Advertisement
E-Paper

প্রশ্ন তোলাই মহাভারতের ঐতিহ্য

দেবীদাস মহাভারতকে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার কাহিনি হিসেবে না দেখে জরাসন্ধ-হত্যা কৃষ্ণের রাজনীতি কি না, খাণ্ডবদাহন ও জতুগৃহে নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রের পুড়ে মরা পরিকল্পিত গণহত্যা কি না, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরও পাশায় দুর্যোধনকে হারিয়ে তাঁর রাজ্য কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন কি না ইত্যাদি হরেক প্রশ্ন তুলেছেন।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ ০২:১৭

দেবীদাস আচার্য একটি প্রশংসনীয় রকম বিপজ্জনক কাজ করেছেন। প্রথম বই লিখতে গেলে সাংবাদিকরা মুখ্যত সমসাময়িক ইতিহাসে আবদ্ধ থাকেন, কোন বিখ্যাত রাজা-উজির বা কোন বিখ্যাত ঘটনা দর্শন করেছেন, সেটিই হয় উপজীব্য। দেবীদাস আচার্য চলে গিয়েছেন পুরাণ-ইতিহাসে। মহাভারত স্মৃতিশাস্ত্রের থেকেও এক ধাপ উপরে, সে একই সঙ্গে পুরাণ ও ইতিহাস। এই বইটি মহাভারত নিয়ে দশটি নিবন্ধের সঙ্কলন। কাজটি একই সঙ্গে প্রশংসনীয় এবং বিপজ্জনকও বটে!

প্রশংসার প্রথম কারণ, দেবীদাস মহাভারতকে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার কাহিনি হিসেবে না দেখে জরাসন্ধ-হত্যা কৃষ্ণের রাজনীতি কি না, খাণ্ডবদাহন ও জতুগৃহে নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রের পুড়ে মরা পরিকল্পিত গণহত্যা কি না, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরও পাশায় দুর্যোধনকে হারিয়ে তাঁর রাজ্য কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন কি না ইত্যাদি হরেক প্রশ্ন তুলেছেন। এই প্রশ্ন তোলাটাই মহাভারতীয় ঐতিহ্য। পাঠকের মনে পড়তে পারে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বিজয়ী পাণ্ডবদের অশ্বমেধ যজ্ঞের শেষে নীল চোখের এক নকুল বা বেজি উপস্থিত হয়। তার শরীরের অর্ধেকটা সোনায় মোড়া। বেজি জানায়, উঞ্ছবৃত্তি নেওয়া এক গরিব ব্রাহ্মণ পরিবার নিজেরা অভুক্ত থেকেও অতিথিকে ছাতু দান করেছিল। ওই ব্রাহ্মণের ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়েই তার শরীরের অর্ধেক সুবর্ণময়। শরীরের বাকিটাও স্বর্ণময় করে তোলার জন্য সে এখানে অনেক গড়াগড়ি খেয়েছে, লাভ হল না। উঞ্ছবৃত্তি নেওয়া অভুক্ত ব্রাহ্মণের দানের ধারেকাছে আসে না এই অশ্বমেধ যজ্ঞ। প্রসঙ্গত, উঞ্ছবৃত্তি মানে চুরি বা ছেঁচড়ামি নয়। চাষিরা জমির ধান কেটে নিয়ে যাওয়ার পর ঘাসের গোড়ায় যে দু’একটা ধান পড়ে থাকে, তা জোগাড় করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করাই উঞ্ছবৃত্তি।

কৌশল: কথার ছলে জরাসন্ধকে ভীমের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে প্রবৃত্ত করলেন কৃষ্ণ। ছবি সৌজন্য: উ ইকিমিডিয়া কমনস

তা হলে কোনটা শ্রেয়? বৈদিক যজ্ঞ না শ্রামণিক দান? অহিংসা না ধর্মযুদ্ধ? কৃষ্ণ যে বিশাল পুরুষের রূপ দেখালেন, যাঁর শরীরে প্রাণীর সৃষ্টি-স্থিতি-লয়, সেই সাংখ্যযোগ, ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে নিষ্কাম কর্ম, না বাসুদেবে অচলা ভক্তি? কাকে বলব ধর্ম? শ্রমণদের মতো সংসার ছেড়ে মোক্ষসন্ধান, না গার্হস্থে থেকে ধর্ম-অর্থ-কামের পুরুষার্থ লাভ? মহাভারতের বৈশিষ্ট্য, সে এক কথায় কোনও সহজ উত্তর দেয় না। গার্হস্থ্যকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলেও সে শ্রমণদের প্রশংসা করে। ভীষ্ম থেকে যুধিষ্ঠির, সকলেই বারংবার জানান, ধর্মের গতি অতি সূক্ষ্ম। বহুত্ববাদে যাঁর বিশ্বাস নেই, তাঁর মহাভারতপাঠ বৃথা। দেবীদাসের বইটি তাই এই সময়ে জরুরি ছিল।

মহাভারতে জনবিদ্রোহের উপাদান
দেবীদাস আচার্য
৩৫০.০

সিগনেট প্রেস

বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ের কথা ধরা যাক। পাশাখেলায় দুর্যোধন চাল দেবেন না। চাল দেবেন শকুনি। যুধিষ্ঠিরের অনুনয়, দুর্যোধনের হয়ে খেলতে বসে শকুনি যেন ছলনা না করেন। শকুনি বললেন, দেখো, এতে অন্যায় নেই। বেদবিদ ব্রাহ্মণরাও তর্কযুদ্ধে জয় পেতে কারও না কারও কাছে যান। যুধিষ্ঠির বললেন, পাশা খেলা বা যুদ্ধে কেউ আহ্বান জানালে আমি পিছিয়ে আসি না। দেবীদাস এই উক্তিতে হালকা অহং-এর পরিচয় পেয়েছেন। সমালোচক হিসেবে আমি একমত নই। ওটাই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। বৈদিক সভ্যতা পাশা খেলার অঙ্গাঙ্গি। ঋগ্বেদে এক জুয়াড়ির আক্ষেপ আছে, পাশার নেশায় সে অর্থ থেকে স্ত্রী, সংসার সব হারিয়েছে। পাশার হারে স্ত্রী দময়ন্তী এবং নলরাজার সর্বস্ব খোয়ানোর গল্পও মহাভারতে আছে। মায় শ্রীকৃষ্ণও গীতায় বলেন, আমার পাশাখেলা ছলনার নামান্তর, দ্যূতং ছলয়তামষ্মি। তাস-দাবা-পাশা তিন সর্বনাশা গোছের চিন্তা মহাভারতে ছিল না। সেখানে পাশা রাজকীয় ব্যসন। যুধিষ্ঠির যদি ছলনার শিকার হবেন বুঝেও পাশাখেলা থেকে পিছিয়ে না আসেন, সেটি তাঁর দুর্বলতা নয়, বরং ক্ষত্রিয়ের রাজধর্ম। কিন্তু লেখকের সঙ্গে এই ভিন্নমত ম্লান হয়ে যায় অধ্যায়ের শেষে। তখন উদ্যোগপর্বের তৃতীয় অধ্যায়ের দশ নম্বর শ্লোক মনে পড়ে। যার অর্থ, ‘যুধিষ্ঠির পরের ধন কামনা করলেও অন্যের কাছে কোনও প্রার্থনা করতে পারেন না।’ শিক্ষাগুরু দ্রোণকে মিথ্যে বলার আগেই ধর্মপুত্রের চরিত্রের এই দিকটি দেখিয়েছিল মহাভারত।

review Mahabharatey Janobidroher Upadan Signet press
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy