কারবালার যুদ্ধে হাসান ও হোসেনের মৃত্যু আদতে শিয়া মুসলমানের ধর্মের প্রশ্ন। আজও প্রধানত ইরানে তাঁদের শহিদ হওয়ার ইতিহাস বিরাট মাপে যাত্রা, গান, এবং নাটক দিয়ে উদ্যাপিত হয় (এই অনুষ্ঠানকেই ইরানে ‘তাজিয়া’ বলা হয়; মহরমের মিছিলের সমাধির কাঠামোর নাম তাজিয়া দেওয়া একান্তই ভারতীয়)। বাংলা তথা ভারতের অধিকাংশ মুসলমান সুন্নি— যাঁরা প্রথাগত ভাবে রাজনৈতিক এবং ধার্মিক দুই কারণেই হাসান-হোসেন এবং শহিদত্বের উপাসনার ঘোর বিরোধী। অথচ সুন্নি মুসলমান বাঙালির মনে, খানিকটা আশ্চর্য ভাবেই, কারবালার যুদ্ধ এবং মহরমের প্রভাব গভীর। এমনকি হিন্দু বাঙালির চেতনা থেকে, এই দুর্দিনেও, জারিগানের তুফান এবং কারবালার করুণ কাঁদন একেবারে মুছে যায়নি: ঈপ্সিতা হালদার এই বইটি শুরু করেছেন ছোটবেলায় বাবার মুখে কারবালার গল্প শুনে কান্নার স্মৃতি দিয়ে। এই অভিজ্ঞতা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অনেকেরই আছে, তাই প্রশ্নটা থেকে যায়: কেমন করে শিয়া ধর্মাচরণের উৎস থেকে বাংলায় কারবালার কাহিনি এমন নতুন পরিচিতি পেল?
এই গভীর গবেষণালব্ধ এবং সুপাঠ্য বইটি এই ঐতিহাসিক পরিবর্তনটি সুনিপুণ ভাবে বিশ্লেষণ করেছে। বইয়ের নাম রিক্লেমিং কারবালা, ‘রিক্লেম’ অর্থে পুনরুদ্ধার। পুনঃ, কারণ বাঙালি মুসলমান কারবালার কাহিনির মধ্যে নতুন অর্থ সঞ্চারিত করে। বিশেষত উনিশ শতক থেকে বাংলার শিক্ষিত সুন্নি মুসলমান সমাজ কারবালার কাহিনি থেকে সুন্নি-বিরোধী শহিদ-উপাসনার অংশটি বাদ দিয়ে হাসান-হোসেনের কাহিনিটিকে একটি সাহিত্যের রূপক— ইংরেজিতে ‘ট্রোপ’— হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে, এবং সেই সাহিত্য কাজে লাগে বাঙালি মুসলমান জাতির সাংস্কৃতিক পরিচিতি নির্মাণ করতে। অর্থাৎ শিয়া মতে হোসেন-কেন্দ্রিক ধর্মাচরণ নয়, বাঙালির কাছে কারবালার মূল গুরুত্ব কাহিনি হিসেবে। এই কাহিনি বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যকীর্তি এবং জাতীয়তাবাদে গভীর ভাবে জড়িয়ে।
ঈপ্সিতা তাঁর কাহিনি শুরু করেছেন সতেরো শতকের শেষভাগ ও আঠারো শতকের আরবি-ফারসি মিশ্রিত ‘দোভাষী’ বাংলা পুঁথির বিশ্লেষণ করে: কথকতা থেকে লেখনীতে পরিবর্তিত হওয়ার সময় থেকেই কারবালার রূপকের বদল আসতে শুরু করে। বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসচর্চায় সাধারণত একটা আধুনিক/প্রাক্-আধুনিক ভাগ আছে, ১৮০০ সালের এ পারের গবেষকরা ও পারে যেতে চান না। লেখক সেই বেড়া ভেঙে দীর্ঘকালীন সুফি সাধনার ইতিহাস দেখিয়েছেন, অগুনতি কারবালা-বিষয়ক পুঁথি এবং উনিশ শতকের মুদ্রিত বইয়ের হদিস দিয়ে। কেবল এই সব লেখাকে গবেষণার আলোয় আনাই এক বিরাট অবদান।
রিক্লেমিং কারবালা: নেশন, ইসলাম অ্যান্ড লিটারেচার অব দ্য বেঙ্গলি মুসলিমস
ঈপ্সিতা হালদার
৪২.৯৯ পাউন্ড
রাটলেজ
পরের অধ্যায়ে দেখি, ১৮৬০ সালের পর থেকে বাংলার সুন্নি সংস্কারকরা স্পষ্ট ভাবে হোসেন-উপাসনার বিরোধিতা করতে থাকেন নিজেদের বই ছাপিয়ে। এঁরা অনেকেই অষ্টাদশ শতকের দিল্লির সুন্নি চিন্তক শাহ ওয়ালিউল্লাহ-র অনুগামী, এবং ইসলামের ইতিহাসে (সুন্নি) খলিফা এবং (শিয়া) ইমামের দ্বন্দ্বে না ঢুকে এঁদের উদ্দেশ্য ছিল হাসান-হোসেন যে মহম্মদের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত (আহলে বয়েৎ), সেই কথাটা বড় করে দেখানো। এত জোর করে এই ঝগড়া করতে হয়েছিল তার প্রধান কারণ হল তখন অবধি, এবং তার পরেও, সাধারণ বাঙালি মুসলমানের ধর্মজীবনে পির-সুফি-ইমাম অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে ছিল। গোঁড়া সুন্নিরা এই সমস্ত প্রশ্রয় না দিয়ে মহম্মদের জীবন ও পরিবারে জোর দেন, এবং সেখানে কারবালার দুই শহিদের স্থান পোক্ত করেন।
বইটির দ্বিতীয়ার্ধ দেখায়, কী ভাবে আধুনিক মুসলমান বাঙালি সাহিত্যিকরা হাসান-হোসেনের এই রূপকে গল্প-কবিতা-উপন্যাসে অমরত্ব প্রদান করেন, এবং সেই সাহিত্যকে নিজেদের জাতিসত্তা নির্মাণে ব্যবহার করেন। ধর্ম ও জাতীয়তার সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করলেও তাঁরা বরাবরই বাংলা ভাষাতেই ইসলামি কাহিনি প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেন; তার পর উনিশ শতকের শেষের দিকের ‘হিন্দু’ জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করে আলাদা মুসলিম সাহিত্যের ভাষ্য গড়ে ওঠে। এটা স্পষ্ট হয় ইসলামি জীবনী এবং চরিত্রের লেখা নিয়ে, এবং ঈপ্সিতা এখানে ব্রাহ্ম কোরান-অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের ভূমিকার চমৎকার আলোচনা করেছেন। শেষ অধ্যায়ে ভাষার প্রশ্নটি আরও স্পষ্ট: মীর মশাররফ হোসেন ও আব্দুল বারির লেখা তৎসম সাধুভাষায় বলে কলকাতার সমাজে কদর পায়; তবে বিশ শতকে ‘জাতীয় সাহিত্য’ নিয়ে জটিলতর প্রশ্ন উঠতে শুরু করে ‘মিশ্র’ বাংলায় আরবি-ফারসি শব্দ নিয়ে, যা দেখা যায় নজরুল, জসীমউদ্দীন, এবং সর্বোপরি কায়কোবাদের কাব্য নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনায়। বই শেষ হয় বিশ শতকের প্রথম ভাগেই— দেশভাগ তখনও প্রায় তিন দশক দূরে।
বইটির মূল অবদান বাংলার সাহিত্য এবং রাজনীতিতে কারবালা-কাহিনির বৈশিষ্ট্য ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা। কারবালার ইতিহাস পৃথিবী-বিখ্যাত; কিন্তু বাঙালির কারবালা-সাহিত্য যে কী ভাবে তার নিজস্ব, তার স্পষ্ট বিশ্লেষণ এত দিন অধরা ছিল। আশ্চর্য নয় যে বাংলার গবেষক-মহলের বাইরেও বইটি আগ্রহের সঙ্গে পড়া হয়েছে, এবং সম্প্রতি ইরান থেকে আন্তর্জাতিক বইয়ের জন্য একটি পুরস্কারও পেয়েছে। মুসলমান বাঙালির জাতিচেতনা নিয়ে লেনার্ড গর্ডন, রফিউদ্দিন আহমেদ, সেমন্তী ঘোষ, নীলেশ বসু প্রমুখের বইয়ের সঙ্গে এই বইটির কাব্যচেতনা এবং গভীর সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি এক বিশেষ স্থান পাবে। সর্বোপরি, দু’শো বছরের উপর কারবালা-বিষয়ক অগুনতি বাংলা লেখা সংগ্রহ করে তার ঐতিহাসিক বিবর্তন বোঝা প্রায় অসাধ্য সাধন, এবং এই কাজ বাংলার সাহিত্য ও ধর্মের গবেষকদের কাছে বহুদিন অত্যন্ত উপযোগী হয়ে থাকবে।
তবে ফিরে যেতে চাই গোড়ার কথায়, যেখানে লেখক কারবালার কাহিনি শুনে কান্নার কথা দিয়ে বই শুরু করেছিলেন। আমার কাছে এই ব্যক্তিগত কাহিনিটি মূল্যবান— কারণ কাল অতিক্রম করে কারবালার আবেগ এবং অনুভূতির জোর এখানে স্পষ্ট। বইটিতে জাতীয়তা এবং দেশ নিয়ে আলোচনার ফাঁকে এই অনুভূতির ইতিহাসটি কিছুটা যেন হারিয়ে গেল। হয়তো হিন্দু-মুসলমান এবং শিয়া-সুন্নির বিবাদ থেকে সরে এসে আবেগ এবং অনুভূতির সাংস্কৃতিক ইতিহাস ধরে রাখা জরুরি ছিল। ওয়ালিউল্লাহ-পন্থীদের হাজার সমালোচনা সত্ত্বেও, শহিদত্ব এবং করুণা নিয়ে আবেগের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েই যায়। উনিশ শতকের শেষ থেকে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বুঝতে লেখক দ্বন্দ্ব এবং বিবাদের চেনা গল্পে জোর দিয়েছেন। উনিশ শতকের অনেক ইতিহাসেরই এটা একটা বৈশিষ্ট্য, তাঁরা ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান ভাগ, এবং ভাষার ভিত্তিতে ১৯৭১ সালের পাকিস্তান-বাংলাদেশ ভাগটা মাথায় রেখেই পুরনো শতকটি দেখতে শুরু করেন। এই ছকের বাইরে যাওয়া সহজ নয়। কিন্তু কারবালার কাহিনি এখানেই একটা বড় সুযোগ দেয়, কারণ তার প্রসার মুসলমান রাজনীতির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়।
ভাবা যেতেই পারে, কারবালার কাহিনি নিয়ে আগ্রহ, শিয়া-সুন্নি গণ্ডি অতিক্রম করে তো বটেই, হিন্দুদের মধ্যেও, কী ভাবে ছিল? করুণ রসের মহাকাব্যিক মিল হিন্দুরও আছে, মুসলমানেরও আছে। লেখক এই বইয়েই দেখিয়েছেন সতেরো শতকের সৈয়দ সুলতানের কাব্যে বাংলা মহাভারতের প্রভাব ছিল (৪০-৪১)। এই বিশ্লেষণিক দৃষ্টি নিয়ে দেখলে কারবালা নিয়ে আধুনিক লেখাগুলিও নতুন অর্থ পায়। উনিশ শতকে বীররস এবং করুণরসের সেই সমস্ত উপাদান মুছে যায়নি, ধর্মীয় গণ্ডিতেও আবদ্ধ থাকেনি; সাধু এবং মিশ্র ভাষা নিয়ে বিবাদ অতিক্রম করে শ্রেষ্ঠ মুসলমান সাহিত্যিকরা এই বৃহত্তর সত্যটি বুঝেছিলেন। সেখানেই হয়তো বাংলার কারবালা-ক্রন্দনের প্রকৃত সার্থকতা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)