ষোলো বছর স্বামীর ঘর করে মেহরুন এক দিন বাপের বাড়ি ফিরেছিল, কাউকে কিছু না বলেকয়েই। স্বামী ইনায়েৎকে বলার কোনও কারণ, সুযোগও ঘটেনি— মেহরুনের উপর থেকে তার মন উঠে গেছে, এমনকি সন্তানদের থেকেও; সে এখন পরনারী-আসক্ত। কিন্তু নিজের ঘরেও আশ্রয় দূরস্থান, দুটো ভাল কথা আর সান্ত্বনাও পেল না সে। দুই দাদা উল্টে বোঝাল কেন এ মেহরুনের হঠকারিতা, সাতসকালে এমন বেরিয়ে পড়াটা তার মোটেই কাজের হয়নি, আর “ও তো পুরুষ, নাহয় একটু পাঁকে পা-ই পড়়েছে, ও ঠিক জল পেলে পা ধুয়ে নিজের ঘরে ঢুকবে। পুরুষের গায়ে কি আর কলঙ্ক লেগে থাকে?”
পাড়ার চেনা ট্যাক্সি ডেকে, মেহরুন আর তার কোলের বাচ্চাটাকে তার মধ্যে সেঁধিয়ে দিয়ে দাদারা তাকে ফিরিয়ে আনে বাড়িতে। এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়ি, এ কি ফিরিয়ে আনা, না কি ফিরিয়ে দেওয়া? সন্ধে নামতে আলো জ্বলে ওঠে বাড়িতে আর চার পাশে, কিন্তু মেহরুনের মনে হয়, তার হৃদয়দীপটি বহুকাল আগেই নির্বাপিত, “কার জন্য সে বেঁচে থাকবে, কী লাভ? এই দেওয়াল, ছাদ, থালা, বাটি, চুলো, খাট, হাঁড়িকুড়ি, সামনের উঠোনে গোলাপচারা— ওর প্রশ্নে সবাই নিরুত্তর।”
হার্ট ল্যাম্প: সিলেক্টেড স্টোরিজ়
বানু মুশতাক, অনু: দীপা ভাস্তি
৩৯৯.০০
পেঙ্গুইন বুকস
এই গল্পের নাম ‘হার্ট ল্যাম্প’। গল্পসঙ্কলনটির নামও এটাই। আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জেতার পরে এত দিনে বানু মুশতাককে নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে, অথচ কর্নাটকে যে বন্দয়া সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর অঙ্গাঙ্গি যোগ সেটা আজকের নয়, মেঘে মেঘে বেলা হল কয়েক দশক। প্রগতিশীল, প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই সাহিত্য আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল চার পাশের আর্থ-সামাজিক অসাম্য ও বৈষম্যের তীব্র বিরোধিতা। কবিতা, গদ্য তথা সাহিত্যের আয়ুধেই এই আন্দোলনের শরিক লেখকেরা ‘বাঙ্ময়’ হয়েছিলেন, আর ফুটিয়ে তুলেছিলেন কর্নাটকের দলিত ও মুসলমান সম্প্রদায়ের জীবনযন্ত্রণা। এখনও পর্যন্ত রাজনীতি কথাটা এল না দেখে পাঠক ভাবতে পারেন এ আবার সেই ‘সামাজিক কিন্তু অরাজনৈতিক’-এর গল্প কি না, তবে প্রতিটি ব্যক্তিগতই যে চূড়ান্ত ভাবে রাজনৈতিক, তা বুঝতে আর কবেই বা ‘পার্টি পলিটিক্স’ করতে হয়েছে সমাজের ক্রমাগত ঘা খেয়ে চলা একটা অংশকে? কখনও তার নাম নারী, কখনও মুসলমান, কখনও— মুসলমান নারী।
বানু এই মেয়েদের দেখেছেন কাছ থেকে। তিনি শুধুই এক সাহিত্যসেবিকা নন, তিনি আইনজীবী, ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ও। আইন ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগসূত্রে নিশ্চয়ই তিনি চোখের সামনে দেখেছেন সেই নারী ও পুরুষ, মা ও সন্তান, পাড়াপড়শি, পরিবারগুলিকে— যাঁরা একাধারে পুরুষতান্ত্রিক ও অসহায়, শাসক ও শাসিত, শোষক ও শোষিত। এঁদের কথাই লিখেছেন তাঁর গল্পে। শায়েস্তা ভাবী, জ়িনত, আরিফা, আশরাফ, রাজ়িয়া, আসিফা, নাসিমা, মেহরুন, শাজ়িয়ার মতো মেয়েরা তাঁর এই বইয়ের প্রধান চরিত্র। নামগুলি বলে দেয় তাদের ধর্মপরিচয়, কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, সুদূর কর্নাটকের শহর ও শহরোপান্তের যে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মুসলমান জীবন উঠে আসে এদের সূত্রে, তা আমাদের সিংহভাগের শুধু অপরিচিতই নয়, অজানা। আমাদের কথাসাহিত্য আজকাল বাঁধা ছকের, চেনা মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত নাগরিক সম্পর্কের বৃত্তে ঘুরপাক খায় বেশি, সেখানে এই ধরনের চরিত্রেরা শুধু অনুপস্থিতই নয়, এক প্রকার অস্পৃষ্টও। অথচ এরা আছে চার পাশেই, এই কলকাতাতেই, পশ্চিমবঙ্গেই। অনেকেই হররোজ আমাদের গৃহকর্ম সামলাতে আসেন, অসুস্থ বা শয্যাশায়ীর পরিচর্যা করেন, মিড-ডে মিল থেকে অঙ্গনওয়াড়ি বা আশাকর্মী মহিলাদের ভিড়ে মিশে থাকেন। আমরা গল্পে-উপন্যাসে এঁদের কথা লিখি বটে, তবে কী এক অজানা কারণে তাঁরা হয়ে যান মালতী সবিতা গায়ত্রী রেখা ইত্যাদি— সে কি আমাদের আপাদমস্তক ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকতে হবে বলেই, না কি মুসলমান সহনাগরিক সম্পর্কে আমাদের লুকোনো দ্বেষ অবিশ্বাস আর তাঁদের রোজকার জীবন সম্বন্ধে আমাদের চরম অজ্ঞতা থেকে?
এই কারণেই বানু মুশতাকের এই বই পড়া দরকার আরও। তাঁর গল্পের হাত কেমন, বিষয়ভাবনা ও চরিত্রায়ণে তাঁর পুনরাবৃত্তি কি এক ধরনের ‘ট্রোপ’ না কি দুর্বলতা, গল্পগুলো সাহিত্যের বিচারে সার্থক ছোটগল্প হল কি না— এই ছানবিন নিশ্চয়ই করা দরকার, কিন্তু তার আগে এ কথাটা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে তবেই— বানু যে জীবন লেখেন সে জীবন আমরা জানি না, জানলেও বুঝি না, বুঝলেও বলি না, বললেও লিখি না। আমরা জানি সমাজের নিচুতলায় বহুবিবাহ ও নারীপীড়ন ঘটে, ছেলে সন্তান হয়নি বলে রিকশাচালক-অটোচালক স্বামীটি নিয়ম করে বৌ পেটায়, শিশুকন্যাদের দিকে ফিরেও তাকায় না, নেশাভাং করে পড়ে থাকে বা অন্য নারীসঙ্গ করে, এবং এই সবই হয় ধর্মনির্বিশেষে। কিন্তু দরিদ্র মুসলমান মেয়ের জীবন কেমন, ঘরে-বাইরে কী তার চ্যালেঞ্জ, তার ধর্ম শাস্ত্র সংস্কার আব্রু লোকলজ্জা ফতোয়া সালিশ কত রূপ ধরে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে চায়, ভিতর থেকে তা দেখতে ও দেখাতে আমাদের অধিকাংশ লেখক অপারগ। বানুর গল্পেরা এই অস্পৃষ্ট, উচ্ছিষ্ট মেয়েজীবনকে ক্লান্তিহীন, লজ্জাহীন কলমে তুলে ধরে। তুলে ধরে এলাকার ধর্মধ্বজী মাতব্বর মুতাওয়ালি সাহেবদের দ্বিচারিতা, পিতৃতন্ত্রের ঠিকা নেওয়া কাপুরুষ পুরুষদের পারিবারিক ফ্যাসিবাদকে।
সবই কি তা হলে নৈরাশ্যের দলিল? আলোর রেখাটুকু পর্যন্ত নেই? আছে। কখনও তা আসে সুশিক্ষিতা জ়ুলেখা বেগমের রূপ ধরে, যিনি অসহায়া আশরফকে বুঝিয়ে দেন কী তার অধিকার, কেমন হবে নারীর প্রতি পুরুষের আচরণ। ঘরের কোণে মুখ বুজে সন্তানজন্ম দিতে দিতে হাক্লান্ত বধূটি এক দিন বাইরে বেরোয় হাসপাতালে গিয়ে অপারেশন করিয়ে আসবে বলে। এ-ই তার প্রতিবাদ। আত্মহত্যার মুখ থেকেও ফিরে আসে কোনও মা— তারই কিশোরী মেয়েটির হাত ধরে। সে-ই তার নবজন্ম।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)