Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

নিরাশ হওয়ার কারণ নেই

নস্টালজিক মধ্যবয়সিরাও কেউ কেউ হয়তো এই বই পড়েন, তবে ছোটরা একেবারে আগ্রহী না হলে এই রমরমা অসম্ভব। অর্থাৎ পুরোপুরি নিরাশ হওয়ার কারণ নেই।

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

আজকের প্রজন্মের ছোটরা বই পড়তে চায় না, তার উপর বাংলা বই... এমন কথা তো আমরা হামেশাই শুনি। অথচ তিন-চার দশক আগেও ছোটদের পুজোবার্ষিকীর স্বর্ণযুগে যে ক’টি বই প্রকাশিত হত, আজ তার সংখ্যা অনেক বেড়েছে, এমনকী এই বছরও গোটাকয়েক নতুন পুজোবার্ষিকী নজরে পড়ছে, যা রীতিমতো ঝকঝকে চেহারায় মুদ্রিত, কোনওটির দামও চোখ কপালে তোলার মতো। নস্টালজিক মধ্যবয়সিরাও কেউ কেউ হয়তো এই বই পড়েন, তবে ছোটরা একেবারে আগ্রহী না হলে এই রমরমা অসম্ভব। অর্থাৎ পুরোপুরি নিরাশ হওয়ার কারণ নেই।

চির সবুজ লেখা-য় (প্রধান সম্পাদক অর্পিতা ঘোষ) আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও কী করে শিকড়ের টানে ফিরতে পারে তারই আখ্যান দীপান্বিতা রায়ের ‘পিয়ালতলায় একরাত’। সৈকত মুখোপাধ্যায়ের ‘নোদে ডাকাতের নবরত্ন’ শেষ পর্যন্ত টেনে রাখে অনাবিল মজায়। অনেকগুলি গল্পে জীবনের মানবিক দিকে আলো ফেলার চেষ্টা নজর কাড়ে, যেমন যশোধরা রায়চৌধুরীর ‘মাঠের আড্ডা’ কি অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর ‘বাটারফ্লাই এফেক্ট’। জানার ভাণ্ডার ভরে তোলার নানা উপকরণও মজুত এই বইয়ে।

শিশু-কিশোর সাহিত্য বার্ষিকী মায়াকানন-এর (সম্পা: অর্ক পৈতণ্ডী) যাত্রা শুরু হল এ বারেই। বইটির অলংকরণ, কমিকস চোখে পড়ার মতো। হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তের লেখায় (বিছে-মানুষের দাঁড়া) ক্রিপ্টোজুলজিস্ট হেরম্যান আর সুদীপ্তর গা-শিরশিরে অভিযান, বিবেক কুণ্ডুর কল্পকাহিনি ‘বুমবুম ও মাসাইকুরুর প্যাঁচ’ বা দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের ‘সবুজ মানুষ’ মন টানে। সমুদ্র বসু পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন শূন্য দশকের শিশু-কিশোর সাহিত্যিকদের সঙ্গে।

প্রাক্‌-সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষের কিশোর ভারতী (সম্পা: ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়) নানা স্বাদের ছোটবড় লেখায় ঠাসা, অন্যান্য বারের মতোই সুসজ্জিত। রহস্য গল্পের সংখ্যাই বেশি, তার মধ্যে আছে কল্পবিজ্ঞান, ব্ল্যাক ম্যাজিক সবই। হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তর ‘তুর্কির অসি রাজপুত-মসি’ রানা প্রতাপ আর পৃথ্বীরাজের কাহিনিতে অতীতকে জীবন্ত করে তোলে। আছে ভূতের গল্প, আরও কত কী। চুমকি চট্টোপাধ্যায়ের ‘রত্নেশ্বর’ মন ভাল করা গল্প।

দেবাশিস্‌ বসু সম্পাদিত আমপাতা জামপাতা-য় লেখা-ছবির বিপুল আয়োজন, ‘পুজোর ছুটি ফুরিয়ে গেলেও যে-বই বন্ধু পাতায়, মনকে মাতায়, খুশির খাতায়’। মনোজ মিত্রের নাটক ‘বাঘবুড়ি’, সঙ্গে দেবাশীষ দেবের অলংকরণ। অমর মিত্রের ‘কালো বরফের ভুত’ ভাল ভূতের গল্প। আর্থার কোনান ডয়েলকে নিয়ে লিখেছেন কৌশিক মজুমদার। সমুদ্র বসু হদিশ দিয়েছেন হেমেন্দ্রকুমার রায়ের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি ও তার নায়কদের। মজনু শাহকে নিয়ে অনিন্দ্য ভুক্ত-র ‘বিদ্রোহী ফকির’ ইতিহাসের কম জানা অংশকে চেনায়।

শুকতারা-য় (সম্পা: রূপা মজুমদার) আজকের ছোটদের মনের গভীরে ডুব দেওয়ার কাহিনি শেখর বসুর ‘বিপদ গভীরে’ বা হীরেন চট্টোপাধ্যায়ের ‘জন্মদিনের উপহার’। ভাল লাগে সৈকত মুখোপাধ্যায়ের মানুষ ও প্রকৃতি নিয়ে ‘দীঘলবাড়ির দুরন্ত দিনগুলো’। সুভাষ ধরের পুলিশ কাহিনিতে (মুঙ্গেরের স্করপিওন গ্যাং) সুশান্ত আর ঘোষের অভিযান।

ঝালাপালা (সম্পা: অশোককুমার মিত্র) প্রথমেই মনে করিয়ে দিয়েছে ‘এ বছর যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী।... এ বছর ‘সন্দেশের’ অন্যতম প্রাক্তন সম্পাদক নলিনী দাসের জন্মশতবর্ষ এবং ‘কিশোর ভারতী’র প্রতিষ্ঠাতা দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রাক জন্মশতবর্ষ।’ তাই ‘হারানো দিন চির নবীন’ পর্বে এঁদের রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘স্মরণ’ পর্বে আছে প্রয়াত শৈলেন ঘোষ, মহাশ্বেতা দেবী ও সরল দে’র লেখা। এর সঙ্গে গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটকের সুনির্বাচিত সম্ভার।

ডিঙিনৌকো-র (সম্পা: সুনির্মল চক্রবর্তী) মতো বড় আকারে ছশো পাতার ছোটদের পূজাবার্ষিকী চমক লাগায়। এ বছরেই প্রথম প্রকাশিত এই বার্ষিকীর সম্পাদক লিখেছেন, ‘এটি ‘নিছকই একটি বার্ষিকী নয়, তোমাদের স্বপ্ন। সে যতই ছোটো হোক, সে চায় এই আশ্চর্য পৃথিবীটাকে ঘুরে ঘুরে দেখতে, জানতে।’ বারোটি উপন্যাস, ষাটটি ছোটগল্পে সব রকম পাঠকের মন ভরানো আয়োজন, তেমন চমৎকার বিভিন্ন শিল্পীর অলংকরণ। লেখা এসেছে দেশবিদেশ থেকে, ফলে সেখানেও যুক্ত হয়েছে অন্য মাত্রা। শিশুসাহিত্যিক তথা ‘শিশুমেলা’ পত্রিকার সম্পাদক অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুনির্মল চক্রবর্তী ও শ্যামলকান্তি দাশ।

ছবি-করিয়ে সত্যজিতের চেয়ে কমবয়সিদের কাছে এতটুকু কম প্রিয় নন ফেলুদা-র স্রষ্টা সত্যজিৎ, বরং বেশি। সেই লেখক সত্যজিৎকে নিয়ে ঋক ভট্টাচার্য রচিত এক নতুন স্বাদের কিশোর উপন্যাস ‘ফ্যান’। নতুনত্বের এই স্বাদটা নিখিল ভারত শিশুসাহিত্য সংসদ-এর আলোর ফুলকি (সম্পা: রাসবিহারী দত্ত ও আনসার উল হক) জুড়ে আদ্যোপান্ত। যেমন যন্ত্র সভ্যতার জনক এডিসন বা জাদুকর দাবাড়ু পেট্রোসিয়ানকে নিয়ে লেখা, কতটুকুই বা মনে রেখেছি আমরা এঁদের, বিস্মৃতি থেকে ফিরিয়ে আনাই শুধু নয়, বর্ণময় ভাষা আর কল্পনার রঙের সমারোহে।

ইতিহাস-পুরাণের গল্পের সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞান-কল্পবিজ্ঞান, পরিবেশ। ছুটির রামধনু-তে (সম্পা: ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়)। সম্পাদকের কিশোর উপন্যাস ‘নাগানাচার’, আর সঙ্কর্ষণ রায়ের ‘অভিশপ্ত পুঁথি’। রয়েছে রূপকথা, গোয়েন্দা-রহস্য, সর্বোপরি ভূতের গল্প। উপেন্দ্রকিশোরের মূল কাহিনি থেকে সুনির্মল চক্রবর্তীর নাটক ‘টুনটুনি আর নাপিতের কথা’।

আজতেক, ইনকা ও মায়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক বিংহ্যাম। আবার হরপ্পা মহেঞ্জোদরোর উন্নত নাগরিক সভ্যতার হদিশ দেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও দয়ারাম সাহানী। এমন সব নানা অনুষঙ্গে ভরা কৌশিক রায়ের বিশেষ রচনা ‘সামনে এল এক হারানো ইতিহাস’। অন্নদাশঙ্করকে নিয়েও এমন বিশেষ রচনা। কিশোর দুনিয়া-য় (সম্পা: তাপস মুখোপাধ্যায়) আরও আছে নানা স্বাদের গল্প-ছড়া-কবিতা-নাটক-বেড়ানো।

উপেন্দ্রকিশোর আর সুকুমার রায়ের কাহিনি থেকে ধারাবাহিক নাটক রচনা করে চলেছেন সুনির্মল চক্রবর্তী। শতদ্রু-তে (সম্পা: লোকেশ হোম রায়) প্রকাশ পেল তাঁর চিনে পটকা নাটকটি, সুকুমার রায় অবলম্বনে। ছড়া-কবিতা-গল্পের সঙ্গে একটি ছন্দে লেখা গল্প, জয়তী চট্টোপাধ্যায়ের ‘গল্পদাদুর আসর’।

একটি উপন্যাস, পঁচিশটি গল্প, পাঁচটা গদ্য, একচল্লিশটি ছড়া-কবিতা এবং ছোটদের লেখা-আঁকার বিভাগ ‘আলোর পাখি’ দিয়ে ভরা টাপুরটুপুর (সম্পা: মধুসূদন ঘাটী)। বাণীব্রত চক্রবর্তীর ‘তিনটি পুতুলের গল্প’, রতনতনু ঘাটীর ‘মলয় এ বার ক্লাস নাইনে’, দীপান্বিতা রায়ের ‘জব্দ হল জিন’ মন ভাল করে দেয়। মহুয়া ভট্টাচার্য গোস্বামীর গদ্য ‘ছোটদের প্রিয় কবি সরল দে’ আর শিশির বাগের ‘ছোটদের গল্পের রাজা শৈলেন ঘোষ’-এর ওপর রচনায় ছোটরা মনে রাখার মতো কিছু খুঁজে পাবে।

চাঁদের হাসি-তে (সম্পা: ছন্দা চট্টোপাধ্যায়) বেশ কিছু মনকাড়া বিভাগ। বলরাম বসাকের গল্প ‘নিরাময় গীতি’, ও অনন্যা দাশের ‘খাটের তলায় ভূত’ ও শ্যামলকান্তি দাশের দীর্ঘ ছড়া-কবিতা ‘এই তো পৌঁছে গেলে নিরিবিলিপুর’ পড়ে খুদে পাঠকরা মজা পাবে। সঙ্গে পরিবেশ সচেতনতার পাঠ নিতে পারবে অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্লাস্টিকের পাঁচকাহন’ পড়ে।

খেলা আর গল্প-য় (সম্পা: উৎপল চৌধুরী) পবিত্র সরকারের বিশেষ রচনা ‘বিশ্বভাষা, বিশ্বের ভাষা’, শ্যামল চক্রবর্তীর কে এল সায়গলের স্মরণে লেখা, অশোক সেনগুপ্তর ‘রাজাদের রাজস্থান’, শৈবাল চক্রবর্তীর ‘গরুর গল্প’ ও সুনির্মল চক্রবর্তীর ছড়া ‘ভাঙছে-গড়ছে’ পড়তে বেশ লাগে। কিন্তু একটাই ছবি আটান্ন আর ঊনআশি পাতায় ছাপা হয়েছে, কেন?

রোমাঞ্চকর কাহিনি শিশু-কিশোর পাঠকের মনে ভয় জাগিয়ে তুললেও, পরিশেষে তারা আনন্দ পায়। দোলনা -য় (সম্পা: দেবদুলাল কুণ্ডু) তাই মোট তেতাল্লিশ খানা রহস্য-রোমাঞ্চ, গোয়েন্দা গল্প ও সঙ্গে একটি নিবন্ধ। তবে মৃণাল মাইতির ফিচার ‘বিচিত্র সব গোয়েন্দারা’য় ‘রহস্য-গল্পের লেখক স্বপনকুমার’ শীর্ষক লেখার সঙ্গে ছবিটি অধ্যাপক স্বপন চক্রবর্তীর। এ ধরনের ভুল বাঞ্ছনীয় নয়।

ছিমছাম, সুচিন্তিত, সুনির্মিত কাগজ শিশুমেলা-য় (সম্পা: অরুণ চট্টোপাধ্যায়) খুদেদের যথাযথ গুরুত্ব— অনেক ছড়া, দুটো নাটক, ছোট ছোট গল্প। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ছড়া ‘টিটাই’, পবিত্র সরকারের ‘সেলফি’, নবনীতা দেব সেনের গল্প ‘মিনি, পুষি আর ঠাম্মার সিন্দুকে ভূত’, অমর মিত্রের ‘বড়ো মানিক ছোটো মানিক’ নজর কাড়ে। লেখার সঙ্গে অঙ্কনগুলিও প্রশংসনীয়।

কলকাকলি (সম্পা: সুজিতকুমার পাত্র) সম্পাদকীয়তে লিখেছে, পুজোয় যে সব ছেলেমেয়ের একটাও নতুন জামা হয়নি তাদের কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। পত্রিকার এ বারের সম্পদ ছড়া। মধুসূদন ঘাটীর ‘শুভেচ্ছার জন্মদিন’, আশিস কর্মকারের ‘আসল রহস্য’ ও কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবর হইতে সাবধান’ পাঠকদের মন ভরাবে। ‘গল্প ও ছবি’ বিভাগের গল্পগুলির হরফ এত খুদে খুদে পড়তে কষ্ট হয়। সঙ্গে ছবিগুলোও অস্পষ্ট।

ছোটদের কচিপাতা-য় (সম্পা: সমর পাল) কী নেই! নাটক, উপন্যাস, ছড়া-কবিতা, বাংলাদেশের গল্প-ছড়া, মজার, সামাজিক, হাসির, রূপকথার, অলৌকিক, মানবিকতার, গোয়েন্দা, ভূতের, কল্পবিজ্ঞান, ভ্রমণ, লোককথা, পরিবেশের গল্পের বিপুল আয়োজন। তরুণকুমার সরখেলের ‘কর্তব্যবোধ’, বাংলাদেশের লেখক খন্দকার মাহমুদুল হাসানের ‘যক্ষের ধন’ ও অনন্যা দাশের ‘দূরবীন’-এর মতো গল্প খুদে পাঠকদের ভাল লাগবে।

সব্যসাচী চক্রবর্তীর লেখা ‘শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ’-এ ‘গাছের ডালে বসা বী-ইটার তার ঠোঁটে একটা মৌমাছি ধরে।’ বাক্যটির সঙ্গে তাঁর তোলা বী-ইটার-এর ঝলমলে ছবিটি আকর্ষণীয় করে তুলেছে সন্দেশ-কে (সম্পা: সন্দীপ রায়)। নিজের আঁকা ছবির সঙ্গে ছড়া লিখেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ‘কখন পালক ভেসে ভেসে/ নামবে মাটির টানে’। নবনীতা দেব সেন-এর স্মরণলেখ ‘আমাদের মহাশ্বেতাদিদি’। শতবর্ষ স্মরণ নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে নিয়ে। সন্দীপের নির্মীয়মাণ ‘ডবল ফেলুদা’র ক্যাপশন স্টোরি। ‘প্রবন্ধ ফিচার স্মৃতিকথা’ বিভাগের রচনাগুচ্ছটি মনের খোরাক কমবয়সিদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE