ছিন্নমূল: মরিচঝাঁপিতে সূচনাপর্বে ঘরবাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত পূর্ব বঙ্গের উদ্বাস্তুরা।
ক্যাথি ক্যারুথ-এর ‘ট্রমা: এক্সপ্লোরেশনস্ ইন মেমরি’তে ডোরি লব-এর ‘ট্রুথ অ্যান্ড টেস্টিমনি: দ্য প্রসেস অ্যান্ড দ্য স্ট্রাগল’ নামের একটি লেখার কথা মনে পড়ছে। যেখানে এক মহিলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ইহুদি গণহত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমি হিটলারের মৃত্যুর পর অন্তত আরও একটা দিন বাঁচতে চেয়েছিলাম, যাতে আমাদের যন্ত্রণার কাহিনি শোনাতে পারি।’’ দেশভাগ-উত্তর ভারতের ইতিহাস রচনায় ‘ওরাল টেস্টিমনি’ বা ‘মৌখিক সাক্ষ্য’ দীর্ঘ সময় ধরেই তো প্রায় ব্রাত্য রয়ে গেল। যদিও বিগত ২০-২৫ বছরে সে ছবি খানিক বদলেছে। এই বদলের শরিক হয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চল তথা পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে যে সব রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক দলিল রচিত হয়েছে, সেই তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ ও নবীনতম সংযোজন দীপ হালদারের সদ্য প্রকাশিত বইটি। ডোরি লব-এর ওই ইহুদি মহিলার মতোই এই বইতেও এমন মানুষদের মৌখিক সাক্ষ্য স্থান পেয়েছে, যাঁরা মরিচঝাঁপি গণহত্যার বীভৎসতাকে তাঁদের স্মৃতি ও সত্তার মেলবন্ধনে আরও একবার জাগিয়ে তুলেছেন। এ যেন কতকটা ফিনিক্স পাখির আখ্যান। দেশভাগের পর এই মানুষদের নিজেদের ভিটেমাটি খুইয়ে এ পারে আসা। সরকারি সিদ্ধান্তে এখান থেকে দণ্ডকারণ্য বা মালকানগিরি। আবার রাজনীতির খেলায় তুরুপের তাস হয়ে মরিচঝাঁপির সেই জনমানবশূন্য দ্বীপে ফিরে আসা।
দেশভাগ পরবর্তী পূর্ববঙ্গের মানুষের উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে এর আগেও মূল স্রোতের সাহিত্য ও শিল্পকর্মে কম আলোচনা হয়নি। যেমন একেবারে গোড়ার দিকে ১৯৫০ সালে নিমাই ঘোষের ছবি ‘ছিন্নমূল’ বা ১৯৫৩ সালে সলিল সেনের নাটক ‘নতুন ইহুদী’। আবার মাঝের পর্বে ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বা পরবর্তী সময়ে সাহিত্যের আঙিনায় অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’, সুনন্দা সিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’, আরও কত কী। তবে নতুন ধারার ইতিহাস রচনায় ব্যতিক্রমী পথের সুলুকসন্ধানকারীরা এই সব শিল্প-সাহিত্যে এক মোটা দাগের সীমাবদ্ধতা ঠাহর করেছেন। তা হল, নিম্নবর্ণের উদ্বাস্তুদের ‘অভিজাত’ শ্রেণীর এই দেশভাগের সাহিত্যে বিশেষ স্থান না পাওয়া। অবশ্য নারায়ণ সান্যালের ‘অরণ্যদণ্ডক’ বা শক্তিপদ রাজগুরুর ‘দণ্ডক থেকে মরিচঝাঁপি’-র মতো কিছু ভিন্ন স্বাদের লেখাও এর মাঝে এসেছে। আবার প্রচলিত এই সব দেশভাগের সাহিত্যের উল্টো দিকে সাঁতরানো কিছু লেখাও হালফিলে সামনে এসেছে। এ প্রসঙ্গে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ বা অধীর বিশ্বাসের ‘দেশভাগের স্মৃতি’-র মতো লেখা খুবই প্রাসঙ্গিক। এই সব লেখায় জায়গা পাওয়া নিম্নবর্ণই হল ‘মনুস্মৃতি’ নির্দিষ্ট ‘অস্পৃশ্য জাতি’। এঁরাই আবার জাতির জনকের ‘হরিজন’। স্বাধীনতার আগে দেশভাগের হাওয়ায় এঁরাই কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নয়নের মণি। সংখ্যা যে বড় বালাই! এঁদের জন্যেই যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের লড়াই, এঁদের নিয়েই গুরুচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া সম্প্রদায়ের উত্থান আর এঁদের নিয়েই অম্বেডকরের ‘দি অ্যানাইহিলেশন অব কাস্ট’।
দীপ হালদারের বইতে ১৯৭৯ সালের মরিচঝাঁপির হত্যালীলার বীভৎসতা প্রকাশের যে প্রয়াস, তা উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর এই অংশের কথা মাথায় রেখেই। আরও খোলসা করে বললে, দণ্ডকারণ্য বা মালকানগিরি থেকে ফেরত আসা নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের প্রতি সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণের স্বরূপ প্রকাশ। ১৯৭৯-র ২৪ এপ্রিল ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, জনতা সংসদীয় দলের সম্পাদক মুরলী মনোহর জোশী মরিচঝাঁপি নিয়ে যে প্রতিবেদন পেশ করেন তাতে অন্তত ৭২ জনের না খেতে পেয়ে বা খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর কথা বলা হয়েছিল। যদিও যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের ছেলে জগদীশচন্দ্র ‘মরিচঝাঁপি: নৈঃশব্দের অন্তরালে’ বইতে ১৯৭৯-র ৩১ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যুর কথা, আর ২৪ জানুয়ারি থেকে না খেতে পেয়ে, পচা খাবার খেয়ে বা বিষ মেশানো জল পান করে প্রায় ৩৭৬ জনের মৃত্যুর কথা বলেন। এখানেই শেষ নয়, এই বইতে অন্তত ২৩ জন ধর্ষিত মহিলার নাম ও ৪ জন মহিলার লিখিত অভিযোগপত্র প্রকাশিত হয়েছে। আবার মনোরঞ্জন ব্যাপারী ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’-এর ‘মরিচঝাঁপি’ পর্বে অন্তত দু’হাজার লোকের মৃত্যু ও দুশো মহিলার ধর্ষিত হওয়ার কথা বলেছেন। দীপ হালদার তাঁর মৌখিক সাক্ষীদের ভাষ্যে আরও একবার বেলাগাম করে দিয়েছেন সেই সব খুন, ধর্ষণ, অর্থনৈতিক অবরোধের ইতিহাস, শিশুদের পানীয় জলে বিষ মেশানোর বৃত্তান্ত। যদিও এ সবের কিছুই প্রশাসনিক মান্যতা পায়নি। হয়তো সে কারণেই সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তৎকালীন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী তথা সিপিআইএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় দীপ হালদারকে অবলীলায় বলতে পারেন যে “মরিচঝাঁপিতে খুব বেশি হলে আট-দশ জন মানুষ মারা গিয়েছিলেন।’’ তবে, রাজনীতির নিষ্ঠুর পরিহাসে ২০০৯-১০ সালে প্রধান বামবিরোধী দলটি মরিচঝাঁপির বিচার-বিভাগীয় তদন্ত চাইলেও মরিচঝাঁপি আজও অবহেলিত। এই লেখার সময় পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও তদন্ত কমিটি হয়েছে বলে জানা নেই।
ব্লাড আইল্যান্ড: অ্যান ওরাল হিসট্রি অব দ্য মরিচঝাঁপি ম্যাসাকার
দীপ হালদার
৩৯৯.০০
হারপার কলিন্স
সে যাই হোক, লেখক তাঁর বইয়ের মুখবন্ধ ও ভূমিকায় দেশভাগ পরবর্তী উদ্বাস্তু সমস্যার এই প্রেক্ষিতটি সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই অংশে তিনি দেখাতে চেয়েছেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রাণ হাতে করে চলে আসা নিম্নবর্ণের উদ্বাস্তুদের প্রতি উচ্চবর্ণের শাসকের এক বিস্ময়কর উদাসীনতা। এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মরিচঝাঁপির বুকে রাষ্ট্র সংগঠিত হত্যালীলা। লেখক ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ দিয়ে শুরু করে দেশভাগ ও দণ্ডকারণ্য ঘুরে মরিচঝাঁপিতে এলেও, পাঠকের কাছে ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ অধরা থেকে যায়। স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলায় তফশিলি জাতির রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের প্রাণ-পুরুষ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নাম কোথাও না পেয়ে একটু হোঁচট খেতে হয়। দেশভাগ পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গেও নিম্নবর্ণের হিন্দু উদ্বাস্তুদের নিয়ে প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠনের চেষ্টা করেছিলেন এই যোগেন্দ্রনাথই। দ্বৈপায়ন সেন ‘অ্যান অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড কাস্টইজ়ম?’-এ ১৯৫৮-র ১৫ মার্চ তারিখের আইবি রিপোর্টের উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে প্রশাসন মনে করছে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল উদ্বাস্তু শিবিরে বর্ণবিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন। তাঁর মনে হয়েছিল, মূলত নিম্নবর্ণের উদ্বাস্তুদের দণ্ডকারণ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গকে একটি উচ্চবর্ণের হিন্দু অধ্যুষিত রাজ্য বানানোরই অভিসন্ধি। যদিও তৎকালীন পুনর্বাসন দফতরের মন্ত্রী রেণুকা রায়ের স্মৃতিকথায় এ সবের বিশেষ হদিশ পাওয়া যায় না। রেণুকা কেন্দ্রের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের দিকে আঙুল তুললেও উচ্চবর্ণের রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব চেপে রাখা যায় না। এ পারে আসার সময়কালই যে উদ্বাস্তুদের দণ্ডকারণ্যে পাঠানোর মাপকাঠি নয়, ‘জনসেবক’-এর মতো ওই সময়কার পত্রপত্রিকা ঘাঁটলে তা বোঝা যায়। চাষ করার উপযোগী শক্ত হাত বা কম বয়সের শ্রমোপযোগী দেহই ছিল নিম্নবর্ণের উদ্বাস্তুদের দণ্ডকারণ্যে যাওয়ার মাপকাঠি। এই সমস্ত প্রেক্ষিতের খানিক উল্লেখ থাকলে ভূমিকার অংশটি আরও টানটান হতে পারত।
লেখক মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ডের যে নগ্ন রূপ প্রকাশ করেছেন, তাতে পাঠকের মনে হতেই পারে যে মরিচঝাঁপি শুধুই বাম সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ছবি। কথাটা তো বহুলাংশেই ঠিক। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বিভিন্ন তাচ্ছিল্য ভরা মন্তব্যেই তার প্রমাণ মেলে। ১৯৭৮-এর ২৯ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ছিল, “কে কখন আসবেন, কোথা থেকে কত জন আসবেন সেজন্য কি আমরা দোকান সাজিয়ে বসে থাকবো? উদ্বাস্তুরা কোথায় যাচ্ছেন তাও বলছেন না। ওঁদের পিছন পিছন কি টিউবওয়েল এবং তাঁবু মাথায় করে ছুটব?” যদিও শোনা যায় ক্ষমতায় আসার আগে তিনি এবং রাম চট্টোপাধ্যায় নাকি চুপিচুপি এঁদের সঙ্গেই দেখা করতে দণ্ডকারণ্যে ছুটেছিলেন।
লেখক ছোট ছোট অপ্রাপ্তি অনেকটাই ভুলিয়ে দিয়েছেন বইয়ের দ্বিতীয় অংশে ন’জন মানুষের মৌখিক সাক্ষ্যের বিবরণ দিয়ে। সেখানে উপস্থিত মরিচঝাঁপিতে প্রত্যক্ষ ভাবে নিপীড়িত মনা গোলদার বা সন্তোষ সরকারের মতো মানুষ। আছেন সেই সময়ের আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত বা সেই মানুষদের অধিকার নিয়ে পরবর্তী সময়ে আইনি লড়াই করা অ্যাডভোকেট শাক্য সেন। আছেন নিরঞ্জন হালদার, জ্যোতির্ময় মণ্ডল, সফল হালদার। আছেন দলিত মানুষদের অধিকার নিয়ে নিরলস ভাবে লড়াই করে যাওয়া লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী। সর্বোপরি, এই তালিকা আলো করে আছেন তৎকালীন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ও। এই সমস্ত মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রায় ভুলতে বসা বছর চল্লিশ পার করা মরিচঝাঁপিকে লেখক পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। আবার ‘মরিচঝাঁপি অপারেশন’-এর দায়িত্বে থাকা তৎকালীন চব্বিশ পরগনার আরক্ষাধ্যক্ষ অমিয়কুমার সামন্ত যে তাঁকে সাক্ষাৎকার দিতে চাননি, সে কথাও উল্লেখ করতে ভোলেননি দীপ। অমিয়বাবু ঠিক কোন ‘বোধ’ থেকে বিরত রইলেন তা খুব জানতে ইচ্ছে করে। তবে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের প্রেক্ষিতে আরও কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া গেলে হয়তো বৃত্তটা সম্পূর্ণ হত। আসলে বইটির তাৎপর্য বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে এনআরসি হাওয়ায়। তাই প্রত্যাশাও পাহাড়প্রমাণ।
‘ওরাল টেস্টিমনি’-র প্রবক্তাদের মতে মৌখিক সাক্ষ্য হল মূলত একটি ‘লিসনিং আর্ট’ বা ‘শোনার শিল্প’। লেখকের কাজ মূলত সেখানে উপস্থিত থেকে ইতিহাস ও গল্পের সম্পর্ক স্থাপন করা। যদিও দীপ হালদার বইয়ের দ্বিতীয় লাইনেই লিখছেন যে মরিচঝাঁপি তাঁর ‘ওল্ডেস্ট মেমরি’। তাঁর অনেক ভালমন্দের ঘুমপাড়ানি গানে মিশে আছে মরিচঝাঁপি। তাই মূলত এই ‘ওরাল হিসট্রি’র ‘সাগা’ রচনায় ব্যক্তি দীপ হালদার মৌখিক সাক্ষ্য জড়ো করা দীপ হালদারকে ছাপিয়ে গেলেন কিনা, সে বিচার পাঠকের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy