বিশ্ব নামক সামগ্রিকতার বয়ানে একটা সম-র ধারণা থাকলেও ‘বিশ্বসাহিত্য’ আলোচনায় কোন অঞ্চলকে মাঝে রাখা হয়, আর কোন অঞ্চলের সাহিত্য প্রান্তে রয়েছে বলে তাদের যোগ করে নেওয়া হয়, সেই কেন্দ্র-প্রান্ত নিয়ে প্রশ্ন করে চলেছেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক থেকে ফ্রাঞ্চেসকা ওরসিনি পর্যন্ত। বিশ্বের ধারণা অবস্থানভেদে ভিন্ন— ডেভিড ডামরোশ-এর এই সূচককে স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ় (সোয়াস)-এর ইমেরিটা অধ্যাপক, তুলনামূলক সাহিত্যের অন্যতম স্কলার ফ্রাঞ্চেসকা ওরসিনি তাঁর দীর্ঘ দুই দশক জুড়ে বিশ্বসাহিত্য নিয়ে গবেষণায় বার বার ব্যাখ্যা করেছেন। আলোচ্য বইটি প্রদেশের সাহিত্য থেকে বিশ্বসাহিত্যকে বুঝতে আমাদের কোন পঠন-অবস্থান নিতে হবে, সে বিষয়ে তাঁর সুদীর্ঘ অনুসন্ধিৎসা ও অভিনিবেশের ফল।
বইটি বিপুল ও বিশদ, কিন্তু সে শুধু পৃষ্ঠাসংখ্যায় নয়— যুক্তির উদ্যম, মৌলিকতা ও গভীরতায়। দিল্লির পুবে ইলাহাবাদ পর্যন্ত এই বিস্তীর্ণ এলাকায় কথা, প্রেমোপাখ্যান, সন্ত-কাব্য, তাজ়কিরা এই বর্গগুলি থেকে যে পরিমাণ রচনাকে তাদের তিন শতাব্দীব্যাপী সামগ্রিক প্রতিবেশকে ওরসিনি নিয়ে আসেন, তা অভিভূত হওয়ার মতো।
ওরসিনি দেখাতে চান যে, বিশ্বসাহিত্য আসলে নানাবিধ ভাষাসাহিত্য পরিসরের মধ্যে নিরন্তর আদানপ্রদানের একটি ব্যাপ্ত ধারণা। আমাদের খেয়াল করতে হবে, কোনও একটি অঞ্চল বা সাহিত্যপাঠ বা ব্যক্তি কী ভাবে বহুভাষিক। ওরসিনির প্রতিপাদ্য হল, একটি অঞ্চলের ভাষা-সাহিত্যের মধ্যে বহুভাষিক আদানপ্রদানকে বিশ্বসাহিত্য হিসাবে বুঝে নিতে হবে। সেই মোতাবেক নিহিত বহুমাত্রিক বহুভাষিকতা-নির্ভর সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করা যেতে পারে একটি বিশেষ স্থাননিহিত অবস্থান থেকে। ওরসিনির বিশ্ব ও বিশ্বসাহিত্যের আলোচনা দাঁড়িয়ে আছে সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে ভূগোলের আন্তঃশৃঙ্খলায়। ‘ওয়ার্ল্ড’, এই ধারণায় নিহিত ইউরোপ-কেন্দ্রিক সাধারণীকরণের ভার সরাতে তিনি বহুভাষিক অঞ্চলকে ‘বিশিষ্ট পরিসর’ হিসাবে বিবেচনা করার প্রস্তাব করেন। আলোচ্য বইটি তারই একটি নিবিষ্ট প্রায়োগিক মডেল।
এখানে অনুধ্যানের বিষয়, দিল্লির পুব দিকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সুলতানি আমল থেকে মোগল শাসনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ফারসি ভাষার আবহে অওধি, হিন্দভি, ভোজপুরি, ফারসি, উর্দু থেকে পুবে ব্রজভাষা পর্যন্ত বিপুল ‘বহুভাষিক সৃষ্টি-জগৎ’। ফারসি সেখানে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার ভাষা না হয়ে উঠে স্থানীয় ভাষাগুলির বিকাশের সঙ্গে নানা মাত্রায় জুড়ে আছে। এই বহুভাষিক অঞ্চলকে তার প্রচলিত স্থান নাম ‘পুরব’ বলে উল্লেখ করে ফ্রাঞ্চেসকা সেখানে নানা অণু-পরিসরে সাহিত্য রুচি, পাঠ ও লিখনের অভ্যাসকে চিহ্নিত করলেন। ‘পুরব’কে বোঝার জন্য এখানে রাখা হল সময়ের ভেদ। কী ভাবে সুলতানি আমল থেকে মোগল শাসনকালে পুরবের ব্যাপ্ত পরিসরে শহর নগর ও কসবার নানাবিধ পত্তনি গড়ে উঠছে, সেই পত্তনিগুলিতে ‘কথা’, প্রেমোপাখ্যান, সন্ত-গীতি ও তাজ়কিরা বিকাশ পাচ্ছে, তাদের পড়া হচ্ছে, এক জায়গা থেকে অন্যত্র পৌঁছে যাচ্ছে এক-একটি কাব্য, তাদের ফারসিতে অনুবাদ হচ্ছে বা আর পড়াই হচ্ছে না।
ওরসিনি লিখেছেন, মালিক মহম্মদ জয়সীর পদুমাবত সমগ্র পুরবে এক জনপ্রিয় হলেও তা পশ্চিমা দুনিয়ায় উনিশ শতকের অনুবাদের বিপুল প্রচেষ্টার মধ্যে আসেনি, কবীর বা মীরার পদ বা তুলসীদাসের রামচরিতমানস যে ভাবে বিশ্বসাহিত্যের তালিকায় এসেছে, পদুমাবত আসেনি। তা হলে যা অঞ্চলের ঘেরাটোপ সে ভাবে ছাড়াতে পারে না, বা ইউরোপীয় ক্ষমতার ভাষায় অনুবাদ হয় না, তা কি কদাচই বিশ্বসাহিত্য পদবাচ্য নয়? সমসময়ে ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদের নেটওয়ার্কে, আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য নির্বাচন পদ্ধতিতে যা বাদ রইল তা কি বিশ্ব নয়— লেখিকা এই প্রশ্ন বার বার করেন।
পুরবের অওধি, ফারসি, উর্দু ও ব্রজভাষায় রচিত অজস্র কবির রচনার প্রগাঢ় পাঠ বিশ্লেষণে (‘থিক ডেসক্রিপশন’) লেখিকার প্রতিপাদ্য বিষয় যে, স্থান বা এথনো-পরিচিতিভিত্তিক কোনও একক ভাষাসাহিত্য হতেই পারে না। এমনকি সাহিত্যের গতিময়তাকে সংস্কৃত-আরবি-ফারসি-দেশি ভাষার মধ্যে কোনও জুটি-বাঁধা দ্বিভাষিকতার (ডাইগ্লসিয়া) মধ্যে ফেলে দেখাও কাজের নয়।
ইস্ট অব দিল্লি: মাল্টিলিঙ্গুয়াল লিটারারি কালচার অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড লিটারেচার ফ্রাঞ্চেসকা ওরসিনি
৯৯৫.০০
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
বিশ্বসাহিত্যের আলোচনায় প্রাথমিক প্রশ্নটি যে-হেতু কোনও একটি সাহিত্য বর্গের নানা পরিসরে বিস্তৃতি (অনুবাদও), তাই তাকে বোধগম্যতায় আনতে কিছু সাধারণ কাঠামো ও পাঠ সঞ্চলনের কিছু ‘গ্লোবাল সিস্টেম’ ভেবে নেওয়া হয়েছে। বিপুল পরিসরের অগুনতি সাহিত্যকে পঠনসীমার মধ্যে আনতে দূরবর্তী পাঠকে (ডিসট্যান্ট রিডিং) উপযুক্ত পঠনপদ্ধতি ধরে নেওয়া হয়েছে, যেখানে কোনও অঞ্চলের সাহিত্যের উপর সহায়ক গ্রন্থপঞ্জির মাধ্যমে সাহিত্যপঠন ও বিশ্লেষণ চলবে। প্রসারিত (ম্যাক্রো) এই পঠনের ‘বিপরীত’-এ প্রদেশ (মাইক্রো) একটি বদ্ধ ও অসাড় ধারণা। এরই বিপরীতে অওধি, ফারসি, ভোজপুরি, খাড়িবোলি, উর্দু ও ব্রজভাষায় লিখিত সাহিত্যের প্রগাঢ় পঠনে (থিক রিডিং) ফ্রাঞ্চেসকা বহুভাষিক প্রদেশকে তাঁর লেন্স হিসাবে নিয়ে আসছেন। এবং সেই বহুভাষিকতা পরস্পর সংলগ্ন, গ্রন্থিবদ্ধ।
না, এই বইতে বহুভাষিকতাকে কখনওই নানা ভাষার সোজাসুজি উপস্থিতি হিসাবে দেখে নিতে প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। বহুভাষিকতা নানা ভাষার যোগফল নয়, বরং অনুবাদ অনুকৃতির মধ্য দিয়ে তাকে বোঝার থাকে, এক কাব্যে অন্য কাব্যের প্রত্যক্ষ বা তেরছা উপস্থিতিতে (ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি) তাকে টের পাওয়া যায়। কোথাও হিন্দভি কাব্য চন্দায়ণ ফারসি লিপিতে লেখা হয়, দাউদ সম্পূর্ণ ফারসি কাব্য প্রকরণ মেনে চন্দায়ণ লেখেন কিন্তু তাঁর ভাব ও ভাষা সম্পূর্ণ দেশি। তেমনই অনুবাদ ছাড়াই চন্দায়ণ নানা অঞ্চলে কথিত হয়েছে, পঠিত হয়েছে। নানা সাহিত্য বর্গ থেকে তুলে ধরা এ রকম অজস্র কাব্যের নিবিষ্টতায় বইটি সমৃদ্ধ।
সাহিত্য ইতিহাসের রচনায় যে ভাবে কসমোপলিট্যানিজ়মের একরোখা সংজ্ঞা, মার্গীয় ও দিশির মধ্যে যে অনতিক্রম্যতা, তা থেকে বেরিয়ে এসে কসবাগুলিতে অওধি, হিন্দভি, ফারসি, উর্দু ও ব্রজভাষার চর্চা ধরে কসমোপলিট্যানিজ়মের ভিন্ন স্থানীয় রূপটি কী রকম তার সন্ধান সমস্ত বই জুড়ে। পুঁথিভিত্তিক সাহিত্য সমাজের সঙ্গে সন্ত কবিদের রচনার মৌখিকতাকে রুচি ও স্থানীয় কসমোপলিট্যানিজ়মের পরিকল্পে রাখা হয়েছে। প্রচলিত ধ্যানধারণা থেকে সরে গিয়ে ফ্রাঞ্চেসকা দেখিয়েছেন, ভক্তি কবিতার দশকওয়ারি আলোচনা কিছুতেই সুলতানি আমলের প্রাদেশিক শাসক ও এলিটদের রুচির বাইরে রেখে করা যাবে না, তা সে যোগ যতই তির্যক হোক।
আঠারো শতকে শেষ না করে দিয়ে ফ্রাঞ্চেসকা প্রতিটি অধ্যায়ের আলোচনাকে নিয়ে আসেন উপনিবেশিক প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টায়, যখন ভাষা থেকে এই বহুভাষিক সাধারণ সাহিত্য জীবন বাদ পড়ে আত্মপরিচয়ের মূল অক্ষ হয়ে দাঁড়াল একক ভাষা ব্যবহার। ফলে এই নিবিষ্ট পাঠ আর্লি মডার্ন-কে আলাদা না রেখে সময়ের ধারাবাহিকতায় এনে ফেলল।
ভাষাব্যবস্থার মধ্যে অবশ্যই রয়েছে অনতিক্রম্য ক্ষমতাবিন্যাস। উত্তর-ঔপনিবেশিক এই বীক্ষার অতিরিক্ত যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি ধরিয়ে দেন ফ্রাঞ্চেসকা তা হল, ভাষিক যোগ তৈরি হয় এক ভাষার নান্দনিকতা অন্য ভাষায় পরিগ্রহণেও। ভাষানির্ভর জাতি-অস্মিতার বাড়াবাড়ি কালে বহুভাষিক সাহিত্যের ইতিহাস কি এক ধরনের প্রতিষেধকের মতো আসে না?
না বললেই নয় যে, বইটি পাঠককে অর্থ উদ্ধারের লড়াইয়ে ব্যাপৃত করে না। বহুভাষিক সাহিত্যভান্ডার থেকে অজস্র উদ্ধৃতি (মূল ও ইংরেজি অনুবাদে) যেমন পাঠককে রসের আস্বাদ দেয়, তেমনই বইটির আখ্যানের স্বচ্ছ গতিময়তায় তথ্যের প্রাচুর্য ও যুক্তির কূট বুদ্ধিলভ্য হয়ে ওঠে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)