E-Paper

কেন্দ্রবিন্দু ও দু’টি বৃত্তের কথা

লেখালিখির উৎকর্ষ বিচারে কেউ যদি বলেন, যা বেশি মানু্ষ পড়েন তা জীবনের সত্য-বর্হিভূত, তা শুধু উপভোগের, সেটি ভুল।

প্রচেত গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৫ ০৭:৫৬

সাহিত্য যখন ‘‌জনপ্রিয়’ তখন তার ‘‌সাহিত্যমূল্য’‌ কতটা?‌ জনপ্রিয় লেখা কি কখনও ‘‌সিরিয়াস সাহিত্য’ হিসাবে গ্রাহ্য হতে পারে?‌‌ যে গল্প, উপন্যাস, কবিতা বেশি মানুষ পড়েন, সহজে পড়তে পারেন, উপভোগ করেন, পরিচিত জীবনকে দেখতে পান, অথবা যে জীবন সে মনের কোথাও এত দিন লুকিয়ে রেখেছিলেন তাকে স্পর্শ করে, সেই সাহিত্য কি ‘‌উচ্চমার্গের‌’?

এই তর্ক চিরন্তন। সাহিত্যে অন্তর্লীন ‌সৌন্দর্য-দর্শনটিই সত্য। এই সৌন্দর্য জীবনবোধের। শুধু প্রেম, মিলন, বিরহে নয়, অস্তিত্বের সঙ্কটে, জীবনের দুরূহ জটিলতায়, সম্পর্কে দ্বিধায় এই বোধ গড়ে ওঠে। ‘‌আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’‌ জানবার জন্য ‘‌হাহাকার’ যেমন থাকে, তেমন থাকে ‘‌আমি তারে পারি না এড়াতে’‌-র মতো অমোঘ নিয়তি। এর সঙ্গে আবার কখনও সমাজ, কখনও সময় চালচিত্রের মতো পিছনে এসে দাঁড়ায়। জীবন, মানবমন, প্রকৃতি সম্পর্কে অতীতের ধ্যানধারণা, বিশ্বাস ওলটপালট করে ফেলে। ঘটনা, চিত্রকল্প, সঙ্কেত নিয়ে যে সাহিত্য সৃষ্টি, সেখানে কাহিনির মূল উপাদান (‌প্রেম, বিরহ, মিলন, অথবা ঘটনাবিহীন নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতা)‌ যেমনই হোক, এই পথ ধরেই তাকে যেতে হয়।

লেখালিখির উৎকর্ষ বিচারে কেউ যদি বলেন, যা বেশি মানু্ষ পড়েন তা জীবনের সত্য-বর্হিভূত, তা শুধু উপভোগের, সেটি ভুল। সাহিত্যে শিল্পে ‘‌জনপ্রিয়তা’‌র প্রতি বীতরাগ, জনপ্রিয়তা‌র প্রতি অতিমাত্রায় অনুরাগের মতোই অর্থহীন। বহু একাকী, অবহেলায়, ধূলি মেখে পড়ে থাকা সাহিত্যকর্ম সময় পেরিয়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে, বহু পাঠকপ্রিয় লেখাও ‘‌শ্রেষ্ঠ’‌ তালিকায় ঠাঁই করে নিতে পেরেছে। এটাই সত্য।

স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর শূন্য পথের মল্লিকা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই গূঢ় প্রসঙ্গটি এড়ানো যাবে না। স্মরণজিৎ এক জন অতি জনপ্রিয় কথাকার। শিক্ষিত, ‌রুচিসম্পন্ন পাঠক, নবীন থেকে প্রবীন, তাঁর গুণগ্রাহী। এটি তাঁর কত বড় গুণ সে আলোচনা ভিন্ন, কিন্তু এটি মানতে হবে। যাঁরা লেখকের জনপ্রিয়তাকে ‘‌অপরাধ’‌ ভেবে ভুল করেন, এই বইটি তাঁদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারে। পুরস্কারে স্বীকৃত হওয়ার আগেই এই কাহিনি বহু পাঠক পড়ে ফেলেছেন। এঁদের মধ্যে লেখকের নিজস্ব পাঠকগোষ্ঠী (লেখালিখির গোড়া থেকেই যা লেখক অর্জন করেছেন)‌ শুধু নয়, এমন পাঠকও রয়েছেন, যাঁরা তাঁকে আগে পড়েননি। প্রথম পাঠেই তাঁরা লেখকের অনুরক্ত হয়েছেন। কাহিনিটির এখানে যেমন সাফল্য, তেমন দুর্বলতাও বটে। এ কথা ঠিক, এই দীর্ঘ কাহিনিকে সম-আগ্রহে পাঠককে পড়িয়ে নিতে যে বিন্যাস, শৈলী, মুনশিয়ানার প্রয়োজন, অতীতের লেখার মতোই লেখকের সেই ক্ষমতা এ বারও বিস্ময়কর। ‌অতি অল্প দু’-একটি অংশ ছাড়া, কোথাও‌ তিনি ঢিমেতালা নন। অজস্র ঘটনা, অসংখ্য চরিত্রের উপস্থাপনা। গল্পের অভিনবত্বে, ভাষার সহজ ভঙ্গিতে যে গতি এই কাহিনি পেয়েছে সেটিই যেন এর ‘‌দুর্বলতা’‌। অনেকে পাঠের উপভোগ্য অংশটুকুর মধ্যেই থেকে যাবেন, গভীরে প্রবেশের প্রয়োজন বোধ করবেন না। অথবা সে পরিশ্রম করবেন না। বইটির জন্য এটি দুঃখের। এই কাহিনির শিকড় সমাজের, সময়ের, জীবনের অনেক গভীরে প্রোথিত। সেই পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেই এর প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব।

শূন্য পথের মল্লিকা

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

৬০০.০০

আনন্দ

লেখক এই বিপন্ন সময়, এই বিকল সমাজের মাটি খুঁড়েছেন। মাটি খোঁড়ার যে ধারালো অস্ত্রটি ব্যবহার করেছেন সেটি তাঁর স্নিগ্ধ কল্পনা, বাধাহীন ভাষা, সপাটে কঠিন সত্য বলার ক্ষমতা। মোট পঁচিশ বছরের একটি সময়কাল জুড়ে কাহিনি আগুপিছু করে গড়িয়েছে। এসেছে কোভিড-অতিমারির মুখ পর্যন্ত। ক্লাইম্যাক্স পৌঁছেছে কলকাতা শহরের প্রথম লকডাউনের দিনটিতে। যেন শুধু বাইরের অসুখ নয়, এই কাহিনি নিজে সমাপ্ত হয়ে সমাজ, সময়, জীবনেরও ভয়াবহ অসুখের পদধ্বনি শুনিয়ে দিল। অজস্র ঘটনা। তারা যেমন মানবিক, তেমন অমানবিক। প্রেম থেকে হিংসা, উদারতা থেকে স্বার্থপরতা, অপার ভরসা থেকে চরম বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলতে কোথাও রাখঢাক করেননি লেখক। পাঠকের মনে সুখবোধ তৈরির মিথ্যে চেষ্টা নেই। লেখক যেমন অঢেল ভালবাসার কথা বলেছেন, মন ভাল করা এবং বিষণ্ণ প্রকৃতির কথা বলেছেন, ছোট ছোট দৃশ্যের, মননের মুহূর্তকথা বলেছেন, তেমনই দেখিয়েছেন, মানুষ কত নীচে নামতে পারে। বিকৃত যৌনতা, রাজনীতি ক্ষমতামত্ত হাতির মতো মল্লিকাবনে দাপিয়ে বেড়িয়েছে।

বিমল (‌হাওয়াদাদু)‌, বিশ্বনাথ, বীরেন্দ্র, সুন্দর, শিউলি, জগন্নাথ, লীলা, বাচ্চু, রাজু, সেতু, কবি, লালু, জিনি, বিন্দি, উর্জা, মাধু্, ইমলি, পাখিদা, কৌশানি ম্যাডাম, অঞ্জনা, ঝিরি, নিধিদের নিয়ে দু’টি বৃত্ত তৈরি করেছে এই কাহিনি। ঘটনা এবং চরিত্রগত ভাবে এরা কেউ সাদা, কেউ কালো, কেউ ধূসর। এদের মধ্যে এক দল স্বপ্ন দেখে, এক দল ভাঙে, এক দল স্বপ্ন নিয়ে বিমর্ষ হয়। কাহিনির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল, এর জ্যামিতিগত চেহারা। লেখক একটি কেন্দ্রবিন্দুকে ঘিরে দু’টি বৃত্ত তৈরি করেছেন। কেন্দ্রবিন্দুটি হল ক্ষমতাশালী বীরেন্দ্রর বাংলোবাড়ি, যেখানে বারো জন রক্ষী থাকে প্রহরায়। এই কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ক্ষমতার লোভে উন্মত্ত বীরেন্দ্র, তাঁর যৌন-অতৃপ্ত দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী কৌশানি ম্যাডাম, এবং সৎ-কন্যা উর্জা। সে বিদুষী। এই কাহিনির অন্যতম নায়িকা— কবি নামের চরিত্রটিকে আংশিক নায়ক হিসেবে ধরা হয় যদি। উপন্যাসে অবশ্য লেখক সরাসরি মূল নায়ক-নায়িকার ভূমিকায় কাউকে দেখাননি। রয়েছে অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা, অনেক ব্যর্থ প্রেম।

কেন্দ্রবিন্দুকে ঘিরে আঁকা প্রথম বৃত্তে রয়েছে তারা, যারা বেঁচে আছে ক্ষমতাকে নির্ভর করে। গৃহসহায়ক, মালকিনের সেবিকা, ম্যানেজার,‌ গাড়ির চালক, দেহরক্ষী: রাজু, কবি, লালু, বিন্দি, জিনি প্রমুখ। এক অর্থে এরা সমাজের প্রান্তের মানুষ। আর্থিক ভাবে অসহায়, আশ্রিত, কেন্দ্রবিন্দুর উপর নির্ভরশীল। দায়িত্ব পালন করেও অপমানিত, লাঞ্ছিত। কখনও এরা নির্লজ্জের মতো টাকাপয়সা চায়। কখনও বেইমানি করে। মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের ধার ধারে না কেউ কেউ। আর মনে মনে যাদের উপর নির্ভরশীল তাদের প্রতি ক্ষিপ্ত, বিদ্রোহী।

দ্বিতীয় বৃত্তে রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, বেশ্যা, গুন্ডা, হত্যাকারী, যৌনতাকাতর প্রেমিক, অসাবধানে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া বোন, ক্ষমতাবানের ঘরে পুত্রের বিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক শক্তিবৃদ্ধিতে লালায়িত ধনী পরিবার। আর কিছু সু-মনের মানুষ। যেমন উর্জার বান্ধবী নিধি। এই কাহিনিতে প্রথম বৃত্তে থাকা চরিত্ররাই মুখ্য। তারা কেউ প্রেমিক, কেউ রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ, কেউ শিক্ষিত হয়েও নিজেকে শ্রেণিহীন ভাবতে পছন্দ করে, বাসে উঠে কাঁচা খিস্তি করে, কেউ প্রেমে বাধা পেয়ে ক্ষুব্ধ, কেউ প্রতিহিংসাপরায়ণ। এদের সম্পর্ক কেন্দ্রবিন্দু ও দ্বিতীয় বৃত্তের মানুষের সঙ্গে। দু’‌ধরনের সম্পর্ক দু’‌ভাবে এসেছে। কেন্দ্রে থাকা মানুষেরা দ্বিতীয় বৃত্তের সঙ্গে কখনও সরাসরি, কখনও যুক্ত হয়েছে প্রথম বৃত্তের মাধ্যমে। এ এক পরিক্রমা। তার ফলে যে প্রেম, ক্রোধ, লোভের শক্তি চরিত্রগুলির ভিতরে সঞ্চারিত হয়েছে তা অনিবার্য ভাবেই কখনও কখনও সংঘর্ষের চেহারা নিয়েছে। জ্যামিতির এই প্যাটার্ন লেখকের ভেবে করা নাকি নিজে থেকে তৈরি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা কতটা সফল সেটি গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বার বার যে কথা প্রমাণ করেছে, এই বইও আবার সে কথাই বলল। ‘‌সিরিয়াস সাহিত্য’‌ মানে শুধু জটিল বাক্য গঠন, কঠিন শব্দ চয়ন, অসংলগ্ন ঘটনাবলি, প্রান্তিক মানুষের তালিকায় নগরজীবনের অসহায় মানুষকে বাদ দেওয়া নয়। কলকাতার আলিপুর রোড ধরে যে একাকী অসহায় মানুষটি বিষণ্ণমনে হেঁটে চলেছে, সেও সমাজের প্রান্তে বাস করে। সহজ ভঙ্গিতে বেঁচে থাকার জটিলতা ছুঁয়েছেন স্মরণজিৎ। কাহিনি নামে যতটা সরল, নিতান্তই ‘‌প্রেমকাহিনি’‌ ভেবে ভ্রম তৈরি হোক না কেন, তার থেকে অনেক বেশি ক্রূর। স্নিগ্ধ মল্লিকার শূন্য পথে লেখক ভালবাসার সঙ্গে ক্রোধ, ঘৃণা, শাস্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই ক্রোধ ঘৃণা রাজনীতি, লোভ, ক্ষমতা, অর্থের প্রতি। এই কাহিনি জীবনের নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে বেঁচে থাকার বেদনাতুর কথা।

এ একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রেমের উপন্যাস।‌ বিভিন্ন অংশে প্রেমের সঙ্কেত ছড়িয়ে রেখেছেন লেখক, এ তাঁর লেখনীর স্বভাবজাত ক্ষমতা। পথ থেকে মল্লিকাফুল কুড়িয়েছেন আয়েসে, কিন্তু যখনই কুটিলতা ষড়যন্ত্র হত্যাকাণ্ডে ঢুকেছেন, কোমর থেকে বার করছেন তরবারি। সেখানে তিনি নতুন স্মরণজিৎ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy