Advertisement
১৫ অক্টোবর ২০২৪
Book Review

বহু শতাব্দীর গীত-পরম্পরাকে পুরোপুরি চেনা হল কই

গঙ্গা-নিমন্ত্রণ বা আমবিহা-মহুলবিহার গানের উল্লেখ থাকলেও, উপেক্ষিত থাকে বিয়ের আগের দিন গাছকে জড়িয়ে ধরে সই পাতানোর ‘সইয়ালা’ বা ‘ভইনয়ালা’র গানের কথা।

বহতা: গান গাইছেন বর্ধমানের মেয়েরা, রেকর্ডারে ধরে রাখা হচ্ছে তা।

বহতা: গান গাইছেন বর্ধমানের মেয়েরা, রেকর্ডারে ধরে রাখা হচ্ছে তা।

চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৪ ০৯:১৪
Share: Save:

১৩৪০ বঙ্গাব্দের প্রবাসী পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যায় প্রকাশিত ও পরে কমল চৌধুরী সম্পাদিত ফরিদপুরের ইতিহাস গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধে ‘নলিয়া’ নামের একটি প্রাচীন গ্রাম সম্বন্ধে অজিতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, বিবাহের বহু পর্বে প্রায় এক হাজার গান গীত হয়ে থাকে ও ‘প্রায় প্রত্যেক বিবাহ অনুষ্ঠানগুলোতেই মেয়েরা নৃত্য করে থাকেন’। তিনি আরও জানান, বহু অর্থব্যয়ে গুরুসদয় দত্ত সে অনুষ্ঠানের চলচ্চিত্র করে রেখেছিলেন। সেই চলচ্চিত্রের কোনও খোঁজ পরে পাওয়া না গেলেও, বঙ্গলক্ষ্মী পত্রিকার পাতায় ‘বাংলার মেয়েদের নৃত্যগীত’, ‘পূর্ববঙ্গের বিবাহ উৎসবের নৃত্যগীত’ নামে নানা প্রবন্ধ ও শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত বইয়ে তাঁর সংগ্রহ সংরক্ষিত আছে।

গুরুসদয় দত্ত ছাড়াও নীহার বড়ুয়া, নির্মলেন্দু ভৌমিক, সুধীর কুমার করণ, চিত্তরঞ্জন দেব, সুভাষ বন্দ্যোপাধ্যায়, রেণুকা দেবী চৌধুরাণী, গোপা হেমাঙ্গী চৌধুরী, বীণা মজুমদার, প্রবাল রায়, উৎপল মুখোপাধ্যায়, গৌতম মণ্ডল, শচীন্দ্রনাথ বালা, বঙ্কিম মাহাতো, সুজিত সরকার— এমন আরও অনেক গুণিজনের নাম করা যেতে পারে যাঁরা পূর্ব বাংলা, অসমের গোয়ালপাড়া বা অন্যান্য প্রান্ত, উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি থেকে শুরু করে দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদহ হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার বিভিন্ন জনপদের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিয়ের গানের সঙ্কলন ও আলোচনা করেছেন— কখনও বইয়ে, কখনও পত্রিকায়।

বিয়ের গান নিয়ে প্রচুর কাজ ছড়িয়ে আছে নানা আঞ্চলিক পত্রিকাতেও। দিনেন্দ্র চৌধুরীর গ্রাম নগরের গান, প্রবাল রায়ের অতীতের মালদহ, শ্যামপদ মণ্ডলের বিয়ের গান-এর মতো নানা বইয়েই হিন্দু-মুসলান দুই সম্প্রদায়ের বিয়ের গানের তুলনাও করা হয়েছে বার বার। আর শক্তিনাথ ঝা, মনোয়ারা খাতুন, রত্না রশিদ, মহম্মদ আয়ুব হুসেন বা আরও যাঁরা মুসলমান মেয়েদের বিয়ের গান নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁরাও বারে বারেই উল্লেখ করেছেন দুই সম্প্রদায়ের কিছু আচার বা ভাষাগত পার্থক্যের আড়ালে অভিন্ন ঐতিহ্যের শিকড়ের কথা। তাই নতুন নয়, এক পরিচিত আলোচনাই দু’মলাটে এসেছে মালবিকা মণ্ডলের এই বইটিতে।

যথেষ্ট পরিমার্জন ছাড়া কোনও গবেষণা প্রকল্পকে বই আকারে প্রকাশ করার কিছু অসুবিধা আছে। সংজ্ঞা, স্বরূপ ইত্যাদিকে বাঙ্ময় (শব্দ তিনটির বানান হয়েছে ‘সঙ্গা’, ‘সরূপ’, ‘বাঙ্গময়’!) করতে প্রাসঙ্গিক ও তথাকথিত অপ্রাসঙ্গিক দীর্ঘ উদ্ধৃতি আর বিবরণ পেরিয়ে দুই-তিনটি গানের ভগ্নাংশের দেখা মেলে ৮৩ পৃষ্ঠা পেরিয়ে। আর মূল আলোচনা শুরু হয় ২৩০ পৃষ্ঠার পর, বিয়ের গানে সমাজতত্ত্ব, নারী-মনস্তত্ত্বের আলোচনায়। পণ-বিরোধিতা, বাল্যবিবাহ, সতিনকাঁটা, নির্যাতন আর অলঙ্কারপ্রিয়তা থেকে আধুনিক যুগে রেজিস্ট্রি বিবাহের প্রয়োজনীয়তা— চেনা বিষয় উঠে আসে সংগৃহীত গানে। সমসাময়িক ঘটনায় সাড়া দেওয়ার প্রসঙ্গে ‘গান্ধী-কাপড়’ নিয়ে একটি গানের উল্লেখ থাকলেও, ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি বা স্বদেশির আহ্বান নিয়ে যে অজস্র বিয়ের গান তৈরি হয়েছিল এক সময়, তার সন্ধান এখানে আমরা পাই না।

বিবাহগীতি: বাঙালি হিন্দু-মুসলমান সমাজ

মালবিকা মণ্ডল

৭০০.০০

অক্ষর

মেয়েদের স্বদেশভাবনার মতোই আলাদা করে আলোচিত হয় না তাঁদের পরিবেশভাবনাও। গঙ্গা-নিমন্ত্রণ বা আমবিহা-মহুলবিহার গানের উল্লেখ থাকলেও, উপেক্ষিত থাকে বিয়ের আগের দিন গাছকে জড়িয়ে ধরে সই পাতানোর ‘সইয়ালা’ বা ‘ভইনয়ালা’র গানের কথা। সর্বস্তরের সমাজ-কারিগর অর্থাৎ কামার, কুমোর, তাঁতি, মালাকার, স্বর্ণকার, ব্রাহ্মণ, ধোপা, নাপিত, জেলে, ঢাকুয়া, ঢুলিয়া, মাদলিয়া এমনকি ডোম বা ঋষিভাইদেরও সম্মান জানিয়ে তাঁদের প্রত্যেককে নিয়েই গান বাঁধেন মেয়েরা, বা উল্লেখ করেন গানে গানে। বিয়ের আনন্দের আবহে সমাজবন্ধনে মেয়েদের এই ভূমিকার কথা উল্লেখ করা দরকার। মুসলমান সম্প্রদায়ের ‘সোহাগমাগা’ গানের পাশাপাশি শ্রীহট্ট-ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রত্যেক পাড়া থেকে ‘সোহাগ’ বা আশীর্বাদ চাওয়ার গানের উল্লেখ থাকলে ভাল হত। আলপনার গান বা কুঞ্জবিয়ার ফুল ছিটানোর গানের নান্দনিকতাও এখানে অনালোচিত।

সীমিত সময়ে বিশাল পরিসরের কাজে মনোযোগের অভাব আর অন্তর্দৃষ্টির অনুপস্থিতি শুধু অনভিপ্রেতই নয়, অনুচিত। পরম্পরাধর্মী গানের একটা জন্মভূমি থাকে, থাকে কিছু জন্মচিহ্নও। মাটি, জল, হাওয়া মিশে থাকে তার সুরে আর ভাষায়, তাকে চিনে নেওয়ার আর চিনিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা গবেষকের। উত্তরের গানের সঙ্গে দক্ষিণের গানের তুলনা করতে গিয়ে লেখিকা বার বার হুগলির ব্যান্ডেল, মগরা বা নদিয়ার কল্যাণীর গানের উল্লেখ করছেন, সূত্রনির্দেশেও তা-ই লিখছেন। এক জায়গায় কথাচ্ছলে জানাচ্ছেন, আসলে এগুলি ঢাকা, ময়মনসিংহ বা ফরিদপুরের গান। রাজনৈতিক কারণে মানুষ দেশহারা হয়েছেন, গবেষকের ভুলে গানও কি শিকড়হীন হবে? বিভ্রান্ত করবে পাঠক ও ভবিষ্যতের গবেষকদের?

‘বিবাহগীতির গীদালি বা শিল্পী সম্প্রদায়’ অধ্যায়ে মৌলবাদের ভ্রুকুটির মুখোমুখি হয়েও যে শিল্পীরা তাঁদের পরম্পরাকে ধরে রেখেছেন, জনসমক্ষে নিয়ে এসেছেন, তাঁদের কয়েকজনের কথা নানা জায়গায় আলোচিত হলেও একত্র করার কাজটি প্রশংসনীয়। পাশাপাশি, দেশহারা মানুষদের কঠিন জীবনসংগ্রামের মধ্যেও দেশের গানকে যাঁরা আগলে রেখেছেন, তাঁদের কথাও জানতে পারলে ভাল হত।

কিন্তু গবেষণার উদ্দেশ্য-বিধেয় সবই গুলিয়ে যায়, যখন দেখি এই শিল্পীদের ‘আপনি’ শব্দের প্রয়োগটুকুতেও কার্পণ্য! বহু শতাব্দীর গীত-পরম্পরার ধারক, বাহক ও রক্ষক গ্রামীণ শিল্পীকে তথাকথিত ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার আছে কি না ভাবা হয় না এক বারও— যদিও গান শুনতে গিয়ে শিল্পীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করাটা সহবত শিক্ষার অভাব বলেই বিবেচিত হবে অন্য যে কোনও ক্ষেত্রে। ক্ষেত্রসমীক্ষার নামে মানুষকে অসম্মান করা হচ্ছে কি না, গোটা পৃথিবীর মতো প্রশ্ন ওঠা দরকার এখানেও। শ্রদ্ধা ও বিনয় যেন প্রাথমিক শর্ত হয় মানুষের কাছে, শিল্পীর কাছে যাওয়ার।

অন্য বিষয়গুলি:

book review Tape Recorder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE