সমাজ-অর্থনীতির অজস্র বাধাবিপত্তির মধ্যে এমন মানুষের প্রয়োজন খুব বেশি যাঁর সান্নিধ্যে কিছুটা বলভরসা পাওয়া যায়। তার মানে এই নয় যে, সেই মানুষ থেকেই বাধাবিপত্তির নিরাময় হবে। সে সমাধান তো আরও অনেক জটিলতায় জড়িত। তবু স্পষ্ট বিশ্লেষণ, যুক্তিপূর্ণ বিন্যাস এবং নির্ভীক পথনির্দেশ যেন এক ধরনের আশ্বাস জোগায়। চার পাশে তেমন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে।” — অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের মৃত্যুর স্বল্পকাল পরে ‘অর্থনীতির মন’ শীর্ষক প্রবন্ধের সূচনায় কথাগুলি লিখেছিলেন অশোক সেন। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বারোমাস পত্রিকার এপ্রিল ১৯৯৭ সংখ্যায়। ভবতোষবাবু বিদায় নিয়েছিলেন সে-বছর ১১ জানুয়ারি।
অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী অশোক সেনের (১৯২৭-২০১৫) লেখা ও কথোপকথন নিয়ে তৈরি স্মৃতি ও নাট্যস্মৃতি সঙ্কলনের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এই বাক্যগুলি পড়ে নতুন করে মনে হল, আজ, তাঁর বিদায়ের প্রায় এক দশক পরে তাঁর কথাও এ ভাবেই বলতে পারি। সমকাল নিয়ে, সেই সমকালের পিছনে থাকা তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতালব্ধ ভাবনা নিয়ে, আর ঘোর থেকে ক্রমশই ঘোরতর অনিশ্চিতির খাদে তলিয়ে যেতে থাকা ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনিও তো কখনও কোনও সমাধান দিতেন না, কোনও সর্বশক্তিমান ভ্যানগার্ড-এর মহাসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে হাতে-গরম সমাধান ঘোষণার অবিবেচনা ছিল এই যথার্থ বামপন্থী মানুষটির স্বভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি সকলকে প্রশ্ন করতেন, এবং নিজেকেও। জীবন ও জগৎ নিয়ে সেই সমস্ত প্রশ্নের ধরতাই ছিল এক অনন্ত জিজ্ঞাসা: কী ভাবছ বলো। সকলের ভাবনার সঙ্গে আলাপচারী থেকেই তিনি নিজের ভাবনা ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁর সমাজভাবনার এই সূত্রটিকে প্রায় সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠার এই সঙ্কলনে সহজেই চিনে নেওয়া যায়। সব ধরনের লেখা ও কথা জুড়েই এখানে জারি থাকে সমাজের সঙ্গে নিজেকে এক সত্যকারের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে দেখবার এবং বুঝবার অনুশীলন।
স্মৃতি নাট্যস্মৃতি
অশোক সেন,
সম্পা: সৌরীন ভট্টাচার্য
৩৯৫.০০
সেরিবান
বড় যত্ন করে বইটি সাজিয়েছেন সম্পাদক সৌরীন ভট্টাচার্য, অশোকবাবুর সুহৃৎ, অনুরাগী ও দীর্ঘদিনের সহযোগী। তিনটি ভাগ আছে এই সঙ্কলনের। প্রথম ভাগে নাটকের জগতের কথা, যে জগতের সঙ্গে চল্লিশের দশক থেকে লেখকের সুগভীর সম্পর্ক শেষ দিন অবধি অটুট ছিল। ‘লক্ষ্যভ্রষ্ট রাজা ওয়দিপাউস’ (১৯৬৫), ‘গালিলেওর চরিত্র’ (১৯৮১), ‘রক্তকরবী-র সেকাল একাল’ (২০০৪) — কয়েকটি লেখার শিরোনাম এবং সময়কাল উল্লেখ করামাত্র আমাদের নাট্যভুবনের ঐশ্বর্যময় অতীতের উপর পাদপ্রদীপের আলো এসে পড়ে, পাঠকের চোখে কেবলই দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরের পুনর্জন্ম হয়। কেবল নাটক নয়, তার মধ্য দিয়ে সমাজ-রাজনীতির গভীর বিশ্লেষণের অসামান্য নিদর্শন চার দশকের বিভিন্ন সময়ে রচিত পনেরোটি লেখা। বিশেষত খেয়াল করতে হয় অনুচ্চ কণ্ঠে যুক্তিসিদ্ধ সমালোচনার নিদর্শনগুলি। যেমন বহুরূপী-র রাজা ওয়দিপাউস-এর শেষ লগ্নে রানি য়োকাস্তার ‘প্রকাশ্য আবেগের অতিরেক’কে ‘খাপছাড়া’ বলেই অশোক সেন নিরস্ত হননি, প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন ওই আতিশয্য নাটকটির নিজস্ব যুক্তির সঙ্গে সমঞ্জস ছিল না।
দ্বিতীয় ভাগটির শুরুতে নিজের প্রথম জীবনের কিছু স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা; তার পরে কলকাতা শহর বিষয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ; তার পরে বেশ কিছু বিশিষ্ট মানুষ সম্পর্কে এক বা একাধিক লেখা— সেই তালিকায় আছেন ইতিহাসবিদ সুশোভন সরকার ও বরুণ দে, অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত, পঞ্চানন চক্রবর্তী ও অজিতকুমার বিশ্বাস; শেষ পর্বে সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতের বিশেষ কয়েকজন বন্ধুর কথা, যেমন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমলেন্দু চক্রবর্তী, চিত্তরঞ্জন ঘোষ, আর আছে দীর্ঘদিনের এক অনুজ সহকর্মীর অকালবিদায়ের পরে লেখা একটি মর্মস্পর্শী নিবন্ধ। তৃতীয় এবং শেষ ভাগে আছে একটি আত্মকথন। জীবনের শেষ অধ্যায়ে বছরখানেক ধরে তাঁর মুখে সে-কথা শুনেছিলেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়। জীবন থেমে গেল, কথাও। আমাদের আফসোস থেকে গেল। তবু, তরুণ বয়স অবধি তাঁর অভিজ্ঞতা আর চিন্তাভাবনা কিছুটা ধরা থাকল, আর তার মধ্য দিয়ে ধরা থাকল একটি সজাগ, সহৃদয় ও সংবেদনশীল মনের পরিচয়।
সংবেদন— সম্যক বেদনা— এক অর্থে অশোক সেনের স্বভাবধর্ম। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বরাবর তার পরিচয় পেয়েছি, বারংবার পরিচয় পেলাম এই স্মৃতিগ্রন্থের পাতায় পাতায়। যেমন ধরা যাক একটি স্মৃতির কথা, যা ফিরে ফিরে এসেছে বিভিন্ন সময়ের, বিভিন্ন বয়সের লেখায় এবং আলাপে। চল্লিশের দশক, যুদ্ধের কলকাতা। “একদিন তখনও ঠিক পুরো সন্ধে হয়নি। সাদার্ন অ্যাভিনিউ দিয়ে হেঁটে আসছি। ল্যাম্পপোস্টের নীচে একটি মেয়ে, বালিকা বললেই হয়, কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। কিছু দূরে অন্য কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে সৈন্যেরা কামনায় কিলবিল করছে। একলা মেয়েটির আর্তনাদের কারণ আলাদা করে জানবার কিছু ছিল না। অথর্বের মতো আমি তার কান্না শুনেছিলাম শুধু।” সেই শ্রুতিবেদনা থেকে জীবনে কোনও দিন মুক্তি মেলেনি আর।
তাঁর রাজনীতির বোধ এবং অনুশীলনও এই বেদনার সঙ্গে ওতপ্রোত। শেষ জীবনের স্মৃতিচর্চার শুরুতেই (‘বেড়ে ওঠার দিনগুলো’) স্বাভাবিক স্পষ্ট এবং অনুচ্চ স্বরে বলেন তিনি: মার্ক্সের জীবন ও লেখা নিয়ে, মার্ক্সবাদী তত্ত্ব ও প্রয়োগ নিয়ে পড়াশোনার পর্ব বেশ কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পরেও, “...ইন্টারমিডিয়েটের সময় অবধিও আমি মার্কসে পুরোপুরি কমিটেড হইনি। সেই ধাক্কাটা দিল মন্বন্তর। ওই যে রিলিফ ওয়র্ক, সেখান থেকেই কমিউনিস্টদের প্রতি আমার অ্যাডমিরেশন তৈরি হতে থাকল। আসলে কী জানো, এগুলো বুঝিয়ে বলা খুব মুশকিল। ওই বয়সে মানুষের ওই রকম হাহাকার দেখতে হলে কীরকম একটা যেন হয়ে যায় মনটা।”
মনের এই ‘কীরকম যেন’ হয়ে যাওয়ার যে অনুভূতি, তার অভিঘাতে বামপন্থী মতাদর্শ ও রাজনীতির পথে অগ্রবর্তী হওয়ার নিদর্শন সুলভ। কিন্তু অশোক সেনের মতো বামপন্থীরা এই কারণে ব্যতিক্রমী যে, তাঁদের রাজনীতিকে তাঁরা কখনও সেই অনুভূতি থেকে বিশ্লিষ্ট করেননি। এই বইয়ের নানা অঞ্চলে ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থা ও বামপন্থীদের কথা বলতে গিয়ে যে ক্ষোভ এবং বেদনার সুর ক্রমাগত বেজে উঠতে থাকে, তার একটি বড় কারণ স্বাভাবিক মানবিকতার দাবি থেকে বামপন্থীদের অনেকেরই মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস। সমাজ বদলানোর এক বিপুল সম্ভাবনা তৈরি করে তাকে নষ্ট করে ফেলার দুর্ভাগ্য। তবে কেবল ‘দুর্ভাগ্য’ বলে বিরত হননি লেখক। ২০০৩ সালে ‘সর্ষের মধ্যে ভূতের উপদ্রব’ প্রবন্ধে তিনি বিশ্বের সমাজতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে সেই উপদ্রবের কথা উল্লেখ করার পরে বামফ্রন্ট শাসিত পশ্চিমবঙ্গেও তাকে চিহ্নিত করেন, এবং স্পষ্ট ভাষায় নির্দিষ্ট করেন ‘নিছক দলীয় স্বার্থের পাকেচক্রে চাওয়া-পাওয়ার কানামাছি খেলা’র নির্মম লজ্জাহীন সত্যটিকে। ঠিক যেমন কলকাতা এবং তার সমাজের শরীর-মনের বিবর্তন নিয়ে আশি-নব্বইয়ের দশকে লেখা তিনটি প্রবন্ধে শান্ত তিরস্কারে বিদ্ধ করেন আমাদের ‘আধুনিকতা’র ‘ছিন্নমূল’ এবং বিকৃত স্বরূপটিকে।
চিৎকারসর্বস্ব পঙ্কিল রাজনীতি আর সুযোগসন্ধানী চাটুকারিতায় কিলবিল করা এই আধুনিক চণ্ডীমণ্ডপে অশোক সেনের মতো মানুষেরা নেই, সেটা আমাদের বড় দুর্ভাগ্য। তবে তাঁরা বেঁচে গিয়েছেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)