E-Paper

টাকা গুনে নেওয়া, জীবন বুঝে নেওয়া মেয়েরা

বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে টাকা গুনতে পারা মেয়েদের। এতেই বোঝা যায়, মেয়েদের অর্থনৈতিক বোধ নিয়ে এ সমাজ কতখানি হীনম্মন্যতা আমদানি করে চলেছে।

চৈতালি বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২৫ ০৭:৫১

নারীস্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে গেলেই নানা তত্ত্বকথা চলে আসে, কিন্তু লিঙ্গ-রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় প্রথমেই সমাজের একেবারে নীচের দিকে তাকানো জরুরি। ব্যবহারিক জীবনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা সেখানে শেখার পথ তৈরি করে। বাস্তবে এক জন উচ্চবিত্ত বাড়ির গৃহিণীর চেয়ে অনেক বেশি অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন এক জন পরিচারিকা। যিনি তাঁর মাসমাইনের টাকা সংসারের কোন খাতে কী ভাবে খরচ করবেন, সে বিষয়ে তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে। আলোচ্য বইটি এখানেই গুরুত্বপূর্ণ।

বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে টাকা গুনতে পারা মেয়েদের। এতেই বোঝা যায়, মেয়েদের অর্থনৈতিক বোধ নিয়ে এ সমাজ কতখানি হীনম্মন্যতা আমদানি করে চলেছে। সম্পাদক সমাজের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত মহিলাদের কলম একত্রিত করেছেন, লেখিকারা সমাজে মেয়েদের অর্থ-সামর্থ্যের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন নানা বাস্তব উদাহরণে। পনেরো জন নারীর কলমে পনেরোটি প্রবন্ধ সঙ্কলিত এই বইয়ে, যাঁরা খুব কাছ থেকে মেয়েদের রোজকার অর্থনৈতিক বোঝাপড়া চাক্ষুষ করে চলেছেন। সম্পাদক নিজেও জানাচ্ছেন, কী ভাবে এই সময়েও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লিঙ্গ-রাজনীতির শিকার হচ্ছেন প্রতিষ্ঠিত তথা স্ব-রোজগেরে মহিলারা।

জানাচ্ছেন, তাঁর আড়াই বছরের মেয়ে রাঁচীতে থাকাকালীন একটি ছড়া শেখে। ছড়াটি হল— “চান্দা মামা গোল গোল। সুরজ মামা গোল গোল। বাবা কা পয়সা গোল গোল। মা কি রোটি গোল গোল।” মর্মার্থ, বাবা পয়সা রোজগার করেন আর মা বাড়িতে বসে রুটি বানান। ভূমিকায় যশোধরা বলছেন, “আড়াই বছরের মেয়েকে অতি সহজে বলা গিয়েছিল, তোর তো মাও চাকরি করে, পয়সা রোজগার করে। তাই ওই ছড়ায় ওটা ঠিক বলা নেই।” তবে সহজ কথাটি সহজ করে বলে উঠতে পারেন না অনেকেই। যে কারণে নিজের অর্থনৈতিক অধিকার আজও কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নিতে বহু মেয়ে অপারগ। হয়তো তিনি চাকরি ও অর্থ উপার্জন করছেন, কিন্তু সেই অর্থ থেকে কতটুকু বাপের বাড়ির জন্য রাখবেন আর কতটা স্বামীর সংসারে দেবেন, তা-ও ঠিক করে দিচ্ছেন স্বামীই। সেবন্তী ঘোষ লিখছেন, ৫৯ শতাংশ কর্মরতা মেয়ে নিজের অর্থের বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ৮৯ শতাংশ বিবাহিতা মেয়ে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য স্বামীর উপরে নির্ভর করেন। আবার, ৪২ শতাংশ মেয়ে অর্থ সংরক্ষণ, অর্থলগ্নির বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন। গৃহবধূদের মধ্যে এই সচেতনতা মাত্র ১২ শতাংশ।

কড়ির ঝাঁপি

সম্পা: যশোধরা রায়চৌধুরী

৩০০.০০

সহচর

নারীর অর্থনৈতিক অধিকারের পাশাপাশি তার ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গও এসেছে। অনিতা অগ্নিহোত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, “নারী স্বাধীনতারই বা মানে কী? সে তো জন্মলগ্নেই স্বাধীন। তবে কি তাঁর স্বাধীনতা অন্য কারও হাত থেকে পাওয়া বরদান?” তাঁর মতে যা বাস্তবায়নের প্রয়োজন তা হল নারীর সমানাধিকার, যার পথে বাধা পুরুষশাসিত সমাজ। নারীর অবদমনকে তুলে ধরা হয় ক্ষমতার প্রতীক হিসাবে, যা নারীর অর্থনৈতিক সমানাধিকার আদায়ের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। স্বাতী ভট্টাচার্য অক্সফ্যাম-এর ‘দ্য ডিসক্রিমিনেশন রিপোর্ট’ উল্লেখ করে দেখিয়েছেন, ভারতে শহরাঞ্চলে স্বনিযুক্ত পুরুষদের গড় রোজগার মাসে প্রায় ষোলো হাজার টাকা আর মেয়েদের সাড়ে ছয় হাজার টাকা। অর্থাৎ, পুরুষদের রোজগার আড়াই গুণ বেশি। তিনি লিখছেন, “একই অঙ্কের ঋণ শোধ করতে পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের শ্রম দিতে হয় অনেক বেশি। এই তারতম্যের হিসাবটা কেউ করে না, কারণ শ্রমের বিনিময়ে মেয়েদের যে কিছু পাওয়ার কথা, সেটাই কেউ স্বীকার করে না।”

শতাব্দী দাশ মনে করাচ্ছেন, এখনও মেয়েদের গৃহপরিচর্যা শ্রম হিসাবে গণ্য করা হয় না। তাই এখনও গৃহবধূর কাজ অবৈতনিক। অথচ, গৃহকর্মের সহায়িকা সে কাজে টাকা পান, রাঁধুনি রান্না করলে মাইনে পান। সামাজিক, অর্থনৈতিক, পেশাগত যোগ্যতার মতো নানা ক্ষেত্রে মেয়েদের পিছিয়ে পড়ার প্রবণতা নিয়ে লিখেছেন লেখিকারা। সেখানে স্কুলছুট সমস্যা, সামাজিক রক্ষণশীলতার মতো প্রসঙ্গও এসেছে। স্বাতী রায় জানাচ্ছেন, নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে আর তা নিজেই ব্যবহার করেন এমন মেয়ের সংখ্যা ৭৮.৬ শতাংশে আটকে রয়েছে: “নিজের শরীরের বিষয়েই যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই, টাকা নিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন, এটা ভাবা বাতুলতা নয়?” অধিকার বুঝে নিতে অর্থনৈতিক সমানাধিকারই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। লেখাগুলি তথ্যসমৃদ্ধ, বাস্তব ঘেঁটে আসা সময়ের দলিল। তৃষ্ণা বসাক, মৌ সেন, রোহিণী ধর্মপাল, মধুরিমা দত্ত প্রমুখ সমৃদ্ধ করেছেন আলোচনার গতিমুখ। রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন বা সংসদে মেয়েদের আসন সংরক্ষণ নিয়ে যত ভাষণই হোক না কেন, বাস্তবে মেয়েদের ঘরে-বাইরের লড়াইয়ের ছবি উঠে এসেছে বইটিতে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy