Advertisement
E-Paper

হৃদয়ের লড়াই স্বাধীনতার জন্য

অরুন্ধতীর মনে হয়, ফ্যাসিবাদ কি শেষ পর্যন্ত একটা ঘৃণার অনুভূতি? রাগ, ভয়, ভালবাসার মতোই কি সংস্কৃতিভেদে তার এক-এক রকম প্রকাশ ঘটে?

আবাহন দত্ত

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২১ ০৭:৩৫
অধিকার: অসমে এনআরসি-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। দিসপুর, ২০১৮।

অধিকার: অসমে এনআরসি-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। দিসপুর, ২০১৮।

আজ়াদি: ফ্রিডম ফ্যাসিজ়ম ফিকশন
অরুন্ধতী রায়
৪৯৯.০০
পেঙ্গুয়িন, হ্যামিশ হ্যামিল্টন

পুলওয়ামায় জঙ্গিহানা না ঘটলে কি মোদী সরকার ক্ষমতায় ফিরতে পারত? দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কি আসলে একপাক্ষিক গণহত্যা নয়? গত দু’বছর ধরে কাশ্মীরে যা চলছে, তাকে দখলদারি বলব না কেন? ‘নমস্তে ট্রাম্প’ সফরে ভারতের সম্মান নজিরবিহীন ভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়নি কি? প্রশ্নগুলি ভেসে বেড়ায়, প্রতিবাদী জমায়েতে শোনাও যায়। ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে জবাবগুলি দার্ঢ্যের সঙ্গে পাঠকের দরবারে সাজিয়ে দিয়েছেন অরুন্ধতী, এ বইয়ের গুরুত্ব এখানেই, তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধগ্রন্থের মতোই। তিনি যা বলেন-লেখেন, তা হয়তো সক্রিয় বামপন্থী কর্মী বা সরকার-বিরোধী আন্দোলনকারীর জানতে বাকি নেই, কিন্তু সাধারণ পাঠকের কাছে তুলে ধরার জরুরি কাজটি অরুন্ধতীই করেন। এমন হাতের তার ক’জনেরই বা থাকে?

গত লোকসভা নির্বাচনের বছরখানেক আগে লেখা এক প্রবন্ধে মোদী সরকারের ব্যর্থতা ও ভয়াবহতা তুলে ধরার সূত্রে আসে কিছু আশঙ্কিত প্রশ্নও। গৌরী লঙ্কেশের হত্যার পর জানা যায়, উগ্রপন্থী ‘সনাতন সংস্থা’-সহ অনেক দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের পুরোদস্তুর সন্ত্রাসবাদী জাল বিছানো আছে। অরুন্ধতী লিখছেন, “...আমাদের জন্য ওদের পরিকল্পনা কী? ভুয়ো সংঘর্ষ? না কি সত্যিকারের? সেটা কোথায় হবে? কাশ্মীরে? না অযোধ্যায়?” বলেন এলগার পরিষদ আর ভীমা-কোরেগাঁও’এর কথা, যে ‘চক্রান্ত’-এর সূত্রে দীর্ঘ দিন বন্দি গৌতম নওলখা, সুধা ভরদ্বাজ, রনা উইলসন-রা। অরুন্ধতীও তাঁদেরই দলে। গত আড়াই দশক ধরে দখলদার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কলম শাণিয়ে এসেছেন; সরকারে কে আছে, ভাবেননি। আদিবাসী, দলিত, মুসলমান— পিছিয়ে পড়া বর্গের লড়াইয়ের অংশীদার থেকেছেন। ইউপিএ আমলে অপারেশন গ্রিন হান্ট, সালোয়া জুড়ুম-এর বিপক্ষে, কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছেন, কংগ্রেসের চক্ষুশূল হয়েছেন, এসেছেন সরকারি আতশকাচের তলায়।

অরুন্ধতীর চোখে ভারত তাই ‘সাম্রাজ্য’। ‘বন্দুকধারী বাহিনী’র সাহায্যে তার এলাকাগুলো জোটবদ্ধ থাকে, আর শাসন চলে দিল্লি থেকে, যে শহর বহু ‘প্রজা’র কাছে লন্ডন বা নিউ ইয়র্কের মতোই দূরের। কাশ্মীরের রাজনীতি বা অসমের এনআরসি নিয়ে যখন কথা বলেন অরুন্ধতী, তখন সঙ্কটের চেনা ব্যাখ্যা ছাপিয়ে উঠে আসে নাগরিকের বিরুদ্ধে অতিকায় রাষ্ট্রের ক্রমাগত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কাহিনি। বস্তুত বর্তমান ভারতের নানা সংঘর্ষবিন্দুর যে ইতিহাস আমরা জানি, জনতার অভিমুখ থেকে অরুন্ধতী তার পাল্টা বয়ান তৈরি করেন। বৃহৎ পুঁজির ছকে বিপদগুলি দেখলে স্পষ্ট হয় যে, রাষ্ট্র ও জনতা যে কোনও সময় বা অবস্থাতেই দুই বিপরীত মেরুর অবস্থান— রাষ্ট্রীয় অত্যাচারে নিষ্পেষিত সর্বহারা জনতা। লেখাগুলি, অতএব, যৌথতার স্বপ্নও দেখায়। খবরে প্রকাশ, মাওবাদী যোগে গ্রেফতার তরুণের ‘সম্পত্তি’র তালিকায় রয়েছে ‘অরুন্ধতী রায়ের কিছু বই’। কর্পোরেট উদ্যোগে খনি ও পরিকাঠামো প্রকল্পে উদ্বাস্তু হন দশ সহস্রাধিক মানুষ, প্রতিবাদ করে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা নিয়ে জেলে যান অনেকে, তাঁদের ‘বয়ান’-এও অরুন্ধতীর অনুপ্রেরণা, পুলিশের ভাষায় ‘ভ্রান্ত পথ’।

এক-একটা প্রবন্ধ আরও গভীরে ভাবায়। অরুন্ধতীর মনে হয়, ফ্যাসিবাদ কি শেষ পর্যন্ত একটা ঘৃণার অনুভূতি? রাগ, ভয়, ভালবাসার মতোই কি সংস্কৃতিভেদে তার এক-এক রকম প্রকাশ ঘটে? যে ভাবে এক জন মানুষ প্রেমে ‘পড়েন’, সে ভাবেই কি একটা দেশ ফ্যাসিবাদে (পড়ুন, ঘৃণায়) ‘পড়ে’? ভারত তাতেই পড়েনি তো? অরুন্ধতীর মতো আমরা সকলেই দেখেছি, বর্তমান জমানা আর তার সমর্থকদের সৌজন্যে জনসংখ্যার এক বিশেষ অংশের বিরুদ্ধে ঘৃণায় বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। মনে পড়ে যায় শঙ্খ ঘোষের বক্তৃতা: “ফ্যাসিবাদ আমাদের স্বভাবের একটা অনিয়ন্ত্রিত চিৎকার।”

কল্পনার জন্যেও জায়গা ছেড়ে রেখেছেন অরুন্ধতী। নিজের দুই উপন্যাসের পিছনের গল্প শোনান, চরিত্রগুলো নিয়ে খেলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষণের হাত ধরে রূপক। অঞ্জুম বা মুলাকত আলির কথা শুনতে শুনতে কখন যে হিন্দি-উর্দু বিতর্কে ঢুকে পড়েন পাঠক, বোঝাই যায় না।

অরুন্ধতীর রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে। গভীর ও স্পষ্ট ভাবে। তাঁর কথায় তাই বিতর্ক হয়; হয়তো তিনি এমন ভাবেই সমালোচনা করেন, যাতে বিতর্ক তৈরি হয়, জরুরি ও না-বলা প্রশ্নগুলো ওঠে। এ বই আবারও মনে করিয়ে দেয় তাঁর চিরচেনা বক্তব্য— আমরা পরিস্থিতি দেখি ব্যবস্থার চশমায়, তাই প্রতিবাদ প্রতিরোধে পরিণত হয় না। ‘আজ়াদি’ শিরোনাম আসলে ওই ‘দেখা’র কথাই বলে— “শুধু পৃথিবীটাকে নতুন করে কল্পনা করা।

Arundhati Roy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy