Advertisement
১৫ অক্টোবর ২০২৪
Lina Chaki Books

অনালোচিত ও বিস্মৃতের সন্ধান

বাংলা কিন্তু আঁকড়ে থাকল গৌরকে। তাই পুরীতে এমন ঘটনার পরেও পরে এক সময় ষড়ভুজ গৌরাঙ্গের পাশে বিষ্ণুপ্রিয়ার বিগ্রহ স্থান পেতে পারল। স্থান পেলেন লক্ষ্মীপ্রিয়াও।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

অলখ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:৩৭
Share: Save:

‘রাধাভাবদ্যুতিসুবলিততনু’ চৈতন্য নারীসঙ্গ থেকে বরাবর সযত্ন দূরত্ব রক্ষা করেছেন। তা এমনই ছিল যে, বাসুদেব সার্বভৌমের শিষ্য শিখি ও মুরারি মাহিতির ভগিনী বৃদ্ধা মাধবী মহিলা হওয়ায়, তাঁর বাড়ি থেকে চাল নিয়ে এসে রান্না করাও সহ্য করেননি চৈতন্য। ছোট হরিদাসের জন্য দ্বাররুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। তার ফল হয়েছিল মারাত্মক। ছোট হরিদাস আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই অভিঘাতে একটি অশরীরীর কাহিনি পর্যন্ত তার পরে যোগ করতে হয় চৈতন্যচরিতে। অথচ, মাধবীকে পূর্বজন্মে রাধার দাসীমধ্যে গণনা করা হয়েছে, তিনি চৈতন্যেরই সাড়ে তিন জন মর্মী ভক্তের অর্ধজন এবং তিনি সংস্কৃতে পুরুষোত্তমদেব নাটক রচনা করেছিলেন।

বাংলা কিন্তু আঁকড়ে থাকল গৌরকে। তাই পুরীতে এমন ঘটনার পরেও পরে এক সময় ষড়ভুজ গৌরাঙ্গের পাশে বিষ্ণুপ্রিয়ার বিগ্রহ স্থান পেতে পারল। স্থান পেলেন লক্ষ্মীপ্রিয়াও। সেই আবহে জগদীশ পণ্ডিতের স্ত্রী— তিনিও তখন প্রবীণা— দুঃখিনী দেবীর সঙ্গে চৈতন্য দেখা করেছিলেন বলেও অনেকে বিশ্বাস করেন। নিজেকে ঈশ্বর বলতে যাঁর তীব্র আপত্তি ছিল, সেই তিনিই গৌরগোপাল মূর্তি নির্মাণের কথা ও সেই বিগ্রহে নিত্য অবস্থানের কথা তখন সেই প্রবীণাকে বলেছিলেন, এমনও বলা হল একটি জীবনীগ্রন্থে। তাই বৈষ্ণবীদের সঙ্গে চৈতন্য ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের সম্পর্ক কী ভাবে বদলেছিল, বিশেষ করে চৈতন্যভাবনা ও গৌরভাবনা কেমন করে একে অপরকে প্রভাবিত করল, এই বৈষ্ণবীরা কালানুক্রমিক ভাবে কী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। দুই মলাটের মধ্যে সে কথা আলোচনা করেছেন লীনা চাকী। বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি ক্ষেত্রসমীক্ষা করে সেই সুমহৎ ভার বহন করেছেন তিনি। যে গ্রন্থগুলি তাঁকে ব্যবহার করতে হয়েছে, তার মধ্যে আকর গ্রন্থগুলি ছাড়াও এমন জীবনী রয়েছে, যার কিছু গবেষকেরা তেমন গ্রাহ্য করেন না। কিন্তু সেগুলিতেও কাজের কথা কিছু রয়েছে বইকি। বাংলার নানা গ্রামে ছড়িয়ে থাকা বৈষ্ণব ধর্মস্থানগুলির মৌখিক ইতিহাসের ক্ষেত্রেও বইটি গুরুত্বপূর্ণ।

বৈষ্ণবীদের খোঁজে

লীনা চাকী

৪০০.০০

পুস্তক বিপণি

লীনা শুরু করেছেন শচী, বিষ্ণুপ্রিয়াকে দিয়ে। তবে তাঁর অনুসন্ধান থেকে বোঝা যাচ্ছে, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে যে মহিলাদের কথা বেশি উঠে আসছে, তাঁদের সঙ্গে নিত্যানন্দের সম্পর্কই বেশি গভীর। তাঁরা নিত্যানন্দের মতোই সঙ্ঘ নির্মাণে বেশি জোর দিয়েছিলেন। যেমন দ্বাদশ গোপাল ও উপগোপাল হল, তেমনই এই বিদুষী মহিলাদেরও উপযুক্ত শিষ্য তৈরিতে ঝোঁক ছিল। এই কাজ করতে গিয়ে তাই লীনাকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের নানা মতের ধারাকে অনুপুঙ্খ ভাবে বিচার করতে হয়েছে। সে বড় সহজ কথা নয়। চৈতন্য কী চেয়েছিলেন সে আলাদা কথা, গৌর-বিষ্ণুপ্রিয়া তত্ত্বের মতো একাধিক নতুন মত যে তৈরি হতে পারল ও থাকল, তাতে কয়েক জন নারীও গুরুর সম্মান লাভ করেছিলেন। তাঁরা বংশপরম্পরায় রক্ষা করতে চেয়েছিলেন কিছু বিগ্রহ।

সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি জাহ্নবা, শ্রীনিবাস-কন্যা হেমলতা, যবনী মালিনী, বসুধা-কন্যা গঙ্গা ও শ্যামাদাসী কৃষ্ণপ্রিয়া ঈশ্বরীপ্রিয়া গৌরাঙ্গপ্রিয়াদের মতো প্রায়-বিস্মৃত বৈষ্ণবীরা, যাঁদের কথা কোনও কোনও মতের অনুগামীদের মধ্যেই ধরা ও ঘেরা, জাহ্নবা ছাড়া যাঁরা প্রায় অনালোচিত। গুরুধারায় দীক্ষায় বৈষ্ণবীদের ভূমিকা, আঠারো-উনিশ শতকে শিক্ষিত বৈষ্ণবীদের কথা বেয়ে লেখিকা পৌঁছন সমকালের সেই বৈষ্ণবীদের কাছে, মাধুকরীই ভরসা যাঁদের।

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE