E-Paper

যে ভাবে দেখব, তেমনই

রামানুজন আলোচনা করেছেন জৈনদের রামায়ণে রাবণের গুরুত্ব। দক্ষিণ ভারতের ‘অস্পৃশ্য চারণ কবি’দের গাওয়া লোককাহিনিতেও রাবণ ও মন্দোদরী গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।

অলখ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৩০
সুদূরপ্রসারী: তাইল্যান্ডে এক মন্দিরের গায়ে রামায়ণের ছবি। উইকিমিডিয়া কমনস

সুদূরপ্রসারী: তাইল্যান্ডে এক মন্দিরের গায়ে রামায়ণের ছবি। উইকিমিডিয়া কমনস

মহাভারত শেষ হয়েছে শবরের তিরে কৃষ্ণের মৃত্যুতে, রামায়ণ শুরুই হয় নিষাদের তিরে মিথুনরত ক্রৌঞ্চের মৃত্যুতে। দুই ক্ষেত্রেই দুই শ্রমজীবী ও নিম্নবর্গের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের, দু’টি কাহিনির ভিতরেই রয়েছে এমন বেশ কিছু উদাহরণ। কিন্তু, মহাকাব্য দু’টি শ্রমজীবীদের রচনা নয়, উপস্বত্বভোগীদের রচনা। তবে দুই মহাকাব্যের, বিশেষ করে রামায়ণের যে প্রচুর সংস্করণ পাওয়া যায়, তার অন্দরে শ্রমজীবী-সহ সমাজের নানা শ্রেণির পাঠক-শ্রোতার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব লুকিয়ে রয়েছে কি না, সে প্রশ্ন গবেষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

এ কে রামানুজনের তিনশো রামায়ণ তেমনই এক বিশ্লেষণের দিকে ঠেলে দেয়। স্বাগতা দাশগুপ্ত যা অনুবাদ করে বাঙালি পাঠকের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। রামানুজন বলেন, “কামি বুল্ক নামে রামায়ণ-এর এক ছাত্র গুনে দেখেছেন রামায়ণ-এর তিনশোটা কথন আছে।” সেই কথনগুলিতে স্বভাবতই ফারাক অনেক। বাল্মীকির কাব্য রচনার নানা সম্ভাবনার মধ্যে একটি হল কথোপকথনের মাধ্যমে সঙ্কলিত হয়ে ওঠা, অর্থাৎ, পাঠক-শ্রোতাদের কাহিনি রচনায় সক্রিয় সম্পর্ক, যেখানে দ্বাদশ শতকের তামিল কবি কম্পন একা বসে তাঁর রাম-কাহিনি লিখেছেন। রামানুজন বলছেন, “বাল্মীকির কাব্যে রাম দেবতা নন, বরং দেব-মানুষ, যাঁকে মনুষ্যজীবনের সমস্ত সীমাবদ্ধতার মধ্যে বাঁচতে হয়।” কিন্তু কম্পন “তামিল ভক্তি-র দ্বারা প্রভাবিত। তাঁর গুরু ছিলেন নম্মালবার... বৈষ্ণব সাধক। কম্পনের কাছে রাম দেবতা, যাঁর লক্ষ্য অশুভের দমন, শুভের রক্ষণাবেক্ষণ আর সমস্ত প্রাণীর মুক্তি।”

রামানুজন সন্তোষ দেশাইয়ের মত অনুসরণ করে জানান, রামের গল্প তিনটি পথে ছড়িয়েছে: “স্থলপথে, উত্তরের রাস্তা পাঞ্জাব আর কাশ্মীর থেকে গল্পগুলো নিয়ে গেছে চিন, তিব্বত আর পূর্ব তুর্কীস্তানে; জলপথে দক্ষিণের রাস্তায় গুজরাট আর দক্ষিণ ভারতের গল্প পৌঁছেছে জাভা, সুমাত্রা আর মালয়; আর একটা স্থলপথে পূর্বের রাস্তা ধরে বাংলার গল্পগুলো পৌঁছে দিয়েছে বার্মা, থাইল্যান্ড আর লাওসে। ভিয়েতনাম আর কম্বোডিয়া তাদের গল্পগুলো পেয়েছে খানিকটা জাভা থেকে, আর খানিকটা ভারত থেকে পূর্বের রাস্তা ধরে।”

তিনশো রামায়ণ

এ কে রামানুজন,

অনু: স্বাগতা দাশগুপ্ত

১৫০.০০

একতারা প্রকাশনী

রামানুজন আলোচনা করেছেন জৈনদের রামায়ণে রাবণের গুরুত্ব। দক্ষিণ ভারতের ‘অস্পৃশ্য চারণ কবি’দের গাওয়া লোককাহিনিতেও রাবণ ও মন্দোদরী গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। আবার, সাঁওতাল জনজাতির মুখে মুখে ফেরা রামকথায় ‘সীতা ব্যভিচারী’। অদ্ভুত রামায়ণশতকণ্ঠরাবণা-তে সীতা প্রচণ্ড বীর, রাম দশগ্রীবকে হত্যা করার পরে সীতাই সহস্রগ্রীব রাবণকে হত্যা করেন। তাইল্যান্ডে রাম শিবের আজ্ঞাবহ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোথাও হনুমান খুব প্রিয় চরিত্র, তিনি সেখানে রামভক্ত ব্রহ্মচারী নন। অনুবাদের রকমফের নিয়েও রামানুজন বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। রামায়ণে নিহিত চিন্তার ইতিহাসে আগ্রহীদের কাছে এ বই গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।

‘কোঙ্কনি উপকূলে সাধারণ মানুষের মুখ ফেরতা’ রাম-কথা কুঙ্কনা রামায়ণ-এর অনুবাদ পড়লে মনে হয়, শ্রমজীবী, নিম্নবর্ণের পাশাপাশি সেখানে মধ্যবিত্তেরও প্রভাব। অনুবাদক অরিন্দম দাশগুপ্ত বলছেন, “কুঙ্কনা রামায়ণ কোনো স্বতন্ত্র কাহিনি নয়। ভারতের নানা প্রদেশ থেকে তার আগমন।” গুজরাত ও মহারাষ্ট্র, দুই রাজ্যের মূল ভাষা থেকে কুঙ্কনা ভাষা প্রচুর শব্দ ধারও করে।

কুঙ্কনা রামায়ণ

বাংলা রূপান্তর: অরিন্দম দাশগুপ্ত

২২৫.০০

রাবণ

বাল্মীকির রামের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে এই রচয়িতাদের চরিত্র অনেকটা বোঝা যায়। যেমন, ধর্ম ও অর্থের সাহায্যে সুখলাভ করতেন তিনি; নৃত্যগীত পারঙ্গম ছিলেন; গুপ্তচর রাখতেন, আবার কোলাহল এড়াতে নির্জনবাসী হতেন। দেবতাপ্রতিমও ছিলেন। যেমন ‘অমোঘক্রোধহর্ষশ্চ’, অর্থাৎ তাঁর ক্রোধ ও হর্ষ ব্যর্থ হত না। রামকে অভিষেকের আগে দশরথও কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। আশ্চর্য হল, সেখানেও দশরথ বলছেন, “তুমি বিনয়ী, তবু আরও বিনয়ী হয়ে তুমি তোমার ইন্দ্রিয়গুলি সংযত রেখো। কামক্রোধের মতো ব্যসনগুলি ত্যাগ কোরো।” যদি ধরে নেওয়া যায় রামায়ণের চূড়ান্ত রূপ যখন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল সেই সময়েই কালিদাসের রঘুবংশম্ রচিত, তবে সেখানে দশরথের এই পরামর্শ রাম কেমন ভাবে গ্রহণ করেন তার একটি প্রকাশ রয়েছে। যৌবরাজ্যে অভিষেক থেকে রাতারাতি বনে যাওয়ার সিদ্ধান্তের পরে কালিদাস বলছেন, অভিষেকের ক্ষৌমবসন ছেড়ে রাম বনগমনের উপযোগী বল্কল পরিধান করলেন কিন্তু “তাতে তাঁর মুখের ভাবান্তর ঘটল না।”

কুঙ্কনা রামায়ণ-এও রামের এই নির্লিপ্তি চোখে পড়ে। রামের বনবাসের কথা শুনে দশরথ বেহুঁশ, জ্ঞান ফিরলে নিতান্ত অনাড়ম্বর ভাবে রাম বলেন, “বাবা, আমি ঠিক করেছি জঙ্গলে গিয়ে থাকব।... এই নিয়ে মন খারাপ কোরো না।” বলেন, “জঙ্গলে থাকলে জীবন সম্পর্কে আমারও অভিজ্ঞতা বাড়বে।” এই শেষ বাক্যটিতে কুঙ্কনা রামায়ণ-এর রচয়িতাদেরও পরিচয়। বাল্মীকির রামায়ণের সঙ্গে এই সব কাহিনির ফারাক জানতে পাঠকের ভাল লাগবে। এখানে “যাবতীয় চরিত্র এমনকি রামও কাহিনিতে হাজির অতি সাধারণ মানুষ রূপে।” এতেই রচয়িতাদের পরিচয়ের সন্ধান মেলে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Short story book review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy