আমার অনেক দিনের চিন্তা— বিদ্যাসাগরের লেখালিখির মধ্যে আমাদের আধুনিকতার চেহারাটা ধরতে চেষ্টা করা যায় কী ভাবে। আসলে আমরা যখন আধুনিকতার কথা ভাবি, আমাদের ভাবনায় তার সঙ্গে পাশ্চাত্যবাদ মিশে যায়। অথচ রামমোহন থেকে শুরু করে পরবর্তী কালের অনেকের মধ্যেই কিন্তু আধুনিকতাবাদের চেহারাটা ঠিক পাশ্চাত্যের স্ট্যান্ডার্ড আধুনিকতার মতো ছিল না। একটা আলাদা চরিত্রের আধুনিতার ছাঁদ তৈরি হচ্ছিল। পার্থক্যটা বুঝতে গেলে ছুটে গিয়ে উত্তর-আধুনিক তত্ত্বের শরণাপন্ন হওয়ার দরকার নেই— আমার মনে হয়, ওতে যেন এক দিকে বেশি করে হেলে গিয়ে একটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। আধুনিকতার বড় গল্পটাকে ছেড়ে না দিয়ে বরং আমরা বুঝতে চাইতে পারি, কী ভাবে ওই বড় গল্পটার ভিতরেই তার ছোট ছোট চেহারা ফুটে উঠছিল।
সাধারণত বিদ্যাসাগরের কথা ভাবলেই আমরা তাঁর ‘সংস্কারক’ দিকটার উপর জোর দিই। লেখক বিদ্যাসাগর, চিন্তক বিদ্যাসাগরের কথা আমরা বেশি ভাবি না। অথচ সেটা ভাবা উচিত। তাঁর একটা বড় পরিচয় সাহিত্যরচনা। আর সাহিত্যরচনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর ব্যাকরণভাবনা। ফলে এই দিকটা ভাবতে হলেই উঠে আসে পাণিনি-মুগ্ধবোধ-কলাপ চর্চার কথা। বিদ্যাসাগর মশাই যে নতুন ব্যাকরণ আদর্শের দিকে গেলেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ভাবনার রকমটা বোঝার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এ বিষয়ে আমার অধিকার নেই, তা-ও তাঁর সংস্কৃত-ভাবনা ও ব্যাকরণ-ভাবনা নিয়ে কয়েকটা কথা বলতে ইচ্ছে করে।
সংস্কৃত শাস্ত্রের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে বিদ্যাসাগরের সমালোচনা ছিল, যেমন বেদান্ত। তবে তাই বলে সংস্কৃতের ঐতিহ্যের গুরুত্ব তাঁর কাছে কম ছিল না। স্মৃতির উপর খুব জোর দিতেন, সংস্কৃত কলেজে স্মৃতি পাঠদানের বিষয়ে তাঁর বিশেষ উৎসাহ ছিল। যুক্তি দিতেন— স্মৃতি পড়লে সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের চাকরি বাড়বে, হিন্দু বিধিতে তাদের পারদর্শিতা জন্মাবে! ফলে কিছু কিছু বিষয়ে তাঁর আপত্তি থাকলেও প্রাচীন বিদ্যার ঐতিহ্য বিষয়েই উনি ‘ক্রিটিক্যাল’ ছিলেন, এ কথা আমার মানতে ইচ্ছে করে না। তিনি ভাবতেন, ‘ট্র্যাডিশনাল’ বিদ্যার অনেকটাকেই আজকের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব। এবং এই জন্যই তিনি অন্য পথে গিয়ে ব্যাকরণ শিক্ষার সন্ধান শুরু করলেন, যাতে প্রাচীন শাস্ত্রে অধিকারটা আরও সহজ হয়। তৈরি হল ব্যাকরণ কৌমুদী।