Advertisement
E-Paper

রসনা ও অর্থনীতির যুগলবন্দি

‘ছঁওক’ একটি হিন্দি শব্দ, বাংলায় যার অর্থ হল ফোড়ন। প্রায় সমস্ত ভারতীয় রান্নায়, রান্নার শুরুতে কিংবা শেষে, ফোড়ন দেওয়াটা বাধ্যতামূলক। ফোড়ন দিতে বেশি সময় লাগে না।

পুনর্জিৎ রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৭:১৭
Share
Save

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে যাঁরা ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন তাঁরা জানেন, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ হওয়ার পাশাপাশি তিনি এক জন সুদক্ষ রন্ধনশিল্পীও। রান্নাবান্নার প্রতি তাঁর যে প্রগাঢ় অনুরাগ, ২০১৯-এ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর বহু সাক্ষাৎকারে সে কথা স্বীকারও করেছেন তিনি। সেই অনুরাগেরই সাক্ষ্য বহন করছে তাঁর সদ্যপ্রকাশিত বইটি। গত কয়েক বছর ধরে একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকের রবিবারের সংস্করণে মাসিক কলাম লিখছেন অভিজিৎ। ‘জাগারনট’ থেকে প্রকাশিত প্রায় সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠার বইটি মূলত সেই নিবন্ধগুলিরই সঙ্কলন। সমসাময়িক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিষয় নিয়ে লেখা হলেও, প্রত্যেকটি নিবন্ধেই কোনও না কোনও সূত্রে উঠে এসেছে খাবারের কথা। শুধু তা-ই নয়, যে নিবন্ধে যে নির্দিষ্ট খাবারটি উল্লিখিত হয়েছে, সেই নিবন্ধের শেষে সেই খাবারটি এবং সেই গোত্রের আরও বেশ কিছু আকর্ষণীয় আমিষ ও নিরামিষ পদের রেসিপিও পরিবেশন করেছেন অভিজিৎ পাঠকদের জন্য। অর্থনীতি বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ আমরা খবরের কাগজে কিংবা সাময়িকপত্রে প্রায়ই পড়ে থাকি। রসনা-সাহিত্যও কোনও নতুন বিষয় নয়। কিন্তু অর্থনীতি আর রসনার যে সুস্বাদু যুগলবন্দি অভিজিৎ রচনা করেছেন, হলফ করে বলা যায়, তার উদাহরণ বিশ্বসাহিত্যে নেই।

‘ছঁওক’ একটি হিন্দি শব্দ, বাংলায় যার অর্থ হল ফোড়ন। প্রায় সমস্ত ভারতীয় রান্নায়, রান্নার শুরুতে কিংবা শেষে, ফোড়ন দেওয়াটা বাধ্যতামূলক। ফোড়ন দিতে বেশি সময় লাগে না। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। কিন্তু একই পদের স্বাদ-গন্ধ আমূল বদলে যায় ফোড়নের গুণে। সেই কথা মাথায় রেখেই এই বইয়ের নামকরণ। রান্নায় ফোড়ন দেওয়ার মতোই, এই বইয়ের নিবন্ধগুলিতে অভিজিৎ সমাজবিজ্ঞানের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খুব সহজ ভাষায় এবং স্বল্প পরিসরে নিজের ভাবনাচিন্তা ব্যক্ত করে, সাধারণ মানুষের কাছে সেগুলি আরও চিত্তাকর্ষক এবং তাৎপর্যপূর্ণ (পড়ুন সুস্বাদু) করে তুলতে চেয়েছেন। বইটির মুখবন্ধে অভিজিৎ জানিয়েছেন, যখন তিনি লেখাগুলি লিখতে শুরু করেন তখন তাঁর চোখের সামনে ভাসছিল এমন এক জন পাঠকের ছবি যিনি রবিবারের মন্থর সকালে চায়ের সঙ্গে হিঙের কচুরি কিংবা গানপাউডার মাখানো ইডলি খাচ্ছেন এবং খবরের কাগজের পাতায় চোখ বোলাচ্ছেন। তাই বিষয়গত ভাবে গুরুগম্ভীর হলেও, প্রতিটি লেখার চলন তিনি রাখতে চেয়েছিলেন হালকা এবং কিঞ্চিৎ মন্থর। সেটা করতে গিয়ে প্রায় সমস্ত লেখাতেই খাবারের পাশাপাশি এসে পড়েছে অভিজিতের ব্যক্তিগত নানা অনুষঙ্গ, স্মৃতিকথা। এর ফলে লেখাগুলি অর্থনীতি-বিষয়ক নিবন্ধের পাশাপাশি হয়ে উঠেছে অত্যন্ত সুখপাঠ্য এবং সফল ব্যক্তিগত গদ্য।

ছঁঁওক-এর আর একটি বৈশিষ্ট্য হল এর অলঙ্করণ। বইটিতে মোট চব্বিশটি অলঙ্করণ আছে, প্রতিটি নিবন্ধের শিরোনাম-পৃষ্ঠায় একটি করে। সেগুলি এঁকেছেন শ্যেন অলিভিয়ের। বইটির প্রচ্ছদশিল্পীও তিনি। শ্যেন এক জন অত্যন্ত দক্ষ ফরাসি চিত্রকর। তাঁর বৈশিষ্ট্য হল, তিনি বর্গাকার, বৃত্ত ও ত্রিভুজের মতো প্রাথমিক আকার ব্যবহার করে তাঁর চিত্রগুলি নির্মাণ করেন। দ্বিধাহীন ভাবে বলা যায়, শ্যেনের অলঙ্করণ অভিজিতের লেখার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছে। লেখাগুলির মতো অলঙ্করণগুলিও আপাতভাবে হালকা মেজাজের, অনেকটা কার্টুনের ধাঁচের। যদিও ভাল করে দেখলে বোঝা যাবে, সেগুলোতে ফুটে উঠেছে নিবন্ধে আলোচিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়বস্তু। এই অলঙ্করণগুলি অভিজিতের লেখাগুলির আকর্ষণ বৃদ্ধি তো করেছেই, একই সঙ্গে স্বতন্ত্র চিত্র হিসাবেও এগুলি অনবদ্য ও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

ছঁওক: অন ফুড, ইকনমিক্স অ্যান্ড সোসাইটি

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

৮৯৯.০০

জাগারনট বুকস

বইতে সঙ্কলিত চব্বিশটি নিবন্ধ তিনটি পর্বে বিন্যস্ত— অর্থনীতি ও মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি ও সামাজিক নীতি। প্রতিটি পর্বের নিবন্ধে আলোচিত অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়বস্তু অত্যন্ত মনোজ্ঞ। প্রথম পর্বে উঠে এসেছে ভারতীয় মহিলাদের যথেষ্ট হারে শ্রমশক্তিতে যোগদান না করার প্রসঙ্গ, বয়স্কদের একাকিত্ব এবং হতাশার প্রসঙ্গ, আমাদের পছন্দসমূহ তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়ার প্রসঙ্গ, অঙ্গীকার রক্ষায় মনোবিজ্ঞানের ভূমিকার প্রসঙ্গ ইত্যাদি। দ্বিতীয় পর্বে যে বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে সেগুলি হল উপহার দেওয়া-নেওয়া এবং তার আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য, বিশ্বাসের সঙ্গে বাণিজ্যের সম্পর্ক, অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নির্ধারণে তথ্য ও ধারণার ভূমিকা, দরিদ্রদের যথেষ্ট সঞ্চয় না করতে পারার কারণ, কেরিয়ার নির্বাচনে সংস্কৃতির ভূমিকা ইত্যাদি। বৃহৎ কর্পোরেটদের দানের নীতি, গ্যারান্টিযুক্ত ন্যূনতম আয়ের নীতির সুবিধা, ভারতীয়দের প্রোটিন গ্রহণ বৃদ্ধির পন্থা, প্রখর গ্রীষ্ম মোকাবিলায় সরকারি নীতি ইত্যাদি প্রসঙ্গ শেষ পর্বের নিবন্ধগুলির মূল বিষয়। উল্লেখ্য, প্রত্যেকটি পর্বের শুরুতে একটি করে নাতিদীর্ঘ ভূমিকা রয়েছে যা সেই পর্বে আলোচিত বিষয়সমূহ সম্পর্কে পাঠককে একটি সামগ্রিক ধারণা দেয়।

এই নিবন্ধগুলিতে রসনার প্রবেশ ঘটে কী করে? দু’-একটা উদাহরণ দিই। ভারতীয় মহিলাদের যথেষ্ট হারে শ্রমশক্তির অংশ না হওয়ার প্রসঙ্গে (‘উইমেন অ্যান্ড ওয়ার্ক’) অভিজিৎ, তাঁর মা অধ্যাপক নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গবেষণার ভিত্তিতে, লিখছেন— যে বয়সে উন্নত দেশের মেয়েরা শ্রমশক্তিতে যোগদানের প্রস্তুতি নেয়, সেই বয়সে ভারতীয় মেয়েরা বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। তাই শ্রমশক্তিতে প্রবেশ করা তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এর ফলে হাজার রকম গৃহকর্মে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন তাঁরা, কিছুটা সংসারের অর্থ সাশ্রয়ের জন্য, কিছুটা বাধ্য হয়ে (কারণ তাঁদের প্রায়ই শুনতে হয়, ‘বাইরে বেরিয়ে রোজগার তো করো না, অন্তত সংসারটা সামলাও’)। এই কাজগুলির মধ্যে যেমন পড়ে রান্না করা, বাসন মাজা, তেমনই পড়ে মাঠঘাট বনবাদাড় থেকে আনাজ সংগ্রহ করা, ধানের খেতের খাল থেকে শাড়ির আঁচল ব্যবহার করে কুচো চিংড়ি ধরা ইত্যাদি। সেই আনাজ আর কুচো চিংড়ি দিয়ে— অভিজিৎ লিখছেন— সুস্বাদু ঘণ্ট রাঁধেন হয়তো তাঁরা, তবে সে রান্না যে তাঁদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিনিময়ে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। লেখাটির শেষে অভিজিৎ পরিবেশন করেন তিনটি প্রাসঙ্গিক রেসিপি— পালং শাকের ঘণ্ট, ছোলার ডাল, নেপালি ডাইকন (মুলো) স্যালাড।

দ্বিতীয় উদাহরণ। বিশ্ব উষ্ণায়নের সৌজন্যে গ্রীষ্মে আমাদের দেশের নিম্নমধ্যবিত্তের দুর্দশার অন্ত নেই। হয়তো তাঁদের মধ্যে অনেকেই এসি কেনেন বাধ্য হয়ে। দুঃখের বিষয়, সেগুলি আপেক্ষিক ভাবে সস্তা হওয়ার দরুন শক্তির অত্যন্ত বেশি অপচয় ঘটিয়ে প্রকারান্তরে উষ্ণায়নকেই সাহায্য করে। ‘অ্যাডাপ্টিং টু হট সামারস’-এ অভিজিতের বক্তব্য, এই সমস্যা মেটাতে সরকারের উচিত একাধিক নীতি গ্রহণ করা— যেমন, দামি অথচ পরিবেশবান্ধব এসি গরিব মধ্যবিত্তকে কিনতে সাহায্য করা, এবং বেশি করে গাছ লাগানোয় জোর দেওয়া। রাস্তার ধারে সরাইখানা গোছের কিছু নির্মাণের কথাও সরকারের গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। এই সরাইখানাগুলিতে সব শ্রেণির ক্লান্ত বিধ্বস্ত মানুষ একটু জিরিয়ে নিতে পারবে। এগুলির অন্দরে বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে গরম থেকে রেহাই দেয় এমন নানা পানীয়ের যেমন— ছাতু, লেবু কিংবা ফলসার শরবত, আইস টি এবং কয়েক টুকরো শসা দেওয়া ঠান্ডা জল। রাস্তার ধারে যে চায়ের দোকানগুলি দেখা যায় সর্বত্র, এই সরাইখানাগুলি সেই চায়ের দোকানেরই ‘ঠান্ডা’ সংস্করণ হিসাবে গড়ে তোলা যেতে পারে। লেখাটির শেষে সংযোজিত হয়েছে তিনটি ঠান্ডা পানীয়ের রেসিপি—মেক্সিকান হচাটা, ভিয়েতনামিজ় ম্যাঙ্গো টি এবং মরক্কান স্টাইল কিউকাম্বার ওয়াটার।

সব মিলিয়ে বলাই যায়, ছকভাঙা জমজমাট বই ছঁওক। অর্থনীতি কিংবা সমাজ সম্পর্কে আপনার যদি আগ্রহ থাকে, এই বই আপনার ভাল না লেগে উপায় নেই। আর তার সঙ্গে যদি খেতে, খাওয়াতে কিংবা রান্না করতে ভালবাসেন, তা হলে তো সোনায় সোহাগা!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}