Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

দেশকালের নিরিখে নজরুল

নজরুলকে রাষ্ট্র ও সমাজ কী ভাবে গ্রহণ করেছিল বা করেনি সেই প্রতিক্রিয়ার ইতিহাসও মুরশিদ যতটা সম্ভব নৈর্ব্যক্তিক ভাবে এই বইতে তুলে ধরতে চান। তাঁর নজরুল-জীবনী  কেবল যেন জীবনকথা নয়, বাঙালির সাংস্কৃতিক রাজনীতির ইতিকথা।

সুরসাধক: সঙ্গীতমগ্ন কাজি নজরুল ইসলাম। ছবি: পরিমল গোস্বামী

সুরসাধক: সঙ্গীতমগ্ন কাজি নজরুল ইসলাম। ছবি: পরিমল গোস্বামী

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

গোলাম মুরশিদের গবেষণা-সন্দর্ভ ও রচনার পাঠক মাত্রেই জানেন তথ্য ও যুক্তির পরেই তাঁর ভর। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে মধুসূদনের জীবনী লেখার সময়েই তিনি নানা অতিকথা ও ভ্রান্ততথ্যের ভার মোচন করেছিলেন। আলোচ্য নজরুল-জীবনীতেও তথ্য ও যুক্তির বিন্যাসে বিদ্রোহী কবির দেশকালের পুনর্বিবেচনা স্পষ্ট ও নির্দ্বিধ ভাবে করতেই তিনি আগ্রহী। হয়তো জীবনীকার হিসেবে মধুসূদন ও নজরুলের স্বভাবগত সাদৃশ্যও তাঁকে আলাদা করে ভাবিয়েছে। লিখেছেন, ‘‘কবি (নজরুল) এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো হাতে টাকা থাকলে তা উড়িয়ে দিতে দ্বিধা করতেন না। বিলাসিতা করতে ভালোবাসতেন। নিজেকে জাহির করতে পছন্দ করতেন।’’ (পৃ. ৫১৭) অপর অনেক লেখকের মতো বীরপূজামূলক, কিংবদন্তি-নির্ভর, ঘটনা এবং রটনা-প্রধান নজরুল জীবনী লেখা যে তাঁর উদ্দেশ্য নয় সে-কথা কবুল করেছেন উপসংহারে। দশ অধ্যায়ে বিভক্ত নজরুল জীবনকথা পড়ে লেখকের দাবি মানা যায় কি যায় না সে সিদ্ধান্ত পাঠক স্বাধীন ভাবে নেবেন।

নজরুলকে রাষ্ট্র ও সমাজ কী ভাবে গ্রহণ করেছিল বা করেনি সেই প্রতিক্রিয়ার ইতিহাসও মুরশিদ যতটা সম্ভব নৈর্ব্যক্তিক ভাবে এই বইতে তুলে ধরতে চান। তাঁর নজরুল-জীবনী কেবল যেন জীবনকথা নয়, বাঙালির সাংস্কৃতিক রাজনীতির ইতিকথা। বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে দুই-মলাটে ধরার আগ্রহ দেখান যিনি তিনিই তো কবি-জীবনকথা লিখতে গিয়ে সাংস্কৃতিক রাজনীতির ইতিহাসে মন দেবেন। প্রয়াত অধ্যাপক অরুণকুমার বসুর নজরুল জীবনী মুরশিদের আগে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আগ্রহী পাঠক এই দুই জীবনী পাশাপাশি রেখে পড়লে টের পাবেন যে প্রশ্নগুলি বসুর সন্দর্ভে অমীমাংসিত ছিল মুরশিদ যেন সেগুলির সাধ্যমতো উত্তর দিচ্ছেন। যেমন নজরুলের ব্যাধি-বিষয়ে বসু চিকিৎসকদের মতামত উদ্ধার করেছিলেন কিন্তু কোনও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হননি। মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘জন্মশতবর্ষে সত্যের অনাবৃত প্রকাশই প্রত্যাশিত।’’ (বসু: পৃ. ৬৭০) মুরশিদ তাঁর বইয়ের শেষে ডাক্তার মুহাম্মদ নূরুল হকের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন: ‘‘অতএব আমার বিবেচনায় কবি ডিমেনশিয়া অব লিউয়ী বডিস (DLB) রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় সে রোগ নির্ণয়ের মতো জ্ঞান চিকিৎসাবিজ্ঞানে ছিল না।... এখনো এ রোগের কোনো চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি।’’ (পৃ ৫৩০)

স্বাধীনতার পর দুই বঙ্গের রাজনীতির ফের-ফার আলাদা, নজরুলকে গ্রহণ ও বর্জনের যুক্তি সেই ফের-ফারের সঙ্গে সম্পর্কিত। স্বাধীনতার ঠিক পরেই পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠ্যসূচিতে নজরুলের লেখা অবহেলিত বলে মনে হয়েছে মুরশিদের। উদ্বাস্তু সমস্যা-কাতর পশ্চিমবঙ্গে ‘‘এই আরবি নামধারী কবিকে কেবল একজন মুসলমান কবি হিসেবে গণ্য’’ করা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের এই মনোভাব পরে বদলায়। এই শতকের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে খণ্ডে খণ্ডে নজরুলের রচনা সমগ্র প্রকাশিত হয়। ‘সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দূর’ করাই যে নজরুলের জীবনের ব্রত সে-কথা স্মরণ করা হয়েছিল।

বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ নজরুল-জীবনী
গোলাম মুরশিদ
৮০০.০০ (বাংলাদেশি টাকা)
প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা (পরি: নয়া উদ্যোগ)

মুরশিদ নির্মোহ ভাবে দেখিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী গণসাহিত্যের প্রতিনিধি নজরুলকে একদল মুসলিম সংস্কৃতির বাহক ও সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের প্রতিনিধি হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যস্ত। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দু’জনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা চলে। ‘‘তাঁকে মুসলমান-রবীন্দ্রনাথ হিসেবে খাড়া করার একটা সক্রিয় প্রয়াস ছিল পূর্ব পাকিস্তানে।’’ (মুরশিদ: পৃ.৫০২) স্বাধীনতা ও দেশভাগের আগে ১৯২৯-এ নজরুলকে রক্ষণশীল মুসলিম সমাজ ও মোহাম্মদী গোষ্ঠীর বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। সভাপতির অভিভাষণ দিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সবাই হয়তো সহমত হবেন না, তবু সব দিক বিচার করে মুরশিদ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ‘‘কেবল সাহিত্যিক মানদণ্ড দিয়ে বিচার করলে তিনি জাতির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা লাভের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হতেন কিনা, সন্দেহ হয়।’’ (পৃ. ৩৪০) হিন্দু বাঙালি, মুসলমান বাঙালি, ধর্ম-নিরপেক্ষ (বিবিক্ত নয়) বাঙালি সাহিত্যের টানে নয় আত্মপরিচয়ের আবর্তেই নজরুলকে খড়কুটোর মতো নানা ভাবে ব্যবহার করেছে। আর নজরুল তো সঙ্গীত নামের বিশেষ সাংস্কৃতিক পণ্যেরও স্রষ্টা। অনর্গল গান তৈরি করতে পারেন যিনি তাঁকে তো রেকর্ড কোম্পানি ব্যবহার করবেই। তাঁর ব্যাধিগ্রস্ততার পর সেই গানের বাজারে ভাটা দেখা দেয়। স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর বেতারে তাঁর গান আবার বাজতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে বেতারের যে ভূমিকা ছিল পশ্চিমবঙ্গে বেতারের সে ভূমিকা প্রথমে ছিল না। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে নজরুলের গানকে ষাটের দশকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন। নজরুলগীতি বাঙালির উপভোগ্য সাংস্কৃতিক পণ্যে পরিণত হল। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ড ‘নজরুল-গীতি’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে।

নজরুলকে গ্রহণ-বর্জনের সাংস্কৃতিক ইতিহাসটি যেমন পাঠকের আগ্রহের কারণ তেমনই পাঠকের কৌতূহলের বিষয় তাঁর প্রণয়জীবন। অবদমিত কৌতূহলী বাঙালি পাঠকদের জন্য রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শরৎচন্দ্রের ব্যক্তিজীবনকে তাড়িখানার উপাদান হিসেবে তুলে ধরার নজির আছে। মুরশিদের গুণ তিনি বিষয়টিকে মানবিক ভাবে বিচার করেছেন। নজরুলের জীবনে একাধিক নারীর উপস্থিতি। স্কুলজীবনের কিশোরী, নার্গিস, আশালতা, ফজিলতুন্নেসা আরও কেউ কেউ। এই নারীদের মধ্যে কী খুঁজেছেন কবি? প্রিয়ার কাছে প্রেরণাই কি চেয়েছেন শুধু? নজরুল ও ফজিলতুন্নেসার সম্পর্কটি বঙ্গজীবনে নতুন নারীর আগমনের ছবি যেন। ফজিলতুন্নেসা নারীমুক্তিতে বিশ্বাসী। ‘‘যে শিক্ষা নারী জীবনের পূর্ণ পাত্রের রস আস্বাদনে সাহায্য করেছে, সে শিক্ষাকে আমার জীবনে আমি বড় করেই পেয়েছি’’ লিখেছিলেন তিনি। নজরুলের জীবন থেকে তিনি বিদায় নিলেন। পুরুষ কবির কাব্যের প্রেরণা ও বিষয় হয়ে থাকেননি তিনি। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তাঁর বিলেতে চলে যাওয়া। নজরুল তাঁর সঞ্চিতা ‘বাংলার মুসলিম নারীদের রাণী’কে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। ফজিলতুন্নেসা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। নজরুল প্রিয়া ও প্রেয়সীকে খুঁজছেন প্রিয়া ও প্রেয়সীরাও আর বিষয় মাত্র হয়ে থাকতে চাইছেন না। এ ১৯২৮ সালের কথা, বাংলা কথা সাহিত্যে এর প্রায় সমসাময়িক রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’। সম্পর্কে কেবল পুরুষের প্রত্যাখ্যানের, চলে যাওয়ার অধিকার থাকে না নতুন শিক্ষিতা বাঙালি নারীরও তা থাকে।

মুরশিদের লেখায় নজরুলের জীবনের সাহিত্যিক আড্ডা, পার্টির প্রতি লেগে না থাকা রাজনৈতিক প্রবণতা, আধ্যাত্মিক যাপন যথাযথ তথ্য-সহ উঠে এসেছে। বইটি নজরুলকে বোঝার জন্য জরুরি সন্দেহ নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kazi Nazrul Islam Books
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE