মহেঞ্জোদড়োর কথা উঠলে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে মনে পড়ে, তার বাইরে তাঁর সমাদর কতটা? রাখালদাসের সার্বিক কর্মজীবনকে ধরে এ প্রশ্নই তুলেছেন লেখক, ছাত্রাবস্থা থেকে তাঁর প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসচর্চায় প্রবেশের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন, পরবর্তী কালে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কাজে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্কও। এই পর্বে ইউরোপীয় প্রত্নতত্ত্ববিদদের সঙ্গে ভারতীয় গবেষকদের হৃদ্যতা চোখে পড়ে, উঠে আসে ব্রিটিশ প্রভুত্বের ধারণাও। মুদ্রাতত্ত্ব ও পুরালেখবিদ্যায় তাঁর অবদানও আলোচিত। প্রাচীন ও আদি-মধ্যযুগের বহু পুরালেখর পাঠোদ্ধার ও সম্পাদনা করেছিলেন রাখালদাস, লিখেছিলেন নানাবিধ প্রবন্ধ: সেই তালিকা বইকে সমৃদ্ধ করেছে। ইতিহাসভিত্তিক রম্যরচনা, ইতিহাস-আশ্রিত একাধিক উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। তাঁর মত ছিল, ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস কখনওই ইতিহাস নয়, তাতে লেখকের স্বাধীনতা থাকলেও দৃশ্যপট রচনায় ইতিহাস-বিচ্যুতির স্থান নেই। এই ভারতে সিনেমা ও সমাজমাধ্যম-নির্ভর ইতিহাস-বিকৃতির যুগে ‘জাতীয়তাবাদী’ রাখালদাসের মনোভাব প্রকৃত ইতিহাসবোধের দিশারি।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক সাহিত্য সেবক
রঙ্গনকান্তি জানা
১২০.০০
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
২০০০-এর ৪ জুন তিস্তাপারের বৃত্তান্ত-এর প্রথম অভিনয় হয় রবীন্দ্রসদনে। প্রশংসার পাশাপাশি তুমুল তর্কও শুরু হয় নাটকটি নিয়ে। রাজবংশী সমাজের একাংশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তৎকালীন শাসক দলের অপছন্দ হয়েছিল সে-নাটক, “সরকারের একজন প্রভাবশালী কর্তা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের হোমরাচোমরা আমাকে তাঁর দপ্তরে ডেকে কয়েকটি দৃশ্য বাদ দেবার পরামর্শ দেন। বিশেষ করে সিপিএমের এমএলএ-কে কাঁধে নিয়ে বাঘারুর নদী পেরোনোর দৃশ্যটি,” ভূমিকায় লিখেছেন লেখক। তাঁর নাট্যবিন্যাস ও নির্দেশনায় এই নাটকটি-সহ, তাঁর চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় হারবার্ট ছবিটিও মুক্তি পায় ২০০৫-এ। তিস্তাপারের বাঘারু ও কলকাতার হারবার্টের হাত ধরে প্রান্তিকতার নতুন সংজ্ঞা নির্মিত হয় বাংলা মঞ্চ ও পর্দায়। এ সব ফিরে পড়ার বন্দোবস্ত আলোচ্য বইটিতে: নাটক ও চিত্রনাট্যের সঙ্গে নিমাই ঘোষের তোলা আলোকচিত্র ও হিরণ মিত্রের অলঙ্করণ-নামলিপিতে সজ্জিত।
তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, হারবার্ট: একটি নাটক, একটি চিত্রনাট্যসুমন মুখোপাধ্যায়, সম্পা: দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৫০.০০
দে’জ
দেবেশ রায়ের উপন্যাস থেকে নাট্যপ্রস্তুতি কোন প্রক্রিয়ায় ঘটিয়েছিলেন, স্মৃতির সেই অনির্দিষ্ট সময়চিহ্ন লিপিবদ্ধ করেছেন সুমন, একই ভাবে লিখেছেন নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস থেকে হারবার্ট-এর চিত্রনাট্য তৈরির কথা। গুরুত্বপূর্ণ আরও দু’টি রচনা, পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও দেবেশ রায়ের। দেবেশবাবু ‘মঞ্চের উপন্যাস-পাঠ’-এ লিখেছেন, যে ভাবে তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে নির্দেশকের মৌলিক নাট্যকল্পনা ও পেশল সমর্থ মঞ্চশক্তির আবিষ্কার ঘটেছিল, তার ঘোর তাঁর কাটেনি পঁচিশটি অভিনয় দেখার পরেও। আর পরশ পাথর-এর সঙ্গে হারবার্ট-এর সমান্তরাল আলোচনায় পার্থবাবু প্রশ্ন তুলেছেন, “কাল আর ভাবাদর্শের হাজার ফারাক সত্ত্বেও সত্যজিৎ আর সুমনের এই ছবি দুটির মধ্যে যুক্তিবাদ আর অলৌকিকের যে দ্বন্দ্ব আমরা দেখি, তাতে কি গভীর একটা সাদৃশ্য নেই?”
‘দেশভাগ ও সুন্দরবন: স্মৃতিপটে ইতিকথা’
স্বপনকুমার মণ্ডল
৩০০.০০
সোপান
রাত তিন প্রহর নাগাদ কত্তার বিচালির গাদায় আগুন দিয়েছিল নুর মহম্মদের লোকেরা। গ্রামের লোক জড়ো হয়ে নেবানোর চেষ্টা করার আগেই গোয়ালঘর, দক্ষিণ ঘর ও পাঁচিলের খানিকটা পুড়ে ছাই। আগুনের হলকায় পুঁইমাচারও অন্ত। কিন্তু শীতের শেষে দানাগুলো গুছিয়ে রেখেছিলেন গিন্নিমা। তাঁর কাপড়ের গিঁটের মধ্যেই ‘ভারতের সুন্দরবন’-এ পা পড়েছিল লাল-ডাঁটা-সবুজ-পাতা পুঁইশাকের। পূর্ববঙ্গে দেড়শো বিঘের ভিটের মায়া ছেড়ে নতুন দেশে পৌঁছে সেই পুঁইদানা গিন্নিমা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ঘরের চার পাশে, বর্ষায় লতিয়ে উঠেছিল তারা। অনেকের ভাত জোটেনি যখন, এ বেলা-ও বেলা ওই শাক চিবিয়েই পেট ভরিয়েছিল ছেলেমেয়েরা। দেশভাগ ও তার পরে সত্তরের দশক অবধি দুই বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও তার ধাক্কায় সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ছিন্নমূল মানুষের ঢল— এ সবই বহু-আলোচিত। লেখক এর মধ্যে থেকে বেছে নিয়েছেন আবাদি সুন্দরবনের অংশটুকু। আজ যেখানে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের বাস, সেই সুন্দরবনের অর্ধেক মানুষই পূর্ববঙ্গ থেকে আগত। তাঁদের মর্ম-ছোঁয়া স্মৃতিকথা ছড়িয়ে এই বইয়ে। মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তু জীবনের টানাপড়েন, আয়লার দাপট, অবর্ণনীয় লড়াইয়ের অজস্র কাহিনি জমা আছে সুন্দরবনের নোনা মাটিতে। অন্ন-জলের অভাব, বন্যা, ঝড়, রোগ-বিপর্যয়েও জীবন থামেনি। পরিচয়ের রাজনীতির এই সময়ে বইটি সমান প্রাসঙ্গিক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)