বাংলার নবজাগরণের কেন্দ্রে ছিল স্ত্রীশিক্ষা, নারী স্বাধীনতার দাবি, যা সাবেক সমাজের শিকড় ধরে টান দিয়েছিল। অন্দরমহলের ভাঙাগড়া সমাজে প্রবল আলোড়ন তোলে। সেই অস্থির সময়ে বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির। বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জ্যেষ্ঠ কন্যা সৌদামিনীকে কিছু দিন পাঠিয়েছিলেন সেখানে। তবে পড়াশোনা, সঙ্গীতশিক্ষা প্রধানত হত বাড়িতেই। সেই ফাঁকটুকু পেয়ে বধূ-কন্যারা তাঁদের প্রতিভা, সৃষ্টিশীলতার অসাধারণ স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। ঠাকুর পরিবারের নারী-পুরুষ অনেকে আত্মজীবনী লিখেছেন, রবীন্দ্রচর্চার একটি মাত্রা হয়ে উঠেছে রবীন্দ্র-পরিমণ্ডলের মানুষদের জীবনী চর্চা। চিত্রা দেবের ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল আলোকপাত করেছিল এই মেয়েদের উপরে। ফলে জ্ঞানদানন্দিনী, স্বর্ণকুমারী, সরলা বা দেবিকারাণী, জনজীবনে যাঁদের ভূমিকা সমকালেই চর্চিত, তাঁরা ছাড়াও বাঙালির আলোচনার বৃত্তে প্রবেশ করেছেন সাহানা ঠাকুর, প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী, অমিতা ঠাকুরের মতো মেয়েরাও, জীবদ্দশায় যাঁরা অনেকটাই প্রচ্ছন্ন। এই বইয়ের প্রবন্ধে দ্বারকানাথের মা অলকাসুন্দরী থেকে রয়েছেন বর্তমান প্রজন্মের অস্মিতা ত্রিবেদী, যাঁর পূর্বমাতৃকা (পিতামহের পিতামহী) অবনীন্দ্রনাথের বোন সুনয়নী দেবী।
ঠাকুরবাড়ির নারীশক্তি ও বঙ্গসংস্কৃতি
সম্পা: গৌর খাঁড়া
৬০০.০০
পান্থজন
এই মেয়েদের জীবনে খেলা করেছে আলোছায়ার দ্বন্দ্ব: এক দিকে প্রগতিশীলতার প্রেরণা, নতুন চৌকাঠ পেরোনোর উত্তেজনা, অন্য দিকে রক্ষণশীলতার শিকলে টান লেগে রক্তপাত। এই দ্বৈতের দোলাচলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও অচেনা ঠেকেন। ভাইপো বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু হল, তাঁর স্ত্রী সাহানা তখন কিশোরী। সাহানার পরিবার বিধবাবিবাহ দিতে উদ্যোগী হল, মহর্ষি আদেশ দিলেন পৌত্রবধূকে ফিরিয়ে আনতে। তিনি অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ পছন্দ করতেন না। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ কাজে অসম্মত হলেন। গেলেন রবীন্দ্রনাথ, ফিরিয়েও আনলেন তাঁকে। সাহানা শান্তিনিকেতনে বিজ্ঞান পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে উৎসাহ দেননি রবীন্দ্রনাথ; ল্যাবরেটরিতে সবার সামনে সাহানাকে বেরোতে হবে, তা কী করে সম্ভব? পরে নিজের পুত্র রথীন্দ্রনাথের বিধবাবিবাহ দেন, সে অবশ্য সুবিদিত। কবিকন্যা মাধুরীলতা চিঠি লিখেছেন, বাবার সব উপদেশ তিনি প্রাণপণে পালন করবেন। কী সেই উপদেশ? “আমার স্বামী যে আমার চেয়ে সকল বিষয়ে শ্রেষ্ঠ এবং আমি যে তাঁর সমান নই এটা বরাবর মনে রাখব।” মাধুরীলতা অল্প কিছু গল্পও লিখেছিলেন, বিষয় নির্বাচনে যেগুলি বেশ ব্যতিক্রমী, দেখিয়েছেন ঋতম্ মুখোপাধ্যায়।
স্ববিরোধিতা মেয়েদের মধ্যেও। গোপা দত্ত ভৌমিক দেখিয়েছেন, সরলা দেবী চৌধুরাণী সারা জীবন মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাতন্ত্র্যের জন্য সওয়াল করেছেন, অথচ তিনি অপুত্রক হিন্দু পুরুষের পুনর্বিবাহ সমর্থন করেছিলেন। প্রথম পত্নী স্বেচ্ছায় দ্বিতীয়াকে নির্বাচন করে ঘরে তুলে স্বামীর প্রেমের ভাগীদার করবেন, “এই হল রক্ত-পরম্পরাগত হিন্দু সভ্যতা।” রেনেসাঁস-এর একটি লক্ষণ অন্তর্দ্বন্দ্ব, বলেছিলেন অধ্যাপক যশোধরা বাগচী। ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় জন্মানো ভারতীয় আধুনিকতার কেন্দ্রে রয়েছে এই অন্তর্দ্বন্দ্ব। বইয়ে প্রায় প্রতিটি চরিত্রে এই সংঘাতের চিহ্ন মেলে। অবাক করে এই মেয়েদের প্রতিভাও। যাঁরা ‘অসামান্যা’ বলে পরিচিত নন, তাঁদেরও অনেকের লেখায়, আঁকায়, চিঠিপত্রে চিন্তার অতুলনীয় গভীরতা, সৌকর্য পাওয়া যায়। একটি ব্যতিক্রমী পরিবার, একটি বিশিষ্ট সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে এই সুখী-দুঃখী, সার্থক-বিফল মেয়েরা যেন আজও কথা বলে।
নজরে
ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জঙ্গল পাহাড় সমভূমি মালভূমি জুড়ে থাকেন অসংখ্য মানুষ, বহু যুগ ধরে যাঁরা একই জায়গায় বসবাস করেও কোনও কারণে প্রান্তিক হিসেবেই আজও বিবেচিত। আদিবাসী, জনজাতি, বনবাসী— নানান পরিচয় তাঁদের। এ দেশের হিন্দুত্ববাদের উত্থানের সঙ্গে এই বিশাল সমাজটির সম্পর্ক জটিল। ‘অখিল ভারতীয় বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’ (বা, শেষ তিন শব্দের আদিধ্বনি দিয়ে তৈরি সংক্ষেপনাম ভিকেএ)-কে কেন্দ্র করে এই জটিল সম্পর্ক উন্মোচন করতে চেয়েছে বইটি। ১৯৫২ সালে আরএসএস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন অনলস ভাবে কাজ করেছে, দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রচার ও প্রসারের জন্য। প্রথমে মধ্যপ্রদেশে তৈরি হলেও ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে ছত্তীসগঢ়, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশায়। আজকের ভারতের পরিবর্তনশীল মুখটিকে বুঝতে হলে, বা হিন্দুত্ব রাজনীতির সমস্যাগুলিকে ধরতে হলেও, ভিকেএ-র ইতিহাস অনেক দূর সহায়ক হতে পারে। অর্থাৎ বইটি জরুরি।
আদিবাসী অর বনবাসী: ট্রাইবাল ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য পলিটিক্স অব হিন্দুত্ব
কমল নয়ন চৌবে
৭৯৯.০০
পেঙ্গুইন র্যানডম হাউস
জনজাতিদের হিন্দুত্বের মোড়কে মুড়ে ফেলা আরএসএস-এর পুরনো প্রকল্প। তবু পুরো সাফল্য আসেনি। জনজাতির অনেকেই নিজস্বতা ছাড়তে প্রস্তুত নয়, হিন্দুত্বের খাতিরেও। প্রসঙ্গত, রাহুল গান্ধী বলেন, বিজেপি-আরএসএস জনজাতি-দের ‘বনবাসী’ বলে কেননা তারা এঁদের স্থায়ী অরণ্যভিত্তিক অস্তিত্বের পক্ষে— স্থানিক পরিবর্তন বা নাগরিক জীবনের বিপক্ষে। প্রশ্ন হল, জনজাতিরা কতখানি পরিবর্তন চায়, কতখানি চায় না। ভিকেএ-আখ্যানে স্পষ্ট, জনজাতিরা তত ক্ষণই হিন্দুত্বের পতাকায় নিজেদের মুড়ে ফেলতে প্রস্তুত যত ক্ষণ তাঁদের অভ্যন্তরের মূল সত্তাপরিচিতিটি ধাক্কা না খাচ্ছে। এই জন্যই আরএসএস অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউসিসি)-র ঘোর প্রচারক, কিন্তু ভিকেএ তার বিপক্ষে। উত্তর-পূর্ব ভারতে জনজাতীয়দের গোমাংস ভক্ষণেও তাদের আপত্তি নেই। আবার উল্টো দিকে, সব রকম জনজাতীয় সত্তার (যেমন সারনা) পূর্ণ অধিকার দিতেও ভিকেএ অসম্মত, কেননা তা বৃহত্তর হিন্দু পরিচিতিকে বিপন্ন করে ফেলতে পারে। সরু সুতোর উপর দিয়ে হাঁটা যাকে বলে। বইটির যুক্তিবিস্তার ও ভাষাব্যবহার খানিক দুর্বল। তবে তা অতিক্রম করে যায় বিষয়ের গুরুত্ব।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)