মানসী দাশগুপ্ত (১৯২৮-২০১০) গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, বাঙালি পাঠকের অনেকেই হয়তো তা মনে করতে পারবেন না। তাঁর প্রবন্ধবইয়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ: এক অসমন্বিত দ্বন্দ্ব এবং তাঁর ভিন্ন রীতির আত্মজীবনী নানাজনের মেলায় তুমি তুলনায় বেশি পাঠক মনে করতে পারবেন। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে দু’টি, অনারব্ধ এবং ঘুমন্ত ঘরবাড়ি এখনও পাওয়া যায়। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ছোটগল্প থেকে ছ’টি গল্প সঙ্কলিত হয়েছে আলোচ্য বইটিতে।
এই ছ’টি গল্পের প্রধান চরিত্র শমিতা চৌধুরী। সে বিদুষী, বিখ্যাত ফাউন্ডেশনের বৃত্তি পেয়ে বিদেশে গবেষণার পর দেশে ফিরে কাগজে সাংবাদিকতা শুরু করে। রহস্য সমাধানের কাজে সে অবতীর্ণ যেন কতকটা আকস্মিক ভাবেই। প্রভু, প্রভঞ্জন শমিতার প্রেমিক। প্রথম গল্প ‘সালংকারা’-য় প্রভঞ্জনের বড়পিসি হৈমবতী তলাপাত্রের ছেলে, প্রভঞ্জনের প্রাণের বন্ধু রতনের বিয়ে হিন্দু আচার মেনে হবে, রতন ও তার বান্ধবীর এই ইচ্ছায় কিছুতেই সম্মত হন না হৈমবতী ও বড় পিসেমশাই। শমিতা এই রহস্যের কিনারা করে, বাড়ি থেকে চুরি যাওয়া বিয়ের সাজে সালঙ্কারা হৈমবতী ও রতনের বাবার ছবি দেখে। রতনের বাবার পরিচয় পেতে শমিতাকে সাহায্য করেন ছোটপিসি মর্মবাণী রায়। তাঁর সঙ্গে চমৎকার মিলে যায় শমিতার ভাবনাতরঙ্গ। চতুর্থ গল্প ‘বউয়ের ইতিবৃত্ত’-এ ছোটপিসির ছেলে সুনন্দর বিবাহবিভ্রাট। ভাবী বৌ নীনা হঠাৎ উধাও। গল্পে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নীনার বোন, সুনন্দর জার্মান ক্লাসের সহপাঠী রিনা। ঘটনাচক্রে নীনাও সুনন্দর সহপাঠী। শমিতা রহস্য সমাধান করে, তার সহকারী হয়ে ওঠে পুরো পরিবার। দেখা যায় ছেলেদের থেকে ছোটপিসিই অনেক আধুনিক। নীনা ফিরে আসে, বিয়েটা অবশ্য ভেঙে যায়।
শমিতা রহস্য সমাধানকারী সত্যান্বেষী। অপরাধ, যাকে ‘ক্রাইম’ বলা যায়, এই গল্পগুলিতে নেই। এ এক বিদগ্ধ, বুদ্ধিমান মেয়ের গল্প। গল্পগুলির প্রকাশকাল দেওয়া নেই, তাই এদের ঘটনাকাল নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। শুধু এই চিহ্নগুলি পাওয়া যায়: মেয়েরা তখন সবে খবরকাগজের সাংবাদিকতায় আসছে। কলকাতার রাস্তায় ট্রাম চলে, চিঠি ও ল্যান্ডলাইন যোগাযোগের মাধ্যম। শমিতা ও প্রভঞ্জন একে অপরের জন্য চিরকুটে বার্তা রেখে যায় বাড়িতে।
শমিতার ছক্কা
মানসী দাশগুপ্ত
২৫০.০০
বার্ণিক প্রকাশন
দ্বিতীয় গল্প ‘শোক যাযাবর’-এ চিত্রশিল্পী মধুসূদন বিশ্বাসের আকস্মিক মৃত্যুর পরদিন সকালে সাংবাদিকরা জড়ো হন তাঁর বাড়িতে। স্বজনপরিবৃত শিল্পীর স্ত্রী মলিনা তাঁদের দেখান শিল্পীর শেষ সমাপ্ত কাজ, যাযাবর পাখির ছবি। কিন্তু নতুন অনভিজ্ঞ সাংবাদিক শমিতা সকলের অগোচরে দেখে আসে শিল্পীর শেষ কাজ একটি অসমাপ্ত পোর্ট্রেট, হরিদাসীকে নিশ্চিত চেনা যায় তাতে। হরিদাসী পরিচারিকা, শিল্পীর দেখাশোনার ভার তাকেই দিয়ে স্ত্রী মলিনা অভ্যস্ত বিশ্রামে থাকতে পারেন। শমিতা দেখে, শোক মূর্ত হয়ে উঠেছে হরিদাসীর মধ্যে, সে যেন সব হারিয়েছে শিল্পীর মৃত্যুতে। গভীর শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতায় হরিদাসী চিনেছিল শিল্পীকে, বুঝতে পারে শমিতা। সেই ছবির ফটোও তুলে নেয় সে। কিন্তু পরদিন কাগজে শমিতার তোলা সেই ছবি ছাপা হয় না, মলিনা যে যাযাবর পাখির ছবি সকলকে দেখিয়েছিলেন সেই ছবি ও খবরই ছাপেন কাগজের মালিক। প্রাথমিক উত্তেজনার পর শমিতা নিজের দিকে চোখ ফেরায়: এই মিথ্যাচারের জন্য সে-ই কি দায়ী নয়? সমাজ স্বীকার করবে স্ত্রীর বয়ান, হরিদাসীর ছবি প্রত্যাখ্যান করবে। হরিদাসীকে শোক সংবরণ করতে হবে নিভৃতে। সে অবশ্য শমিতাকে বলেইছিল, শমিতা কখনও ছাপাতে পারবে না এ ছবি। ছবিতেও তার প্রতি শিল্পীর স্নেহ স্বীকার করতে দেবেন না মলিনা, এ কথা হরিদাসী বুঝেছিল, শমিতা বুঝল পরদিন।
প্রভঞ্জনের কাছে যা কাজ, নিতান্ত পেশার কর্তব্য, শমিতার কাছে তা জীবনের মূল প্রশ্ন। তাই কাজের ক্ষেত্রে প্রভঞ্জনের মানিয়ে নেওয়ার পরামর্শ মেনে নিতে পারে না সে। আমাদের মনে পড়ে এই কলকাতায় কর্মক্ষেত্রে নিহত মেয়েটির কথা: শোনা যাচ্ছে, সে মানিয়ে নিতে পারেনি। শমিতার পরিস্থিতি এমন হয়নি। কিন্তু শেষ গল্প ‘নিজের ধাঁধা’য় দেখি শমিতা ও প্রভঞ্জনের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। প্রভঞ্জন পুনঃ বিবাহিত, পুত্রসন্তানের পিতা। শমিতা তত দিনে প্রতিষ্ঠিত, নামী সাংবাদিক। তবে তাদের বিচ্ছেদ ঠিক কেন হয়েছে তা স্পষ্ট নয় ‘একটা-মাত্র চিরকুট নিয়ে শমিতা’ গল্পে। তবে তা সন্তান পরিকল্পনা নিয়ে নয়, কারণ সে কথা প্রভঞ্জন তুলতেই পারেনি।
শমিতা-প্রভঞ্জনের দাম্পত্য আমাদের সেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়, যার সমাধান এখনও অধরা। নারী-পুরুষের সাম্যের সাধনা কি সত্যি অসম্ভব? হয় পুরুষের চাপে মেয়ের পড়াশোনা, কেরিয়ার, আত্মসম্মান ভূলুণ্ঠিত হবে, নয় মেয়েটির লেখাপড়া, কেরিয়ারের দাবিকে সম্মান জানাতে পুরুষ নিঃসন্তান থাকবে। প্রভঞ্জন শমিতাকে সব দিক থেকেই সহায়তা করেছিল, কিন্তু তার ‘একঘেয়ে যুক্তিতক্ক’-তে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে সে। এ কালের মেয়েদেরও কি চেনা নয় এই গল্প? কাজের জন্য মেয়েরা সন্তানধারণ না করতে পারে, কিন্তু বুদ্ধি দিয়ে যুক্তি সাজিয়ে তর্ক করবে, সে বোধ হয় আজও অসহনীয়।
উল্টো দিকেও আলো ফেলতে হয়। প্রভঞ্জন শমিতার কাছে জানতে চায় কী রেখে যাচ্ছে সে ভবিষ্যতের জন্য। এক নতুন মানুষকে জন্ম দেওয়ার কথা যখন প্রভঞ্জন বলে শমিতাকে, শমিতা সে কথা অগ্রাহ্য করে লেজকাটা শেয়ালের গল্পের উল্লেখ করে। শমিতার যুক্তি হল, মেয়ে বলে শমিতার একে তো অনেকটা সময়ই লাগবে সেই শিশুকে জন্ম দিতে। তার পর তার তো আর বৌ নেই, হবেও না কোনও দিন, তা হলে চিরকাল শিশুর ঝক্কি সামলাবে কে? যে প্রতিষ্ঠিত মেয়েরা নিজের ইচ্ছায় সন্তানের জন্ম দেন, তাঁরা কি সকলেই শিশুকে ঝক্কি মনে করেন? এই শমিতাকে আজকের মেয়েরা কোন আলোতে দেখবেন?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)