Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২

আশা আকাঙ্ক্ষা হিংস্রতার কত রূপের কথা

এখন আমাদের উপন্যাস দু’ভাবে লেখা হয়। পুজোসংখ্যায় আর সাময়িকপত্রে ধারাবাহিক উপন্যাস এবং নিভৃতে লেখা উপাখ্যান, আখ্যান, প্রায় পাণ্ডুলিপি থেকে যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। গত তিরিশ-চল্লিশ বছরে প্রকাশিত অনেক মহৎ উপন্যাসই পাণ্ডুলিপি থেকে সরাসরি বই হয়েছে।

স্বর্গের শেষপ্রান্তে। তিলোত্তমা মজুমদার। আনন্দ, ৫০০.০০

স্বর্গের শেষপ্রান্তে। তিলোত্তমা মজুমদার। আনন্দ, ৫০০.০০

অমর মিত্র
শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

এখন আমাদের উপন্যাস দু’ভাবে লেখা হয়। পুজোসংখ্যায় আর সাময়িকপত্রে ধারাবাহিক উপন্যাস এবং নিভৃতে লেখা উপাখ্যান, আখ্যান, প্রায় পাণ্ডুলিপি থেকে যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। গত তিরিশ-চল্লিশ বছরে প্রকাশিত অনেক মহৎ উপন্যাসই পাণ্ডুলিপি থেকে সরাসরি বই হয়েছে। পাণ্ডুলিপি থেকে বই হওয়া মানে সেই লেখা অনুরুদ্ধ কিংবা পত্রিকার দায় মেটানর লেখা নয়, লেখক লিখেছেন নিজের দায় থেকে। নিজের তাড়না থেকে। তিলোত্তমা মজুমদারের বৃহৎ উপন্যাস স্বর্গের শেষপ্রান্তে পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এই কথা।

তাঁর এই উপন্যাস হয়তো নিভৃতে লেখা, নিজের দায় থেকে লেখা, না লিখে পারা যায় না এমন লেখা এই আশ্চর্য আখ্যান। মহাভারতে আমাদের যে উত্তরাধিকার, তার ছায়া যে কত রকম ভাবে দেখা যায় কোনও কোনও আখ্যানে। কত মানুষ, কত রকম মানুষ, লোভ, হিংসা, উদারতা, সংকীর্ণতা, যৌনতা, রূপ-অরূপ নিয়ে তিলোত্তমা যে বৃহৎ আখ্যান লিখেছেন, তা শুধু কাহিনিকথন নয়, কাহিনিকে পার করে পৌঁছে গিয়েছে এমন এক শৈল্পিক পূর্ণতায়, যার সৌন্দর্য মুগ্ধ করে বারে বারে। পটভূমি উত্তরবঙ্গের এক চা-বাগান, বালবিনি, ডুয়ার্স। এক বৃহৎ পরিবারের, অনেক ভাই, তাদের বউ, সন্তানসন্ততি, আদিবাসী গিরমিটিয়া, মদেশিয়া, ওরাঁও, সাঁওতাল, নেপালি, নানা জনগোষ্ঠী নিয়ে এক বৃহৎ সমাজের কাহিনির সময়কাল গত শতকের ষাটের দশকের শেষভাগ। আর সময়কাল বড় কথা নয়, প্রবহমান যে কালের কথা লিখেছেন লেখক, তা ঝিনি নামের সেই শিশু, সেই বালিকা, সেই কিশোরীর জীবনে বয়েই চলে। ঝিনি একটি শিশু, সেই শিশুর চোখ দিয়ে যে দেখা আরম্ভ হয়, তা তার বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় কেমন করে তার হৃদয়বিদারক কাহিনি এই উপন্যাস।

কী অদ্ভুত, এই উপন্যাসে লেখকের যে জীবন দেখা, তার সমস্তটাই শিশু, বালক-বালিকাদের চোখ দিয়ে। হ্যাঁ, সেই জেদি শিশু ঝিনির চোখ দিয়ে। তারা কী ভাবে বড় হয়ে ওঠে সেই দিনযাপনের খুঁটিনাটি নিয়ে। রিনি-ঝিনি দুই বোন, দাদা বুটুন, মা সুপূর্ণা, বাবা বীরেন। অচরিতার্থ কামনা নিয়ে ছুটে বেড়ান অমানবিক এক কাকা দীপ্তেন। জ্যাঠা, অন্য কাকারা, পিতামহ কালিকাপ্রসাদ, পিতামহী সরোজিনী, আদিবাসী বুড়ো বুখলা, তার পালিত সন্তান কালুয়া, চা-বাগানে কাজ করা প্রতিবেশী, তাদের সন্তান, ধবলু, পল্টু, ভুতো, পুচকুন... কত চরিত্র, তাদের পূর্ণতা-অপূর্ণতার কাহিনি। হ্যাঁ, এও যেন এক পৃথিবীর পাঠশালা, আশা আকাঙ্ক্ষা হিংস্রতার কত রূপের কথা। উদারতার ভিতরেও যে স্বার্থপরতার পারিবারিক কাহিনি রচনা করেছেন লেখক, তা যেন শৈশবে সৃজিত ফুলের বাগান তছনছ করে দেয়। তাই শেষ অবধি পারিবারিকতার বাইরে গিয়ে এই উপন্যাস বৃহৎ সমাজের চালচিত্র হয়ে দাঁড়ায়।

ঝিনি বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। তার জন্ম নিয়েই পিতামহ এবং পরিবারের কত জনের সন্দেহ। সে কী দীপ্তেনের সন্তান? মা জানে কার সন্তান। বীরেনেরই, কিন্তু সন্দেহেই সুখ আর ঈর্ষার কষ্ট মেটে। গৌরী বটে, কিন্তু তার চোখের মণি কালো নয়, পিতামহ বলেন মেকুড়চক্ষু। কুরূপা ঝিনির সবই বৃদ্ধ কালিকাপ্রসাদের চোখে অসহনীয়। বিড়ালাক্ষী। জেদি শিশু ঝিনিও রুখে যায়। হ্যাঁ, পরে কালুয়া, মেধাবী আদিবাসী কিশোর দেখেছিল ঝিনি বিশালাক্ষী। ভালবাসার চোখ এমন হয়। পিতামহ আর শিশু পৌত্রীর যে সম্পর্ক এঁকেছেন লেখক, তা আমাদের চিরকালীন ধ্যান-ধারণার জায়গায় আঘাত করে। সচরাচর এমন পড়া হয় না। এমন নিষ্ঠুর পিতামহ, কিন্তু পৌত্র বুটুনে পরম স্নেহময়। বৃষ্টি আর মেঘের দেশে ঝিনি তো শিশুকাল থেকে খর রৌদ্রে হাঁটে। কী নিদয়া আমাদের পারিবারিক জীবন! ঝিনির মামি মন্দিরার কথাও উল্লেখ্য এখানে। রুশ উপন্যাসের কথা মনে পড়ে যেন। এই উপন্যাসে তেমন এক ধাঁচা আছে, কিন্তু এর সবটাই ডুয়ার্সের, বালবিনি চা-বাগানের, ভারতীয় উপন্যাসের উত্তরাধিকার।

ঝিনির একমাত্র নেশা বই পড়া। ঝিনির দিদি রিনি তার বিপরীত। সে সুন্দর, সে বাগান করে, গাছ বসায়, প্রকৃতির সঙ্গে তার সখ্য, প্রেমেও পড়ে। প্রেমে পড়ে সেই সদ্য যুবতী এক কুটিল জীবনের অন্ধকারে নিঃশেষ হয়ে যায়। দীপ্তেন এমন এক পুরুষ, তার কামনায় রেহাই পায় না কিশোরী, বালিকা ভ্রাতুষ্পুত্রীও। রিনি নীরব। ঝিনির যে বারংবার রুখে যাওয়া, জিদ্দি মেয়ে, মেয়েদের জেদ কেন সহ্য করবে পরিবার? কালিকাপ্রসাদ যেমন, মাতামহী তারাসুন্দরীও তেমন। ঝিনির জেদ, ঝিনির উদাসীনতা, মুখে মুখে কথা— কেউ পছন্দ করে না। গণ্ডির বাইরে যাবে কেন সে? তার ফলে মার খায় সে কম না। কিন্তু শুনেছে যে, মার খেতে খেতেই বড় হয় ছোটরা। স্কুলে মার খায় ভুতো, আর পাজি ছেলেরা, আর পরিবারে ঝিনি। প্রহারের ভয় করে না সে। ঝিনি কিন্তু সমাপ্তি-র মৃন্ময়ী নয়, ঝিনিকে আমরা আগে দেখিইনি। না আশাপূর্ণায়, না মহাশ্বেতায়। এই উপন্যাসের চরিত্ররা ভাল আর মন্দ দুই-ই। তিলোত্তমা যে বুটুনকে এঁকেছেন, তাকে আঁকা খুব সহজ নয়। সুপূর্ণা মা, মা কি বোঝেন না, ছেলে ইস্কুলে আগুন লাগিয়েছিল, ছেলে ধর্ষণ করতে গিয়ে তাড়া খেয়ে ফিরেছে মাঝরাতে, গায়ে তার মদের গন্ধ। তখন তা গোপন করতেই হবে। কালিকাপ্রসাদের পরিবারসূত্র কোথায়? মৃত ভৃত্য সনাতনে, না কি সরোজিনীর দূরের সম্পর্কে ভাই শ্রীশে?

একটি পরিবার নিয়েই যেন একটি সমাজ। পাপ আর পুণ্য এখানে হাত ধরাধরি করে হাঁটে। নিজেদের ভিতর ভালবাসায় ভরা ছোটদের জীবন, বড়দের ভিতরে পাপের বাসা। টেপি চলে এসেছিল কাকা দীপ্তেনের বাড়ি থেকে। কেন, তা বলেনি কিছুতেই। নিশ্চিত এমন কিছু হয়েছিল, যা সে বলতে পারে না। বলেছিল, রিনিরা যেন ওখানে পড়তে না যায়, পরিবারের হাতে তার প্রেম নষ্ট হওয়ায় রিনি তো গেল। ফুরিয়েও গেল। ডিমওয়ালার মেধাবী ছেলে ধবলুও হারিয়ে গেল। জীবন এত সহজ নয়। জীবন দিয়ে জীবনকে চিনল ঝিনির দিদি রিনি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ ডুয়ার্সের যে বালবিনি চা-বাগান, তা যেন ঈশ্বরের বাসভূমি হতে পারত। কিন্তু হয়নি শেষ পর্যন্ত। আবার হয়নি যে, তা বলি কী করে? বুখলার কাঁধে চেপেছে ঝিনি। বুখলার পিঠে কাঁঠালের বস্তা। বাবুদের বাড়ি-বাড়ি বিলি করতে যাচ্ছে সে, ঝিনির মায়ের নির্দেশে। কাঁধে চেপে শিশু ঝিনি বালবিনি দেখতে পাচ্ছে কতদূর পর্যন্ত। ঝিনির সেই প্রথম বহু দূর বালবিনি দেখা। স্বর্গের রূপ দর্শন। উপন্যাস তো শুধু কাহিনি নয়, কী শৈল্পিক তিলোত্তমার এই উপন্যাসের অংশাংশ! এই লেখায় কত যত্ন। প্রকৃতি আর মানুষ, বন পাহাড়, ডোম্বি তালের জলে ভালবাসার রূপ দেখা, বনের গাছ-গাছালি, ফুলের কথা জানতে জানতে দুই বোনের বড় হয়ে ওঠা, আর সেই বড় হওয়ার বড় কষ্ট! ঝিনি বড় হতে হতে যেদিন সত্যিই হয়, সেদিন রিনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরেছিল। রজঃস্বলা হল সে। দিদির মৃত্যুর কারণ যে পুরুষ সেই দীপ্তেনের দিকেই রুখে যেতে-যেতে নারীত্ব জন্মায় তার ভিতরে। মৃত দিদি আর মৃত বান্ধব পল্টুর নামের পুরস্কার নিতে-নিতে ঝিনি, মিতাক্ষরা হয়ে ওঠে নতুন এক নারী। এই উপন্যাসে ডুয়ার্স, উত্তরবঙ্গে, নকশাল আন্দোলনের ছোঁয়া এসে মিলিয়ে গিয়েছে। লেখক রাজনৈতিক বিষয়কে নিয়ে এসেও এড়িয়ে গিয়েছেন। থাকতে পারত, কিন্তু সমাজ আর পৃথিবীকে তিনি নির্মাণ করেছেন যে ভাবে, তাতে অন্তর্লীন হয়ে আছে সময়। হ্যাঁ, মৃত সনাতনের ডায়েরি আমার কাছে দীর্ঘ মনে হয়েছে। ছোট হতে পারত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tilottama Majumdar Book Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE