ভারতীয় সংবিধানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির ভিত্তি হিসাবে উল্লিখিত হলেও ধর্মীয় সত্তা ও বিভাজনের রাজনীতি আজ প্রাত্যহিক বাস্তবতার অঙ্গ। নব্বইয়ের দশক থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী উত্থান ও তার এক দশকের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের সঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের তথাকথিত যোগ এই ভাষ্যকে জনমানসে আরও দৃঢ় করেছে। গত কয়েক দশক ধরেই বলিউডের মুসলমান চরিত্রগুলি তাই অনেক সময়েই শঠ, সন্ত্রাসবাদী, বিদেশি শক্তির প্রতিভূ কিংবা অন্ধকার জগতের প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থাপিত হয়ে চলেছে। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ও বলিউডে মুসলমানত্বের উপস্থাপন নিয়ে এক গবেষণাধর্মী গ্রন্থের প্রয়োজন ছিল— নাদিরা খাতুন সে কাজটি করেছেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বলিউডে মুসলমান সম্প্রদায়ের যোগ ও তার উপস্থাপন নিয়ে আলোচনা করেছেন নাদিরা। মূলত ২০১২ থেকে ২০২৩-২৪ সাল অবধি চলচ্চিত্র-পরিচালক ও চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শক ও সমকালীন গবেষকদের সাক্ষাৎকার, এবং তাঁদের মতামত-সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে তিনি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি মনোভাব ও বলিউডে তার উপস্থাপনের রাজনীতি অনুসন্ধান করেছেন। পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত এই বইয়ের ভূমিকায় ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ের অবস্থান ও তাদের সম্পর্কে সংখ্যাগুরু ও সরকারি ভাষ্যের বয়ান পর্যবেক্ষণের পরেই, প্রথম অধ্যায়ে পড়ি বলিউডের সঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের কার্যসূত্রে যোগ এবং মুসলমান চরিত্র উপস্থাপনের আলোচনা। দ্বিতীয় অধ্যায় থেকেই আলোচনার কেন্দ্র হয়ে ওঠে মুসলিম চরিত্রের উপস্থাপন— তা কখনও আলোচিত হয় ইতিহাসভিত্তিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, কখনও বা দেশদ্রোহী বহিঃশত্রুর প্রতিনিধিরূপে। আবার কখনও বা সংখ্যাগুরু হিন্দু ভারতীয়দের থেকে পৃথক এক ধর্মীয় সাংস্কৃতিক সামাজিক গোষ্ঠীরূপে।
বইয়ের শিরোনামে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়কাল উল্লিখিত হলেও রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদের উত্থানের প্রেক্ষিতে, বিশেষত ২০১৪-পরবর্তী সময়ে, নির্মিত ছবিই মূল আলোচ্য। মনে হতে পারে, ১৯৫০ থেকে ১৯৮০-র দশকে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলির উল্লেখ বা আলোচনা এসেছে কেবল তুলনামূলক ভাবে। আগ্রহী পাঠকেরা জানেন, বলিউডের সে যুগের সাম্প্রদায়িক উপস্থাপন বা মুসলমানি ধারা সম্পর্কে প্রকাশিত গ্রন্থ ও গবেষণার কথা— ইরা ভাস্কর, ফরিদ কাজ়মি, অমিত রাই বা সঞ্জীবকুমারের ব্যাখ্যা ও বিবরণের কথা। ওই সব গবেষণায় স্বাধীনতা-উত্তর কালপর্বে, বিশেষত নেহরু ও পরবর্তী কংগ্রেস আমলে অসাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণে ‘মুসলিম স্টিরিয়োটাইপ’ নির্মাণের প্রক্রিয়া ও তার রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিশদ ভাবে আলোচিত হয়েছে। হয়তো বা সেই প্রসঙ্গের সূত্র ধরেই পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিবেশে প্রকট নেতিবাচক একমাত্রিক মুসলমান স্টিরিয়োটাইপ নির্মাণের প্রেক্ষাপট-চর্চাই এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য ছিল। তাই পুনরুক্তি প্রমাদ না রাখতে চেয়েই লেখক সরাসরি সমসাময়িক পরিস্থিতিতে সূত্র খুঁজতে চেয়েছেন।
তিনি ঠিকই অনুধাবন করেন যে, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হলেও দেশের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি প্রকাশ্য ঘৃণা বা বিদ্বেষ উপস্থাপনের ইতিহাস ততটা পুরনো নয়। সাম্প্রদায়িক বিভেদ সত্ত্বেও এক নেহরুবাদী প্রলেপের ফলে দেশভাগ-উত্তর কালেও দিলীপকুমার, মধুবালা বা নার্গিসরা ভারতের রুপোলি পর্দার অবিসংবাদিত স্টার হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। লেখকের মতে বলিউডের প্রারম্ভিক পর্বে সিনেমা-শিল্পে মুসলমান শিল্পী, চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীতশিল্পীর বিস্তর উপস্থিতি সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বলিউড-জগতেও এই আধিপত্য রক্ষার বাতাবরণ রচনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। তবে সেই স্টার হতে গিয়ে তাঁদের অনেকেরই আরবি-ফারসি নাম পরিবর্তন করতে হয়।
এই ব্যক্তি-মানুষের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ব্যাখ্যার জন্য এখানে প্রাক্-চলচ্চিত্র বিনোদনে উর্দু ভাষা, বিশেষত গজল-শায়েরির সূত্র ধরে রোম্যান্সের উপস্থাপনে ভাষা-সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা, এবং পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী মঞ্চে হিন্দুস্থানি ভাষা ব্যবহার নিয়ে কিছু আলোচনা আবশ্যক ছিল। এখানে বলিউডে কাওয়ালি ও সুফি সঙ্গীতের ব্যবহারের কথা আছে, কিন্তু পাশাপাশি উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ভাষা, সুর, সহবত ও রোম্যান্স সম্পর্কিত সংস্কৃতিতে উর্দু-ফারসি সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা নেই। সেই সাংস্কৃতিক বাতাবরণের অপসারণ এবং নতুন পর্যায়ে তিন খানের উত্থানের পিছনে বৃহত্তর ভারতীয় আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের সামাজিক উপস্থিতি এবং অপ্রচলিত শিল্পে সংখ্যালঘুদের জোরদার উপস্থিতির কথা সাচার কমিটির রিপোর্ট তুলেও আলোচনা করা যেত। বলা যেত যে, নব্বইয়ের দশকে এই তিন খান বলিউডের সুপারস্টার হয়ে ওঠেন বটে, কিন্তু পর্দায় তাঁদের নাম হয়ে যায় রাজ, রাহুল বা প্রেম।
পোস্টকলোনিয়াল বলিউড অ্যান্ড মুসলিম আইডেন্টিটি: প্রোডাকশন, রিপ্রেজ়েন্টেশন অ্যান্ড রিসেপশন
নাদিরা খাতুন
১২৯৫.০০
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে হাল আমলে বলিউড কী ভাবে মুসলমানি চরিত্রের উপস্থাপন করেছে, তা বিশদে আলোচিত হয়েছে পরের অধ্যায়গুলিতে। জড়িত হয়েছে কাশ্মীর প্রসঙ্গও, যা সন্ত্রাসবাদকে একাধারে জাতীয়তাবাদ-বিরোধী ও বিদেশি মদতপুষ্ট হিসাবে উপস্থাপন করতে সহায়তা করে। সেই সন্ত্রাসবাদ দমনে ভারতীয় সেনার হিন্দুত্ববাদী চরিত্রও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পরিচায়ক হিসেবে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে— লেখিকা তুলে ধরেছেন এলওসি: কারগিল বা উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক-এর মতো চলচ্চিত্রের সূত্রে। পাশাপাশি পড়শি মুসলমানদের প্রতি সন্দেহ, সংশয়ের বীজ প্রগাঢ় করতে সরফরোশ থেকে শুরু করে ফনাহ বা নিউ ইয়র্ক-এর মতো চলচ্চিত্রের কথা বলেছেন। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐতিহাসিক বিভেদ ও বিদ্বেষের ধারা অব্যাহত রেখেছে ঐতিহাসিক ছবিগুলি। পদ্মাবত থেকে শুরু করে তানাজী, সব চলচ্চিত্রেই মুসলমানি শাসকের নিষ্ঠুরতার পিছনে তাঁদের ধর্মীয় সংস্কৃতি চিহ্নিত হয়েছে, যা তাদের ভারতীয় তথা হিন্দু মূলস্রোতের সঙ্গে মিশে যেতে দেয়নি।
এই চিত্রায়ণ নিঃসন্দেহে আগেকার মুসলমান চরিত্রের উপস্থাপনের পরিপন্থী। মুঘল-এ-আজ়ম থেকে অমর আকবর অ্যান্টনি-র মতো ছবিতে চরিত্রের সাম্প্রদায়িক ভিন্নতা স্টিরিয়োটাইপ দ্বারা উপস্থাপিত হলেও তা ভারতীয়ত্বের বহুমাত্রিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটেই স্বীকৃত হয়েছিল। নাদিরা তাই মনে করেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই বদল আরও প্রকট হয়েছে। প্রশ্ন জাগে, তা হলে কি বলিউড এখন নিতান্তই সরকারি স্বর? গণমাধ্যমে জনপ্রিয়তার তাগিদে যে ভাবে বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে পৌঁছে যাওয়ার জন্য এক বহুমাত্রিক আখ্যান তৈরির রীতি ছিল, তা কি তা হলে বলিউড থেকে বিদায় নিয়েছে? প্রকাশ ঝা-র মতো পরিচালকেরা বলিউডের বাজারি চরিত্রকে এর জন্য দায়ী করেছেন। তবু প্রশ্ন, বলিউডের বাজার এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি কী ভাবে অধুনা ভারতে একাকার হয়ে যাচ্ছে? সে কি আদতে সর্বাত্মক একমাত্রিক রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির উত্থানকেই চিহ্নিত করছে না?
এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য শেষ অধ্যায়টি গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে লেখিকা মাল্টিপ্লেক্স-সিনেমার উত্থান ও সিনেমার দর্শকগোষ্ঠীর এক বিরাট পরিবর্তনের কথা বলেছেন। তবে কি সংখ্যালঘু দরিদ্র মুসলমান এই মাল্টিপ্লেক্স-কেন্দ্রিক বাজারের পরিধি থেকে বিচ্যুত হওয়ার ফলেই সিনেমায় একমাত্রিক হিন্দুত্ববাদের বাড়বাড়ন্ত? আজকের বিকল্প মাধ্যমে প্রচারিত ফোটোগ্রাফের মতো চলচ্চিত্র কি সেই বাজারের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে?
নাদিরার বইয়ে সব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। একটি সীমাবদ্ধতার কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। কাজটি সমীক্ষাভিত্তিক হলেও তার পরিধি মূলত মুম্বই শহর। স্যাম্পল সাইজ় ছোট ও পরিধি সীমিত হওয়ায় বলিউডের আখ্যানের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত সমীক্ষা অধিকাংশ সময়েই বাস্তবচিত্র প্রতিফলিত করে না। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও উপস্থাপনের প্রসঙ্গে সমসাময়িক রাজনৈতিক ইতিহাস ও তার সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার দরকার ছিল। জানা দরকার ছিল, কী ভাবে এই আলোচিত ছবিতে প্রযোজক, পরিচালক বা মূল অভিনেতারা সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিশ্লেষণ বা পরিবেশন করছেন। ব্যক্তিগত সমীক্ষা না মিললেও সমকালীন সাক্ষাৎকার কার্যকর হতে পারত।
এই বইয়ের আর এক দুর্বলতা না বললেই নয়। চলচ্চিত্র আদতে এক দৃশ্য ও শ্রবণগ্রাহ্য আখ্যানের মাধ্যমে নির্মিত। সেই নির্মাণে আখ্যান বিশ্লেষণ করতে গেলে, চলচ্চিত্রের পরিভাষায় যাকে বলে ‘ফ্রেম বাই ফ্রেম’ বিশ্লেষণ, সেটা জরুরি হয়ে পড়ে। এখানে তা অনুপস্থিত। কয়েকটি আঁকা ছবি এক অলঙ্কারের আবেশ রচনা করে মাত্র, কিন্তু প্রামাণ্য সূত্র হয়ে ওঠে না।
আজ যখন আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদ অন্য সব চিন্তার টুঁটি টিপে ধরেছে, সেখানে এমন মতামত আরও শাণিত ভাবে উপস্থাপিত হলে ভাল হত। সেই দিক দিয়ে প্রকাশক ও গবেষণার ভ্রান্তি বা সীমাবদ্ধতা দুর্ভাগ্যজনক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)