E-Paper

বুদ্ধিজীবীর কী ও কেন

আলোচ্য বইটির দুই খণ্ডের ব্যাপ্তিতে সম্পাদক বুঝি এই ধরনের কিছু প্রবন্ধ সঙ্কলিত করার চেষ্টা করেছেন, যেখানে সাইদের এই কথাগুলোই নানা ভাবে অনুরণিত হয়েছে।

সুমিত চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৫৮

এক দিকে ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দের উৎপত্তি ও বিস্তার বিষয়ে তর্ক আর চর্চা, আর অপর দিকে অনেক বেশি মূলগত প্রশ্ন, ‘বুদ্ধিজীবী কে?’, এই বিষয় নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা— এই দুইয়ের সঙ্গেই বাঙালি পাঠকের পরিচিতি অনেক দিনের। এই চর্চার বিবিধ আলোচনার ধারা যেমন আমাদের দেশীয় সাংস্কৃতিক বা বিদ্যায়তনিক পরিসর যথা দর্শন বা সাহিত্য থেকে আহৃত, তেমনই বিদেশীয় বিদ্যাচর্চার অভ্যাসজাতও বটে। অতএব, বুদ্ধিজীবী কে বা এই শব্দবন্ধের সম্ভাবনা বিষয়ে মতের একটা বহুলতা রয়েছে। এক দিকে যেমন প্রাচীন মহাকাব্যে অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণের বাণী বুদ্ধিজীবীর কণ্ঠস্বর বলে পড়া চলে সেই বঙ্কিমের উনিশ শতক থেকেই, তেমনই অপর দিকে ফরাসি দার্শনিক জুলিয়েন বেন্ডা জিশুকে ‘ফিলসফার কিং’ আখ্যা দিয়েছেন তাঁর লেখায়, এবং বুদ্ধিজীবী বা ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৯৩ সালে এডওয়ার্ড সাইদ তাঁর ‘রিথ লেকচারস’ বক্তৃতামালায় আবার শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবী কে এই বিষয়ে নিজের আলোচনা সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজে তাঁর কী কাজ এই বিষয়েও আলোকপাত করেছেন: “দি ইন্টেলেকচুয়াল ইজ় অ্যান ইন্ডিভিজুয়াল এনডাউড উইথ আ ফ্যাকাল্টি ফর রিপ্রেজ়েন্টিং, এমবডিয়িং, আর্টিকুলেটিং আ মেসেজ, আ ভিউ, অ্যান অ্যাটিটিউড, ফিলসফি অর ওপিনিয়ন টু, অ্যাজ় ওয়েল অ্যাজ় ফর, আ পাবলিক।” অর্থাৎ, বুদ্ধিজীবীর রাজনৈতিক পরিসরটাও ছকে দিতে চেয়েছেন তিনি। বুদ্ধিজীবীর কাজ ক্রমাগত অস্বস্তিকর প্রশ্ন উত্থাপন করা, প্রাতিষ্ঠানিক লোভ সংবরণ করা, আর যাঁদের ভুলে যাওয়া হয়েছে ক্রমাগত তাঁদের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া।

আলোচ্য বইটির দুই খণ্ডের ব্যাপ্তিতে সম্পাদক বুঝি এই ধরনের কিছু প্রবন্ধ সঙ্কলিত করার চেষ্টা করেছেন, যেখানে সাইদের এই কথাগুলোই নানা ভাবে অনুরণিত হয়েছে। দু’টি সঙ্কলনের প্রবন্ধসমূহকে কিছু বিষয়ভিত্তিক নিরিখ দেওয়ার চেষ্টা বিলক্ষণ করেছেন সম্পাদক। প্রথম খণ্ডে যেমন ‘প্রসঙ্গ বুদ্ধিজীবী’ বিভাগে সাধারণ ভাবে বুদ্ধিজীবী বিষয়ে কিছু প্রবন্ধ রয়েছে। যথা, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বুদ্ধিজীবী শ্রেণী’, প্রদীপ বসুর ‘সর্বজনীন বুদ্ধিজীবী, বিশেষ বুদ্ধিজীবী’ অথবা অভ্র ঘোষের ‘মেধাজীবীর স্বাধিকার’। দ্বিতীয় বিভাগ ‘নারীর চোখে বুদ্ধিজীবী’ অংশে রয়েছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘নারীর বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হিংসা ও পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা’ বা শাশ্বতী ঘোষের ‘নীরবতার আমরা-ওরা’ প্রবন্ধ।

তেমনই দ্বিতীয় খণ্ডটিতে বিষয়ের বিস্তার আরও খানিক ব্যাপ্ত। ‘গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবী’, ‘সংস্কৃতিচর্চা ও বুদ্ধিজীবী’, ‘কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবী ও ছিন্নমূল বাঙালি বুদ্ধিজীবী’ অথবা ‘আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা’— এই ভাবে পর্যায় বিভাজন করেছেন সম্পাদক। এ ছাড়াও দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে দু’টি সাক্ষাৎকার আর অন্নদাশঙ্কর রায় ও অশোক মিত্রের দু’টি বিখ্যাত প্রবন্ধের পুনর্মুদ্রণ। স্পষ্টত, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই দু’টি খণ্ডেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ জায়গা করে নিয়েছে।

সংস্কৃতির সংকট ও বুদ্ধিজীবী ১, ২

সম্পা: অনিল আচার্য

৪৮০.০০, ৫৭০.০০

অনুষ্টুপ

সঙ্কলনের একটা মূল চিন্তার সূত্র রয়েছে— সংস্কৃতির সঙ্কট। যদিও, দুই খণ্ডের ভূমিকায় পশ্চিমবঙ্গের তথা বাঙালি বুদ্ধিজীবীর বর্তমান অবস্থান আর রাজনীতি নিয়ে খানিক চর্চা করলেও, ‘সংস্কৃতি’ বলতে সম্পাদক ঠিক কী বুঝিয়েছেন তা খুব স্পষ্ট হয় না। ‘সংস্কৃতি’ বা ‘কালচার’ শব্দটি ব্যুৎপত্তিগত ভাবেই যথেষ্ট জটিল, ব্যাপ্ত, বহুস্বরী। তাই সঙ্কলনের মূল সুর গড়ে দিতে ঠিক কোন কোন স্বর অর্থাৎ কোন কোন দিক নিয়ে চর্চা হতে চলেছে এবং কোন কোন যুক্তিতে, সেই আলোচনা খানিক থাকলে ‘সঙ্কট’ শব্দটির ব্যবহারগত তাৎপর্য বিষয়ে আরও একটু নিশ্চিত হতে পারতেন উৎসাহী পাঠক। অনিশ্চয়তার দু’টি উদাহরণ দেব। সঙ্কলনদ্বয়ের শিরোনাম হিসাবে ‘সংস্কৃতির সংকট’ আর দ্বিতীয় খণ্ডের একটি পর্যায়ের শিরোনাম হিসাবে ‘সংস্কৃতিচর্চা’, এই দুইয়ের ‘সংস্কৃতি’র ভেদ-অভেদ নিয়ে সম্পাদকীয় মতামত জানতে মন চায়। তেমনই, দু’টি খণ্ডে যে বর্গগুলির সাপেক্ষে প্রবন্ধগুলি বিন্যস্ত হল, সেই বর্গবিন্যাসের যুক্তিগুলি কী কী, সে প্রশ্নও শেষাবধি রয়ে যায়। যেমন, ‘কমিউনিস্ট’ আর ‘ছিন্নমূল’ এই দুই ‘ক্যাটেগরি’র বুদ্ধিজীবী কেন একই পঙ্‌ক্তিতে এলেন— এই ধরনের সম্পাদকীয় আলোচনা নতুন প্রজন্মের পড়ুয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।

আগেই বলেছি, বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা, কর্তব্য ও স্মর্তব্য বিষয়ে অনেকগুলি মননশীল প্রবন্ধ জায়গা করে নিয়েছে এই সঙ্কলনের দু’টি খণ্ডে। প্রায় প্রত্যেকটি প্রবন্ধই বিস্তারিত আলোচনার অভিমুখ উন্মোচিত করতে সক্ষম। সীমিত পরিসরে তা অসম্ভব। তাই যে দু’টি প্রবন্ধ পড়ে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি, অন্তত সেগুলির কথা পাঠককে জানিয়ে শেষ করতে চাই। আনন্দ পেয়েছি শুধুমাত্র আলোচনার বিষয় চয়নে নয়, সরস আর প্রাণময় উপস্থাপনায়। ‘মস্তকবিক্রয় এবং বোঝার বোঝা’ প্রবন্ধে অরিন্দম চক্রবর্তী আলোচনা করেছেন বুদ্ধিজীবী কে, তাঁর দায়, তাগিদ এবং বিক্রি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি প্রসঙ্গে। বাকপটু দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী শব্দের অনেকগুলি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁর লেখায়। শেষে দিয়েছেন এক অব্যর্থ সংজ্ঞা: “বিশেষত সার্থক-নিরর্থক মেশানো সালংকার শব্দাবলী প্রয়োগ করে শ্রোতা, পাঠক, ছাত্রছাত্রীদের বুদ্ধিতে ধাঁধা লাগানোই যাঁদের জীবনের উদ্দেশ্য— তাঁরাই বুদ্ধিজীবী।” তাঁর মেধাবী ফিচলেমির আরও নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে মনোজ্ঞ রচনার এ দিক-ও দিক: “আজকাল তো বুদ্ধিজীবীরা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ‘সেন্টার’ সমূহে কেন্দ্রীভূত। সেন্টারগুলি থেকেই মার্জিন দরদী চিন্তা করা সম্ভব হয়।” সিরিয়াস লেখা পড়তে পড়তে অজানতেই হেসে উঠবেন পাঠক। তবে ছাপার নিতান্ত অযত্ন বিশেষত এই লেখাটিতে বড় চোখে লাগে। হরফের আচমকা সাইজ় বদল, আর লেখা জুড়ে অজস্র অযথা ইনডেন্ট শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, রীতিমতো বিভ্রান্তিকর। বস্তুত মুদ্রণপ্রমাদ কমবেশি দু’টি খণ্ড জুড়েই ছড়িয়ে।

যা-ই হোক, অরিন্দমের পাশাপাশি উল্লেখ করব স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘বু. জী. কি করে বুঝি?’। লেখাটির সঙ্গে চমৎকার সঙ্গত করে হিরণ মিত্রের স্কেচ। লেখাটি নেহাতই জাত সাহিত্যিকের অনায়াস কলম চালানোর ফল। গবেষণাপ্রসূত জটিল লব্‌জের কারবার না, নির্ভেজাল পেজোমি আর বিষয় নিয়ে সাবলীল খুনসুটি। বঙ্কিমের ‘বাবু’ প্রবন্ধের ঢঙে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা দেন স্বপ্নময়: “বুদ্ধিজীবীদের সাধারণত দাড়ি থাকে। থুতনিতে কিংবা সারা গালে। পেকে গেলে যাঁরা কলপ করেন, তাঁরা পুরোটা করেন না। কিছুটা রেখে দেন।… এঁরা কালো কফি খান... এঁদের অম্বল হয় খুব।” পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়ার দায় সাহিত্যিকের নেই। তাই অনায়াসে লিখে দিতে পারেন, “যাদবপুরে ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে শতকরা যতজন আঁতেল হয়, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নিশ্চয়ই এর চেয়ে কম পাবেন।” বলা যায় সঙ্কলনের গাম্ভীর্যের সঙ্গে খাপ খায় না বলেই, এই নিখাদ রম্যরচনা আরও বেশি করে স্থান করে নিতে পারে এই সঙ্কলনে। শুধু এ রকম সরস উপস্থাপনার কারণেই নয়, উপরের বিভাগগুলিতে প্রায় চল্লিশটি বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধের সন্নিবেশে, গত পাঁচ দশকে বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে শিক্ষিত বাঙালির ভাবনাবৈচিত্রের একটি অনন্য আকর হয়ে থেকে যাবে এই সংগ্রহযোগ্য সঙ্কলনযুগল।


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy