Advertisement
১২ অক্টোবর ২০২৪
Book Review

আহত আবেগ আর ক্রোধ

আমরা প্রশ্নটিকে অন্য ভাবে রাখতে পারি। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দিয়ে কি সংখ্যাধিক্যের মতাদর্শ বা সংখ্যাধিক্য-কেন্দ্রিক মতাদর্শকে ঠেকানো যায়?

প্রয়াস: নোয়াখালিতে মহাত্মা গান্ধী। চেষ্টা করেছিলেন যুযুধান দুই পক্ষকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে নিয়ে আসার

প্রয়াস: নোয়াখালিতে মহাত্মা গান্ধী। চেষ্টা করেছিলেন যুযুধান দুই পক্ষকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে নিয়ে আসার

রণবীর সমাদ্দার
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:৩৪
Share: Save:

আহত আবেগ। ‘হার্ট সেন্টিমেন্টস’। তাই সংখ্যালঘুদের অসতর্ক কথা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মনে লাগে। সংখ্যাগুরুরা মনে করে, সংখ্যালঘুরা জাতিবিরোধী। জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী। অন্য দিকে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের আচরণ ও তার প্রতিনিধিবর্গের মনোভাব সংখ্যালঘুদের আহত করে। মনে করিয়ে দেয়, সংখ্যালঘুদের ভবিতব্য হল জাতীয় জীবনে সংখ্যালঘু হয়ে থাকা— যাদের কথা শোনা হবে না, যাদের স্বাচ্ছন্দ্য ও অধিকারের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হবে না, যাদের ভাগ্য হল সংখ্যাগুরুর অধীনে থাকা। এই পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গিকে দূর করার উত্তর কি ধর্মনিরপেক্ষতা? এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবে দেশ ও সমাজে আমাদের আত্মীকরণের ভবিষ্যৎ কি স্থায়ী ভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকবে?

অথবা আমরা প্রশ্নটিকে অন্য ভাবে রাখতে পারি। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দিয়ে কি সংখ্যাধিক্যের মতাদর্শ বা সংখ্যাধিক্য-কেন্দ্রিক মতাদর্শকে ঠেকানো যায়?

নীতি নায়ারের হার্ট সেন্টিমেন্টস বইটি উপরোক্ত প্রশ্নের বিশদ আলোচনা করেছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালীন বিতর্ক, মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু-কেন্দ্রিক আলোচনা, বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক আইনি ও বিচারালয়-কেন্দ্রিক বক্তব্য বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। নিপুণ রচনাশৈলী অথচ তথ্যসমৃদ্ধ পদ্ধতিতে লেখিকা ধর্মনিরপেক্ষতার এক নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেছেন যার মূল কথা হল, রাষ্ট্রের রাষ্ট্রিক আচরণ ও ধর্ম— এই দুইয়ের মধ্যে প্রাচীর টানলে হবে না, বা এই পার্থক্য টানা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের সহাবস্থান সম্প্রীতির পরম্পরায় ফিরে যেতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার অর্থ হল, স্বীয় সম্প্রদায় ও জাতির অন্তর্গত হওয়া নির্ভীক ভাবে। একই সঙ্গে অন্য সম্প্রদায় ও জাতির অস্তিত্ব ও অবস্থানকে সম্মান ও স্বীকৃতি দান করা।

হার্ট সেন্টিমেন্টস: সেকুলারিজ়ম অ্যান্ড বিলঙ্গিং ইন সাউথ এশিয়া

নীতি নায়ার

৬৯৯.০০

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস

বইটি পড়তে ভাল লাগবে। এই উপমহাদেশের সংবিধান তৈরির নানা ইতিহাস ও কাহিনি পাঠকদের সমৃদ্ধ করবে। মনে রাখতে হবে, সংখ্যাগুরু-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, সংখ্যালঘুর আত্মরক্ষার চেষ্টা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে সওয়াল শুধু ভাবধারার মধ্যে এক যুদ্ধ ছিল না, আলোচনার বাইরে ব্যাপক সমাজের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রতিধ্বনি হচ্ছিল এই ভাবধারাগত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। গান্ধীজির অনশন, তাঁর প্রার্থনাসভায় গীতা ও কোরান পাশাপাশি রাখা নিয়ে অসন্তোষ; লিয়াকত আলি খান, শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের ধর্মনিরপেক্ষতার স্বপক্ষে যুক্তি বিন্যাস, এই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল দেশভাগের রক্তাক্ত দাঙ্গা ও অসংখ্য মানুষের দেশত্যাগ, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের দাবি, অথবা নতুন জাতি হিসাবে বাংলাদেশের এক স্বপরিচিতি পাওয়ার ঘোষণা।

কিন্তু আমরা সবাই জানি, সমাজের এই বিরোধ মেটেনি। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আচরণ ধর্মনিরপেক্ষ থাকেনি। সঙ্কটকালে জাতিদাঙ্গার চরম মুহূর্তে ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসনের প্রাচীর ভেঙে পড়েছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সেই মাসগুলিতে যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়, তাতে প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠেছিল। শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের রিপোর্টের কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। অনুরূপ, ‘সহমত’ নামক সাংস্কৃতিক সংগঠনের ‘‍আমরা সবাই অযোধ্যা’ নামক গণপ্রচারের উদ্যোগের ক্ষেত্রে সরকারি বাধা ও নানা প্রতিবন্ধকতা ওই একই ব্যর্থতা অথবা সীমাবদ্ধতার নিদর্শন। এই বইয়ে তার এক বিশদ আলোচনা আছে। (পৃ ১২৮-১৪৮)

বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের যাত্রা আরও বিয়োগান্ত। আজকের বাংলাদেশ এই দেশ বা পাকিস্তানের মতো প্রতি দিন স্মরণ করাচ্ছে, দেশ ও সমাজের অন্তরে এই বিভাজন মেটেনি। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর ভাগাভাগির অনাস্থা ও অবিশ্বাস জাতি গঠনের সামনে আজও এক বড় অন্তরায়। ধর্মকে মেনেও শান্তি নেই, না মেনে বা উদাসীন থেকেও পরিত্রাণ নেই। এই উভয়সঙ্কটের জ্বালা থেকে জাতিগঠনের কর্মসূচি আজও মুক্ত হতে পারেনি।

সম্ভবত গান্ধীজির প্রয়াণ ছিল সে যুগে একমাত্র নিদর্শন, কী করে ধর্মনিরপেক্ষতার পথকে সামাজিক পথ হিসাবে গড়ে তোলা যায়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের নীচে সামাজিক উদ্যোগের এই ভাবনা চাপা পড়ে যায়। তার পরিণাম আমরা আজ প্রত্যক্ষ করছি নিদারুণ ভাবে।

বইটি নিয়ে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে এখানে। গান্ধীজি কলকাতা, নোয়াখালি, দিল্লি সর্বত্রই চেষ্টা করেছিলেন তাঁর মর্যাদা ও জীবনকে বাজি রেখে যুযুধান দু’পক্ষকে শান্তিময় সহাবস্থানে বাধ্য করাতে। কিন্তু বাইরের সর্বব্যাপী দাঙ্গা, দেশভাগ, সংবিধান প্রণয়ন পরিষদের তর্ক-বিতর্কে ওই প্রচেষ্টা যথেষ্ট হয়নি। পরে যখন সংসদীয় গণতন্ত্র পুরোদমে চালু হল, তখন সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর বিভাজনে সাম্প্রদায়িকতাবাদের সিলমোহর পাকাপোক্ত ভাবে লাগল। গণতন্ত্র কোথাও এই সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর বিভাজনকে দূর করেছে বলে শুনিনি। কানাডা এবং সুইৎজ়ারল্যান্ড, এই দুই দেশ সম্পর্কে আমরা শুনি এক সাফল্যের কাহিনি। কিন্তু সেখানেও আরও বহু দেশের মতো, অন্য ধর্ম অন্য বর্ণের অভিবাসীরা আজ সেই সংখ্যালঘু জনগণ, যাঁদের সমানাধিকার নেই বললেই চলে। অভিবাসীরা হল নতুন সংখ্যালঘু, উপেক্ষিত নতুন সম্প্রদায়, নতুন বর্ণ, নতুন জাতি। সমাজ কিন্তু রাষ্ট্র অপেক্ষা অধিক নিরীহ নয়। মহম্মদ আলি জিন্নার ‘প্রত্যক্ষ কর্মসূচি’র আহ্বানের পরবর্তী ঘটনার কথা কে না জানে?

অন্য দিকে, শক্ত রাষ্ট্র ছাড়া সাম্প্রদায়িকতাবাদকে ঠেকানো সম্ভব হয়েছে, এও কখনও শুনিনি। রাষ্ট্র হাত গুটিয়ে বসে আছে এবং সমাজ ও রাজনীতি ধর্মনিরপেক্ষ আচরণ করছে, এই কল্পকাহিনিতে কে বিশ্বাস করবে?

নীতি নায়ারের সুপাঠ্য বইটিতে এই সমস্যার জবাব নেই। সম্ভবত সে অনুসন্ধান লেখিকার উদ্দেশ্যও ছিল না। ভাবধারার ইতিহাসে বাস্তব ঘটনাবলির ইতিহাস প্রায়ই কম উপস্থাপিত হয়। কর্তৃত্ববাদী সেকুলার রাষ্ট্রের উদাহরণ অনেক। দু’-তিন দশক আগের আলজিরিয়া, মাঝে মাঝে তুরস্কের রাজনীতি, সাদ্দাম হুসেনের ইরাক— নিদর্শন কম নয়। কিন্তু ওই সেকুলারিজ়ম দিয়ে গণঅভ্যুত্থান ঠেকানো যায়নি। অধিকারের দাবিতে জনতা, অনেক সময়েই ধর্মীয় জনতা, গর্জে উঠেছে। অন্য দিকে, কর্তৃত্ববাদী ধর্মীয় রাষ্ট্র কী পরিমাণে হত্যালীলা চালাতে পারে, গাজ়া ভূখণ্ড তার প্রমাণ। অতএব শেষ অবধি, আহত আবেগ বা হার্ট সেন্টিমেন্ট হয়ে দাঁড়ায় একটা অজুহাত— ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার একটি যুক্তি।

সমস্যা হয়তো আরও অনেক গভীরে। গণতন্ত্র সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারে না। অন্তত উদারনৈতিক সংসদীয় গণতন্ত্র। সহাবস্থান নির্ভর করে সমাজের কথাবার্তা, আলোচনা ও সংলাপী অভ্যাস ও মনোভাবের উপর। সেই কথাবার্তার পৌরোহিত্যের জন্য শক্ত রাজনৈতিক শক্তিরও প্রয়োজন।

সমাজতন্ত্র এবং সমাজের সমাজতান্ত্রিক সমাবেশ এই চিরস্থায়ী ও দৈনিক আলাপচারিতাকে সম্ভব করতে পারে। আমরা আজ সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা প্রায় ভুলে গেছি। গণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণে গণতন্ত্রের অবমাননা ঘটে না। তার সমৃদ্ধি ঘটে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতার বিপরীতে আজ পৃথিবীর নানা দেশে, নানা স্থানে লোকায়ত রাজনীতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে, কী ভাবে এই সহাবস্থানকে সামাজিক ভাবে দৃঢ় করা যায়। লোকধর্মের আচার থেকে নানা শিক্ষা আজ আহৃত হচ্ছে। সমাজের বন্ধুত্ব ও শত্রুতার ইতিহাসকে পর্যবেক্ষণ করে এই সব নতুন প্রচেষ্টা চলছে। এই সব অভিজ্ঞতা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে শক্তিশালী করার পাথেয়।


অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE