E-Paper

‘গান্ধীর দেশ’, আলো থাকবেই?

নিজস্ব লেন্সের অনেক উদাহরণ। এই যেমন, রাজীব গান্ধী সম্পর্কে লেখকের মনোভাব হয়তো একটু বেশি স্নেহসিক্ত।

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৯:২২
অবসান: বিড়লা হাউসে শায়িত মহাত্মা গান্ধীর মরদেহ, ১৯৪৮

অবসান: বিড়লা হাউসে শায়িত মহাত্মা গান্ধীর মরদেহ, ১৯৪৮

এক জন অনুল্লেখযোগ্য মানুষের স্মৃতিতে ধরা স্বাধীন ভারতের উল্লেখযোগ্য ইতিহাস-কাহিনি— এই ভাবেই বইটির বর্ণনা দিয়েছেন লেখক নিজে। আর, আমাদের যদি বইটির বর্ণনা দিতে হয়? স্বাধীনতার মুহূর্ত থেকে, বস্তুত তার বছরখানেক আগে থেকে, ভারতবর্ষের জন্ম ও যাত্রার এই বিবরণ এক কথায় অ-তুলনীয়। কেউ ভাবতে পারেন অন্য কয়েকটি বই, যেমন রামচন্দ্র গুহ-র ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী কিংবা নীরদচন্দ্র চৌধুরীর দি অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান-এর কথা। প্রথম বইটির থেকে এ বই আলাদা এর ‘পার্সোনাল ন্যারেটিভ স্টাইল’ বা ব্যক্তিগত স্বরের কারণে। দ্বিতীয় বইটির থেকেও আলাদা, কেননা এই স্বরে মিশে আছে লেখকের নিজস্ব পরিচয়, এবং সেই পরিচয়ের ভিত্তিতে তাঁর দেখার বিশিষ্ট ভঙ্গি ও বিশেষ কৌণিক অবস্থান— যার নাগাল পাওয়া সকলের পক্ষে সম্ভবই নয়।

কেনই-বা সেই দৃষ্টিকোণ বিশেষ/অ-তুলনীয় হবে না? যাঁর পিতামহ মহাত্মা গান্ধী, মাতামহ সি রাজাগোপালাচারি, যিনি নিজে দুই রাষ্ট্রপতি আর বেঙ্কটরমন (১৯৮৭-৯২) এবং কে আর নারায়ণন (১৯৯৭-২০০২)-এর সেক্রেটারি, যিনি পরবর্তী কালে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের রাজ্যপাল, যাঁর নাম দেশের উপরাষ্ট্রপতি (এবং সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি) পদের জন্য মনোনীত হয়েছিল— এঁর অবস্থানের সঙ্গে কি অনেকের মিল থাকতে পারে? তা ছাড়া, লেখকের বাবা— মহাত্মার কনিষ্ঠ পুত্র দেবদাস গান্ধী— দিল্লিতে হিন্দুস্থান টাইমস সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলেন, তাই ব্যক্তিগত লেখাপত্র, ডায়েরির সঙ্গে সংবাদসূত্রেরও এক বিরাট সম্ভার এখানে ব্যবহৃত। আছে আর্কাইভ তথ্যসূত্রও। সব মিলিয়ে লেখক যে উচ্চতায় বিরাজ করেন তা সহজলভ্য নয়। এও ঠিক, সেই উচ্চতা থেকে দেখলে, এবং পার্সোনাল ন্যারেটিভ-এর ধাঁচে লিখলে এক রকম নিজস্ব দৃষ্টির লেন্সও থেকে যায় কিছু ক্ষেত্রে, যাকে ঠিক নিরপেক্ষ বা নিস্পৃহ বলা যায় না।

নিজস্ব লেন্সের অনেক উদাহরণ। এই যেমন, রাজীব গান্ধী সম্পর্কে লেখকের মনোভাব হয়তো একটু বেশি স্নেহসিক্ত। ‘অডাশিয়াস... পিস ওয়ারিয়র’ বা ‘দুঃসাহসী শান্তিযোদ্ধা’ আর তার সঙ্গে ‘চার্ম ইটসেল্ফ’ বা ‘মনমোহন চরিত্র’ বলেন তিনি নেহরু পরিবারের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রীকে। এই স্নেহের ফাঁক দিয়ে নিরপেক্ষ মূল্যায়নের কোনও সুযোগ ফস্কে গেল কি না, সে প্রশ্ন জাগতেই পারে পাঠকের মনে। বিশেষত সঙ্কটসঙ্কুল অসম চুক্তি বা বিতর্কিত শ্রীলঙ্কা চুক্তি সঙ্কট বা বিতর্কের পরিসরটি যেন পুরোপুরি ফুটল না, মনে হতে পারে। দু’-একটি প্রমাদও পাঠককে চিন্তায় ফেলতে পারে, যেমন বইয়ের একেবারে শুরুতে ফুটনোটে রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি-কে উপন্যাস বলে উল্লেখ করা।

দি আনডায়িং লাইট: আ পার্সোনাল হিস্ট্রি অব ইনডিপেন্ডেন্ট ইন্ডিয়া

গোপালকৃষ্ণ গান্ধী

৯৯৯.০০

আলেফ

আবার, লেখকের নিজস্বতার দর্পণই ফুটিয়ে তোলে ভারতের দুই নায়কসম চরিত্রের অসামান্যতাকে, সি রাজাগোপালাচারি এবং জয়প্রকাশ নারায়ণ। মাতামহ বিষয়ে লেখকের আলাদা সমীহবন্ধন। ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হয়েছিলেন মাতামহ, ২০০৫ সালে সেই এক আসনে আসীন হন দৌহিত্র নিজে। স্বাধীনতার পর হায়দরাবাদ সংক্রান্ত সঙ্কটের সময় হায়দরাবাদের বিক্ষোভ-উদ্দীপ্ত মুসলমান সমাজের সামনে রাজাজি স্পষ্ট সাহসে বলেছিলেন, বিদেশি শাসনের শৃঙ্খল কেটে ফেলে ভারত অবশেষে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, নিজের আত্মার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, এমন সময়ে কোনও অঞ্চলের আলাদা হয়ে যাওয়ার প্রয়াসের মধ্যে মোটেই দায়িত্ববোধের পরিচয় থাকতে পারে না।— দৌহিত্রের মন্তব্য: “আ ক্লিয়ারার মেসেজ কুড নট হ্যাভ বিন গিভন। ইট ওয়াজ় নট দ্যাট অব আ ভিক্টর, বাট অব আ মেন্টর।” জয়ীর ভাষা নয়, একান্ত পরামর্শদাতার ভাষা।

আবার, তাঁর নিজস্ব হিরো জয়প্রকাশ নারায়ণের যে ছবি ফুটিয়ে তোলেন তিনি, সেও ভারী দুর্লভ। জেপি-কে তিনি বলেন জওহরলাল নেহরুর যোগ্যতম উত্তরাধিকারী, যদিও নেহরুর নেতৃত্বের মধ্যে সমাজতন্ত্রের ভাগটা কম পড়েছে মনে করে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ ছিলেন জেপি। সেই জেপি-কে যখন জরুরি অবস্থার সময়ে ভোর তিনটেয় বাড়ি থেকে উঠিয়ে গ্রেফতার করে জেলে পুরছে ইন্দিরা গান্ধীর পুলিশ, বিড়বিড় করে তিনি উচ্চারণ করেন “বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি…”! বিনাশকালই বটে। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের সমূহ পরাজয় স্মরণীয়। সেই নির্বাচনের পর যখন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বিহারের এক গ্রামে দেখা হয় জেপি-র, বন্ধুকন্যাকে আশীর্বাদ করে ‘ব্রাইট ফিউচার’ কামনা করেন তিনি। এ দিকে জেপি-র শেষ অসুস্থতার সময়ে এক বারও তাঁর সঙ্গে দেখা না করে বা কোনও সংবাদও না নিয়ে ‘শোকাকুল’ (‘চিফ মোর্নার’) ইন্দিরা তাঁর মৃত্যুর পর শেষকৃত্যে পৌঁছে গেলেন সব প্রচার-আলোর সামনে, পাশে সঞ্জয় গান্ধী। সেই সময়ে জেপি-র এক সমর্থক আক্রমণাত্মক কিছু বলার চেষ্টা করলে অন্যরা তাঁকে তৎক্ষণাৎ থামিয়ে দিলেন, কেননা ‘দে হ্যাড বিন স্কুলড ইন নন-ভায়োলেন্স’। কী চোখে জেপি-কে দেখতেন গোপাল গান্ধী, এই ছোট বাক্যেই স্পষ্ট। ২০০৫ সালে যখন বিহারে জেপি-র বাড়ি দেখতে গেলেন তিনি, যেন তাঁর তীর্থযাত্রা (‘পিলগ্রিমেজ’) সারা হল।

বইটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য, উচ্চতম সাংবিধানিক পদে আসীন থেকে দেশের রাজনীতির পর্যবেক্ষণ। গণতন্ত্রের দেশে ক্ষমতার দায় ও সীমা দুই-ই এই পর্যবেক্ষণে গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে ফুটে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল পদ থেকে তাঁর সরে যাওয়ার— বা, তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার— ঘটনাটি যে নিরাসক্তির সঙ্গে তিনি বলেন, বুঝতে অসুবিধে হয় না সেই নিরাসক্তি তাঁর লিখনেই শুধু নয়, তাঁর মননেও আমূল প্রোথিত। ব্যক্তিস্বভাবের মৃদুতা ও ভদ্রতার সঙ্গে সেখানে মিশে যায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি অতল সম্মানবোধ। আবার পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রাম অধ্যায়ে তাঁর দৃঢ়তার প্রদর্শনও সেই সম্মানবোধ থেকেই নিঃসৃত। রাজাজির রাজ্যপাল-ভূমিকার কথা স্মরণ করে গোপাল গান্ধী বলেন, রাজ্যপালের ক্ষমতা সংবিধানমতেই সীমিত, কিন্তু নৈতিক ক্ষমতাবলে কিছু অবস্থান নেওয়ার স্বাধীনতা সেখানেও আছে বইকি। অসাধারণ স্পষ্টতায় বুঝিয়ে দেন কঠিন বিষয়টি: “রাজ্যপালকে নিরপেক্ষ হতে হয়, নিরপেক্ষ হিসেবে নিজেকে দেখাতে হয়। সে কাজটা কঠিন হয় না যখন কালো আর সাদার মাঝে অনেকটা ধূসর জায়গা থাকে। কিন্তু সেই ধূসর জায়গাটা যদি না-ই থাকে, কালো আর সাদা যদি একেবারে পাশাপাশি প্রবল ভাবে উপস্থিত হয়, তা হলে নিরপেক্ষতা কেবল অবাঞ্ছনীয় নয়, অন্যায়! তাই নন্দীগ্রামে পুলিশ গুলি চালিয়ে নরহত্যা করেছে জেনে শীতল আতঙ্কের স্রোত নেমে এল আমার শরীর জুড়ে, ওই সন্ধেতেই আমি প্রেস স্টেটমেন্ট দিলাম।”

সাত দশকের চিত্তাকর্ষক ইতিহাসে কত নায়ক-নায়িকা, পার্শ্বচরিত্র। তবু সবটাকে বেঁধে রাখেন কিন্তু পিতামহই, কেননা ভারতবর্ষ শেষ পর্যন্ত ‘দ্য ল্যান্ড অব গান্ধী’। গান্ধীর আদর্শ সেই ভারতে নীতিতে রূপায়িত হল না ঠিকই, কিন্তু তবু সম্মানিত দিগদর্শন হিসেবে বিরাজমান রইল। বইটি শুরু হয় স্বাধীনতার আগে সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রচণ্ডতা ও গান্ধীর হত্যা দিয়ে। মনে হয়, লেখকের বড় ভাই রামচন্দ্র গান্ধীর কথাটাই ফুটিয়ে তুলতে চান গোপাল গান্ধী— “মহাত্মাই সে দিন রক্তলোলুপ হিংসাকে থামিয়ে দিয়েছিলেন, রক্তলোলুপ হিংসা মহাত্মাকে পরাভূত করতে পারেনি।”

তার পর অনেক দশক হেঁটেছি আমরা, এই ভারতে। ওই হিংসার ছায়া কি আবারও এ দেশে গভীর আঁধার ঘনিয়ে তুলছে? শেষে এসে গোপাল গান্ধী অন্ধকারের কথাই বলেন, কিন্তু সঙ্গে এও বলেন যে আলো নিবু-নিবু হলেও ফিরে আসবেই— “ইন্ডিয়া’জ় লাইট ক্যান ডিম, ইট ক্যানট, উইল নট ডাই।” আশাবাদের মাত্রাটা কি একটু বেশিই? কে বলতে পারে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

mahatma gandhi

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy