অনবদ্য কিছু উর্দু গল্পের ইংরেজি তর্জমা পাঠকের সামনে হাজির করার থেকেও এই সঙ্কলনের একটা বৃহত্তর উদ্দেশ্য রয়েছে বলেই মনে হয়। রকশন্দা জলিল বইটির নির্মাণই করেছেন এক ভ্রান্ত ধারণাকেন্দ্রিক বিতর্ক ঘিরে, দুই মলাটের মধ্যে যার সমাধান করে ফেলা সহজ কাজ নয়। আপত্তি উঠবেই, উর্দু ভাষার গল্পের সঙ্কলন করতে লেখকদের ধর্মীয় পরিচয়ের উল্লেখ প্রয়োজন হল কেন?
আসলে এই সঙ্কলন সেই আপত্তিরই ফসল। সম্পাদক ধন্যবাদার্হ এই কারণেই যে, উর্দুর ধর্মীয় বিভাজন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়— এমন ভাব করে তিনি এ বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়ার পরিবর্তে এই ধর্মীয় বিভাজনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভ্রান্তিটাকে স্বীকার করে, তাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন কিছু অনবদ্য সাহিত্যসৃষ্টির উদাহরণ হাজির করে। উর্দু মুসলমানদের ভাষা— এ ধারণা ভীষণ বিপজ্জনক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিভাজন সৃষ্টির হাতিয়ার। কিন্তু তা এ দেশের মানুষের এক বিপুল অংশের মনের গভীরে গেঁথে আছে। তা যাতে গেঁথেই থাকে তা সুনিশ্চিত করে চলেছেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ক্ষমতাবান রাজনীতিকদের একাংশ।
এর মূলে আছে সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী অবলোকন। ত্রয়োদশ শতক থেকে হজ়রত আমির খুসরোর মতো বহুমুখী জিনিয়াস যে ভাষায় তাঁর বিপুল রচনার উল্লেখযোগ্য অংশ লিখছিলেন তা ‘হিন্দওয়ি’, ‘খড়িবোলি’, ‘দেহলভি’ এবং পরবর্তী কালে ‘রেখতা’ বলে পরিচিত ছিল। আরও অনেক পরে তা পরিচিত হয় ‘হিন্দুস্থানি’ নামে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সে ভাষায় লিখতেন, এবং সব থেকে বড় কথা সে ভাষায় কথা বলতেন। ‘উর্দু’ নামে সে ভাষা পরিচিত হতে, পণ্ডিতদের মতে, কম সে কম আরও পাঁচশো বছর লেগেছিল। শামসুর রহমান ফারুকির মতে, “ভাষাটার নাম হিসাবে ‘উর্দু’ সম্ভবত দেখা দেয় ১৭৮০-র আশেপাশে।” মোগল সাম্রাজ্যের পিদিম তখন নিবু-নিবু। কেউ তখনও বলেনি— এ তো মুসলমানদের ভাষা।
হুজ় উর্দু ইজ় ইট এনিওয়ে? স্টোরিজ় বাই নন-মুসলিম উর্দু রাইটারস
সম্পা ও অনু: রকশন্দা জলিল
৪৯৯.০০
সাইমন অ্যান্ড শাস্টার
সে কাণ্ড ইংরেজ ঔপনিবেশিক ভারতচর্চা এবং ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির ফসল। শ্রীরামপুরের পাদরিরা ১৮০৯ সালে একে দেগে দিয়েছিলেন ‘মহমেডান কন্করার’দের ভাষা হিসাবে। এর পর একের পর এক সাহেব পণ্ডিত এই ভাষ্যকে পাকাপোক্ত করতে থাকেন। তার পর ইতিহাসের জটিল মারপ্যাঁচে উর্দু বনাম হিন্দি হয়ে দাঁড়াল নাগরি লিপির ভাষা বনাম পারসিক লিপির ভাষা। এর সঙ্গে যুক্ত হল হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাষ্য। উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও উগ্র মুসলমান জাতীয়তাবাদ মিথোজীবী। ভাষার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। এই সময়ে আলিগড় আন্দোলন থেকেই উর্দুকে মুসলমান সম্প্রদায়ের ভাষা হিসাবে প্রচার করতে থাকেন বহু মুসলমান নেতা। স্বাধীনতার পরে এই ধারাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার শুরু হয় সীমান্তের দু’পারেই, এবং তা আজও অব্যাহত।
সম্পাদক সেই বিতর্কে সু্স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। বইয়ের ভূমিকা শুরুই হয়েছে এ সংক্রান্ত একাধিক প্রশ্ন উত্থাপন করে, এবং তাঁর মতে এই ভ্রান্তি, ‘মিথ’, চুরমার করার উপরেই ভাষা হিসাবে উর্দুর টিকে থাকা নির্ভর করবে। ষোলো জন ‘অ-মুসলমান’ লেখকের ষোলোটি উর্দু গল্পের ইংরেজি তর্জমা সঙ্কলিত করাকে তিনি সেই ‘মিথ’ ভাঙার কাজে আর এক ঘা হাতুড়ি মারার মতো ব্যবহার করতে চান। অ-মুসলমান লেখকরাও উর্দুতে লেখেন এ নতুন কথা নয়, বস্তুত তা বহুলচর্চিত। কাজেই বার বার এ কথাটা বলতে থাকা জরুরি হলেও যথেষ্ট কি? না-ই হোক, তবু হাতুড়িটা মারা দরকার, মারতেই থাকা দরকার, যত দিন না এ নিয়ে যথেষ্ট জনমত তৈরি হয়ে ধর্মীয় বিভাজনের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক স্বার্থে উর্দুর ব্যবহার বন্ধ হয়।
উর্দুকে ধর্মের বেড়ি পরানোর বিপক্ষে সওয়ালকেই সঙ্কলনটির উদ্দেশ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করায় তার মূল বিষয় যে ষোলোটি অনবদ্য ছোটগল্প তা কিছুটা আড়ালে চলে গিয়েছে। প্রসঙ্গত, রকশন্দা জানিয়েছেন সজ্ঞানেই তিনি উর্দু সাহিত্যের অ-মুসলমান দিকপালদের তালিকা থেকে প্রেমচন্দ, উপেন্দ্রনাথ অশ্ক, রাম লাল প্রমুখকে বাদ দিয়েছেন স্থানাভাবে। রয়েছেন কিষণ চন্দর, রাজিন্দর সিংহ বেদি, মহিন্দর নাথ, দেবেন্দর সত্যার্থী, কানহাইয়ালাল কপূর, রামানন্দ সাগর, সরলা দেবী, দেবেন্দর ইস্সার, সুরেন্দ্র প্রকাশ, এম কে মহতাব, রতন সিংহ, বলরাজ কোমল, যোগিন্দর পল, দীপক বুদকি, রেণু বেহল এবং গুলজ়ার। সঙ্কলনটির লেখকেরা সম্মিলিত ভাবে গোটা বিশ শতক ছাপিয়ে বর্তমান কালেরও প্রতিনিধি। আমার মনে হয়েছে, উর্দুর ধর্মীয়করণ বিতর্কের বাইরে সাহিত্যের বিচারেও এই সঙ্কলন আধুনিক উর্দু লেখালিখির এক উল্লেখযোগ্য সঙ্কলন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)