পাঠককে প্রধানত সবুজ বাসনা, বিনিয়োগ সম্ভাবনা ও দায়িত্ববোধে আকৃষ্ট করতে চেয়েছেন। হয়তো সেই কারণেই, সমালোচনার পথে বেশি হাঁটেননি। ফলে কিছু ফাঁক থেকে গিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে নানান পন্থায় বনসৃজনের কথা বলেছেন। কিন্তু বনসৃজন মানে সারি দিয়ে দু-তিন প্রজাতির গাছ লাগিয়ে যাওয়া নয়; প্রজাতিবৈচিত্র্য, আঞ্চলিক বাস্তুতন্ত্র ও পুষ্টিনিরাপত্তার দাবি মেনে বৃক্ষরোপণ করা হয় না। এই বিষয়ে আলোচনার দরকার ছিল। ঘোষিত বনাঞ্চল সযত্নে রক্ষার কথা আছে। কিন্তু রাস্তা, ব্রিজ, ফ্লাইওভার ও অগুনতি প্রকল্পের নামে বনাঞ্চলের বাইরে নির্বিচারে গাছ কাটা পড়ে; সে প্রসঙ্গ আসেনি। প্রকল্প ছাড়পত্র পাওয়ার আগে পরিবেশে অভিঘাতের মূল্যায়ন নামে যেটি হয় সেটি প্রায় সব ক্ষেত্রেই ধোঁকাবাজি। এ প্রসঙ্গও বাদ। বইয়ে গণপরিবহণের গুরুত্বের উপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং প্রাইভেট গাড়ির ব্যাপকতা সম্পর্কে প্রশ্ন আছে। কিন্তু বড় সন্তর্পণে। অথচ ভারতীয় অর্থনীতির এই এলাকাটির কার্বন পদচিহ্ন দ্রুত বাড়ছে, মারাত্মক বায়ুদূষণ এবং শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কথা তো ছেড়েই দিলাম। সাইকেলের প্রসঙ্গটিও প্রায় চুপিসাড়ে এসেছে। অন্য দিকে, কৃষিতে বিপ্রতীপ জলবায়ুর ঠেলা সামলানো প্রসঙ্গে জিন-পরিবর্তনের প্রযুক্তির পক্ষে লিখেছেন মৃদুলা। এখানে কিন্তু আরও অনেক সতর্কতার প্রয়োজন ছিল। তবে নিঃসরণ কমানোর অজুহাতে পরমাণু শক্তির পক্ষে প্রচার চালাননি। তাঁকে ধন্যবাদ।

তথ্যসমৃদ্ধ এই বইটিতে নির্ঘণ্ট দরকার ছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review Literature Non-Fiction
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE