উন্নয়নের অর্থনীতির গবেষণার জগতে র্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোল ট্রায়াল-এর (আরসিটি) ধারা প্রবেশ করে গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে। মাইকেল ক্রেমার কেনিয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করার ফলাফল নিয়ে পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে প্রথম এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন। উন্নয়নের অর্থনীতির জগতে আরও অনেক প্রশ্নের উত্তরে এই পদ্ধতির ব্যবহারের প্রতিশ্রুতিময় সম্ভাবনা উপলব্ধি করে তিনি, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার দুফ্লো পরের দু’দশকে এই পদ্ধতির ব্যবহার ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে নেতৃত্ব দেন, যার স্বীকৃতি আসে ২০১৯ সালে তাঁদের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে।
তাঁদের নেতৃত্বে যাঁরা এই পদ্ধতির ব্যবহার করা শুরু করেন তাঁদের প্রথম প্রজন্মের গবেষকদের মধ্যে ক্রেমারের অধীনে পিএইচ ডি সম্পন্ন করা কার্তিক মুরলীধরন উল্লেখযোগ্য। ভারতে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মূল্যায়নে আরসিটি-র ব্যবহারে তিনি এক জন অগ্রণী গবেষক। আলোচ্য গ্রন্থটি আয়তন এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা দুই দিক থেকেই বৃহৎ একটি প্রয়াস। টিকা এবং তথ্যসূত্র বাদ দিলেও ছ’শো পাতার এই বইটি কিন্তু অতীব পাঠযোগ্য। তিন ধরনের পাঠক এটি পড়তে পারেন— যাঁরা স্বাধীন ভারতের উন্নয়নের যাত্রাপথের একটি সহজপাঠ্য এবং তথ্যসমৃদ্ধ বিবরণ পড়তে চান; যাঁরা ভারতকে উদাহরণ হিসাবে ধরে যে কোনও উন্নয়নশীল দেশের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের সামর্থ্যের ভূমিকা এবং সেখানে রাজনীতি, প্রশাসন এবং আইনব্যবস্থার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তা বৃহত্তর অর্থনীতির উপর কী প্রভাব ফেলে তা নিয়ে জানতে ইচ্ছুক; এবং উন্নয়নের অর্থনীতির গবেষণায় গত দুই দশকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা এবং কর্মসংস্থান প্রকল্পের মতো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলির ক্ষেত্রে প্রশাসনব্যবস্থার সার্বিক দক্ষতা এবং দায়বদ্ধতা কী করে বাড়ানো যায় তা নিয়ে আরসিটি-ভিত্তিক গবেষণা নতুন কী আলোকপাত করেছে তা যাঁরা জানতে চান।
কার্তিকের সাবলীল লেখনীতে এই তিনটি দিক থেকেই বইটি স্বচ্ছন্দে এবং সমান্তরাল ভাবে পড়ে যাওয়া যায়। বইটি শুরু হয়েছে সরকারি নানা পরিষেবা, প্রকল্প এবং প্রশাসনিক পরিকাঠামোর নানা সমস্যা কী ভাবে ভারতের উন্নয়নের গতিকে শ্লথ করে দেয় সেই আলোচনা দিয়ে। তার পরে আলোচনা করা হয়েছে, রাজনীতিক এবং প্রশাসকদের উদ্দেশ্য এবং বাধ্যবাধকতাগুলো কী ভাবে আলাদা এবং তার ফলে সরকারি নীতি ও প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা ও প্রয়োগে কী কী সমস্যার সৃষ্টি হয় তা নিয়ে। এই অংশটিতে রাজনীতিক ও আমলাদের প্রণোদনা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চ্যালেঞ্জগুলি তুলে ধরা হয়েছে। রাজনীতিকরা প্রায়শই সংক্ষিপ্ত নির্বাচনী চক্রে কাজ করেন, যা সব সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে না। অন্য দিকে, পর্যাপ্ত সম্পদ ছাড়াই কাজ করার জন্য আমলাতন্ত্রগুলিকে চাপ দেওয়া হয়। ভারতীয় রাষ্ট্রের উপমা হিসাবে মুরলীধরন পঞ্চাশের দশকের অ্যাম্বাসেডর গাড়ির উদাহরণ ব্যবহার করেছেন, যেখানে রাজনীতিকরা চালক এবং আমলারা ইঞ্জিন, এবং পুরনো লজ্ঝড়ে গাড়িতে যাত্রীর সংখ্যা বাড়তেই থাকছে।
অ্যাক্সিলারেটিং ইন্ডিয়া’জ় ডেভলপমেন্ট: আ স্টেট-লেড রোডম্যাপ ফর এফেক্টিভ গভর্ন্যান্স
কার্তিক মুরলীধরন
১২৯৯.০০ পেঙ্গুইন ভাইকিং
তার পরের অংশে প্রশাসনব্যবস্থার নানা দিক ধরে আলোচনা করা হয়েছে খানিকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবচ্ছেদ করে দেখার মতো করে, যার মধ্যে ছ’টি পরিচ্ছেদে ভাগ করে আলোচনা আছে পরিসংখ্যান এবং ফলাফলের পরিমাপ, কর্মী পরিচালনা, সরকারি ব্যয় এবং রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভালমন্দ নানা দিক, এবং রাষ্ট্র বনাম বাজারের ভূমিকা। বইটির প্রথম অর্ধে যে মূল তাত্ত্বিক কাঠামোটি বর্ণনা করা হয়েছে, দ্বিতীয় অর্ধে তা প্রয়োগ করা হয়েছে ভারতের ক্ষেত্রে প্রশাসনের বিভিন্ন দিক (যেমন, আইন ও সুরক্ষাব্যবস্থা) এবং সামাজিক প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলির (যথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা এবং কর্মসংস্থান) সমস্যাগুলোর উপর আলোকপাত করতে। তার মধ্যে অনুন্নত দেশে সম্পদের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও মানব উন্নয়ন সূচকগুলোর (যেমন, গড় আয়ু, সাক্ষরতার হার) মান কী ভাবে প্রযুক্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে বাড়ানো যায় সেই নিয়ে গবেষণালব্ধ তথ্যপ্রমাণ নিয়ে মূল্যবান আলোচনা আছে। বইটি শেষ হচ্ছে রাষ্ট্র, নাগরিক এবং সমাজ যে প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামোয় প্রোথিত, তাকে নতুন করে ভাবার কিছু দিঙ্নির্দেশ নিয়ে আলোচনায়।
যে মূল ধারণাটির উপর বইটির কাঠামোটি দাঁড়িয়ে আছে তা হল, সরকারের কোন ক্ষেত্রে ব্যয় করা উচিত, কোন দিকগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত তা নিয়ে মতবিরোধ থাকতেই পারে। কিন্তু লক্ষ্য যা-ই হোক, তা সাধন করা যাবে কী করে? আর্থিক ও প্রশাসনিক সাধ্য আর লক্ষ্যের মধ্যে যে ফারাক, কী ভাবে তা কমানো যায়? লক্ষ্য আর তার মাপকাঠি যা-ই হোক, উন্নত প্রশাসনব্যবস্থায় বিনিয়োগ করলে প্রচলিত ব্যবস্থা বহাল রেখে তার মধ্যে ব্যয় বাড়িয়ে যাওয়ার থেকে প্রাপ্তির হার অনেক বেশি হবে। কত বেশি? কার্তিক বলছেন, এ রকম বিনিয়োগের ফলে আর্থিক সাশ্রয়ের হার অনেক গুণ হতে পারে। তিনি এই উদাহরণটি দিয়েছেন: তেলঙ্গানার রাইথু বন্ধু প্রকল্প যা কৃষকদের প্রতি উদ্দিষ্ট একটি অর্থ-অনুদান প্রকল্প এবং যার বার্ষিক বাজেট দশ হাজার কোটি টাকা। একটি কল সেন্টারের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে খোঁজ নেওয়া হয়, তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য অর্থ পেয়েছেন কি না এবং এ রকম খোঁজ যে নেওয়া হবে (অবশ্যই যদৃচ্ছ ভাবে) তা ব্লক স্তরের সরকারি কর্মচারীদের অবহিত করা হয়। কার্তিক হিসাব করে দেখাচ্ছেন যে, এই কল সেন্টারের উপর ব্যয় করা প্রতি টাকায় কৃষকদের প্রাপ্য অর্থের প্রাপ্তি বাড়ছে প্রায় ২৫ টাকা। অন্ধ্রপ্রদেশে জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পের মজুরি প্রদানের জন্য বায়োমেট্রিক প্রমাণীকরণ ব্যবস্থা থেকে অনুরূপ ফলাফল পাওয়া গেছে। তাঁর বইয়ে আরও একটি উদাহরণ হল, গ্রামীণ সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অনুপস্থিতির ফলে সরকারি রাজস্ব খাতে যে দশ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়, তা কমাতে তত্ত্বাবধায়ক পদ পূরণে বিনিয়োগ করলে তাতে উল্লেখযোগ্য রকম সাশ্রয় হয়।
বইটির মূল বক্তব্য চিন্তাশীল এবং মতাদর্শগত গোঁড়ামিমুক্ত পাঠককে ভাবাবে। তবু, কিছু প্রশ্ন ও উদ্বেগ থেকে যায়। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের রূপায়ণ ও বাস্তবায়নে প্রযুক্তির ভূমিকা আছে নিশ্চয়ই, এবং সরকারি ও বেসরকারি সমস্ত সংস্থাতেই বিভিন্ন স্তরের কর্মীকে কী ভাবে প্রণোদিত করা যায়, তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু শুধু প্রযুক্তি-পরিচালনার কাচ দিয়ে সমস্যাটা দেখার বেশ কতকগুলো সমস্যা আছে। প্রথমত, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জগতে বিত্তবান ও দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে ক্ষমতার যে মৌলিক দ্বন্দ্ব আছে, এবং রাজনীতিক, প্রশাসক আর অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে যে একটা পারস্পরিক পৃষ্ঠপোষকতার সম্পর্ক আছে যা উন্নয়নমূলক নীতি ও প্রকল্পগুলির বাস্তবায়নে প্রতিফলিত হয়, এই রূঢ় বাস্তব পুরোপুরি এড়ানো যায় না। যেমন, নারেগা-র ফলে সাধারণ ভাবে কৃষিশ্রমিকদের মজুরি বাড়ে (কার্তিকের কাজেই তা নিয়ে তথ্যপ্রমাণ আছে) এবং তাই কৃষকের একটা বড় অংশ (গ্রামীণ রাজনীতিতে যাঁদের প্রভাব অপরিসীম) তার প্রতি খুব সদর্থক মনোভাব পোষণ করেন না, এবং তার বাস্তবায়নে খুব উৎসাহী হবেন না সেটা আন্দাজ করা শক্ত নয়। তাই যা আপাতদৃষ্টিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের জড়তা মনে হচ্ছে তা আসলে একটা ভারসাম্যবিন্দু এবং তাই সেটাকে নাড়া দিতে শুধু প্রযুক্তি ও প্রণোদনার ব্যবহারের ফলাফল সীমিত হতে বাধ্য, এই যুক্তিটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত, আরসিটি ব্যবহার করে কোনও প্রকল্পের পরিকল্পনা পাল্টালে লাভ হওয়ার সম্ভাবনা যদি জানাও যায়, সমীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেই সংস্কারগুলো সরকার চালু করবে কি না এবং সেগুলো বহাল থাকবে কি না বা তজ্জনিত যে আর্থিক সাশ্রয় তা দরিদ্র শ্রেণির কাছে অন্য কোনও রূপে পৌঁছবে, না কি সরকারি রাজস্বব্যবস্থার কৃষ্ণগহ্বরে তলিয়ে যাবে, সেগুলো মূলত রাজনৈতিক প্রশ্ন।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের সক্ষমতা ভাল বা খারাপ, দু’ভাবেই ব্যবহার হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দুর্নীতি হ্রাস করা একটি প্রশংসনীয় লক্ষ্য, কিন্তু যে প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থার কলকব্জাগুলোর উন্নতিসাধন করা হবে, তা সমাজকল্যাণের লক্ষ্যে ব্যবহৃত হবে না কি নাগরিকদের উপরে নিয়ন্ত্রণের ফাঁস আরও কঠিন হবে, এটাও শেষ বিচারে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি কতটা শক্ত তার উপর নির্ভর করবে।
আসলে নড়বড়ে গাড়িতে নতুন সিট বসালে একটু আরাম হতে পারে, কিন্তু মূল সমস্যা লাঘব হবে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)