বাংলার এই আশ্চর্য ভূলোক নয়, তৃপ্তি সান্ত্রার উৎসাহ মানবমনের চমকপ্রদ, গহিন আনাচ-কানাচ। তাঁর গদ্যের এমনই ম্যাজিক যে, পড়তে পড়তে মনে হতে থাকে কী যেন ঠিক ধরতে পারলাম না, কী যেন আর এক বার ফিরে পড়ার দাবি ছিল— অথচ এমন বুঁদ হয়ে ছিলাম পাঠক হিসাবে, বল কখন নেটে ঢুকে গোল করে বসে আছে, অনুধাবন করতে পারিনি।
‘পরান সখা’ দিয়ে এ ভুবনের আঙিনায় পদার্পণ পাঠকের, তার পর বিস্মিত হতে হতে এগিয়ে যাওয়া। না, অবলীলায় নয়। কারণ গদ্যের অলিগলির ঘোর কাটিয়ে উঠতে, খানিক থামতে হয়। ইয়াহু প্যাটার্ন-এর লীলা যে বাইক নিয়ে পক্ষিরাজ হয়ে উড়ে যেতে চায় আর তিতির যে ইদানীং আর যোগাযোগ রাখতে চাইছে না ‘পরান সখা’র সঙ্গে, এই প্রেক্ষিতে শুরু হয় কাহিনি। তার পর জঙ্গল, ধু-ধু নদীর চর, আংরাভাসা, তিরতিরে জল আর নিকষ কালো অন্ধকার। তার পর সুদূর বনের পার, গহন বনের অন্ধকার পেরিয়ে এক পুরুষের আবির্ভাব। লীলা-তিতিরের সমপ্রেম সম্পর্কে আচমকা চয়নের উপস্থিতি— ঝড়ের রাতে পরান সখার অভিসার গল্পটাকে এক হ্যাঁচকা টানে হাই-ভোল্টেজ তারের উপর নিয়ে গিয়ে ফেলে! বড় তীব্র এই ত্রিভুজ সম্পর্কের গল্প।
গল্পের শেষে গোল হল না বলে আক্ষেপ করার কিছু নেই। কারণ লেখক জানেন, গোল না হলে চৌকো, আর তা-ও না হলে বিন্দু, কিংবা সরলরেখা বা বক্ররেখা— কোনওটাই কম আকর্ষণীয় নয়।
‘লাটিম দিন’ গল্পের মলাটে জ্যোৎস্না, আগুন আর আর্ত রাত্রির সোনাটা। সাধু ঘোষাল আর ঝুমা ঘোষালের পুত্র ঋষি ঘোষালের পাত্রী সন্ধানে একটি চরিত্র ধুলো ঘেঁটে ঘেঁটে দেখে চলেছেন সাধু ঘোষালকে। মৃত সাধুদাকে খুঁজতে গিয়ে উপস্থিত হয় ডোরা— যাকে ঘিরে থাকে ‘পারবে না পারবে না’ আবহ। গেরস্তালি না পারা, পিরিয়ডস-এর ডেট না মনে রাখতে পারা ডোরাকেও নতুন করে যেন আবিষ্কার করে চলেছেন কথক। মনে পড়ছে সেই করিডরের বেহুঁশ পলাশফুল, আর মুখের বোকা-বোকা হাসি, মাসের শেষে সংসারে পাইপয়সা তুলে দিয়ে নিজেই যেন একখানা ভৈরবী গান! ডোরা আর সাধুর আগুন, জোছনা আর হৃদি শব্দ দুলে দুলে ভেসে ওঠে আইনস্টাইন থিয়েটার হলে, কাটাকুটি খেলবে বলে। তার পর রাত্রির খোঁজে প্রতিটি লাটিম দিন।
পঁচিশটি গল্প
তৃপ্তি সান্ত্রা
৩৫০.০০
একুশ শতক
এক আশ্চর্য খেয়ালি গদ্যে তৃপ্তি যে বিষাদ-কাব্য রচনা করলেন এই গল্পে, তা যেন সত্যি সত্যিই অগ্নিসংযোগের ধামাকা লাগিয়ে দেয়!
ঠিক কী ভাবে বর্ণনা করা যায় তৃপ্তির গদ্যকে? স্মার্ট? ঝকঝকে? মেদহীন? আবেগবর্জিত? খসখসে? আধুনিক? নির্ভার? নিরুচ্চার? অলঙ্কারহীন? অপারগ হয়ে বলতে হয়, হয়তো এই সবই, কিন্তু শুধুই গদ্যের কারুকাজ নয়, আরও কিছু। সলমন রুশদির সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে, “উই আর নট হেল্পলেস। উই ক্যান সিং দ্য ট্রুথ অ্যান্ড নেম দ্য লায়ার্স।” তৃপ্তির গদ্য অবধারিত ভাবে এ কথাটার কাছে নিয়ে যেতে পারে। এই উত্তর-সত্যের পৃথিবীতেও তিনি কী ভাবে যেন সত্য সঙ্গীত গাইতে পারেন। চিনিয়ে দিতে পারেন মিথ্যেকে।
পঁচিশটি গল্পের সঙ্কলন। প্রায় আড়াইশো পৃষ্ঠার এই সঙ্কলনে নারীর যৌনতার এক অভিনব কথিকা। তথাকথিত শুচিতার ‘অ্যায়সি কি ত্যাইসি’! স্তব্ধ হয়ে বার বার পড়ি এই রকম মায়াবী অথচ চ্যালেঞ্জিং বিন্যাস: “মরা কুকুরের ডাক শুনে যদি ডেকে উঠতে ইচ্ছে হয়— অক্ষমতার বিপন্নতায় অসহায় খোকন ভরদুপুরে বউকে খিমচে দরজা লাগায়। খোকনকে প্যাঁদানোর পাপ দৃশ্য সুনিপুণ ভাবে চোখের জলে মুছে, স্লেট শুকনো ছড়া বলে সুজাতাও ততক্ষণে আধভেজা নতুন অবলা স্লেট নিয়ে তৈরি। দুটি শরীর অতঃপর শরীরের গহন খাঁজে না পারা চিৎকারগুলো গুঁজে দেয়।”
তৃপ্তির পরিচয় নতুন করে দেওয়ার দরকার নেই। বাংলা সাহিত্যের আলোকসন্ধানীর কাছে এই নাম অতি পরিচিত। তবু তাঁর লেখা যেন নতুন করে ধরা দেয় প্রতি পাঠেই। গদ্যের দাপট বা মস্তানি পাঠকের মস্তিস্কে বিস্ফোরণ ঘটিয়েই চলে। ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলে, ‘দ্যাখো এ বার কেমন লাগে!’
পাঠক যদি ‘ওয়াসাবি’ চেখে দেখে থাকেন কখনও— হয়তো মনে পড়বে সেই জাপানি চাটনির কথা, যা এক চিমটি মুখে দিলেই শরীর জুড়ে কী যেন একটা তারঝঙ্কার শুরু হয়ে যায়। নাক, মাথা, টাকরা জুড়ে একটা অজানা প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর শেষ অবধি ইন্দ্রিয় জুড়ে এক নাকের জলে চোখের জলের তীব্রতা। ঝাল ভি লাগে, ভাল ভি লাগে!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)