এখন আমাদের উপন্যাস দু’ভাবে লেখা হয়। পুজোসংখ্যায় আর সাময়িকপত্রে ধারাবাহিক উপন্যাস এবং নিভৃতে লেখা উপাখ্যান, আখ্যান, প্রায় পাণ্ডুলিপি থেকে যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। গত তিরিশ-চল্লিশ বছরে প্রকাশিত অনেক মহৎ উপন্যাসই পাণ্ডুলিপি থেকে সরাসরি বই হয়েছে। পাণ্ডুলিপি থেকে বই হওয়া মানে সেই লেখা অনুরুদ্ধ কিংবা পত্রিকার দায় মেটানর লেখা নয়, লেখক লিখেছেন নিজের দায় থেকে। নিজের তাড়না থেকে। তিলোত্তমা মজুমদারের বৃহৎ উপন্যাস স্বর্গের শেষপ্রান্তে পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এই কথা।
তাঁর এই উপন্যাস হয়তো নিভৃতে লেখা, নিজের দায় থেকে লেখা, না লিখে পারা যায় না এমন লেখা এই আশ্চর্য আখ্যান। মহাভারতে আমাদের যে উত্তরাধিকার, তার ছায়া যে কত রকম ভাবে দেখা যায় কোনও কোনও আখ্যানে। কত মানুষ, কত রকম মানুষ, লোভ, হিংসা, উদারতা, সংকীর্ণতা, যৌনতা, রূপ-অরূপ নিয়ে তিলোত্তমা যে বৃহৎ আখ্যান লিখেছেন, তা শুধু কাহিনিকথন নয়, কাহিনিকে পার করে পৌঁছে গিয়েছে এমন এক শৈল্পিক পূর্ণতায়, যার সৌন্দর্য মুগ্ধ করে বারে বারে। পটভূমি উত্তরবঙ্গের এক চা-বাগান, বালবিনি, ডুয়ার্স। এক বৃহৎ পরিবারের, অনেক ভাই, তাদের বউ, সন্তানসন্ততি, আদিবাসী গিরমিটিয়া, মদেশিয়া, ওরাঁও, সাঁওতাল, নেপালি, নানা জনগোষ্ঠী নিয়ে এক বৃহৎ সমাজের কাহিনির সময়কাল গত শতকের ষাটের দশকের শেষভাগ। আর সময়কাল বড় কথা নয়, প্রবহমান যে কালের কথা লিখেছেন লেখক, তা ঝিনি নামের সেই শিশু, সেই বালিকা, সেই কিশোরীর জীবনে বয়েই চলে। ঝিনি একটি শিশু, সেই শিশুর চোখ দিয়ে যে দেখা আরম্ভ হয়, তা তার বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় কেমন করে তার হৃদয়বিদারক কাহিনি এই উপন্যাস।
কী অদ্ভুত, এই উপন্যাসে লেখকের যে জীবন দেখা, তার সমস্তটাই শিশু, বালক-বালিকাদের চোখ দিয়ে। হ্যাঁ, সেই জেদি শিশু ঝিনির চোখ দিয়ে। তারা কী ভাবে বড় হয়ে ওঠে সেই দিনযাপনের খুঁটিনাটি নিয়ে। রিনি-ঝিনি দুই বোন, দাদা বুটুন, মা সুপূর্ণা, বাবা বীরেন। অচরিতার্থ কামনা নিয়ে ছুটে বেড়ান অমানবিক এক কাকা দীপ্তেন। জ্যাঠা, অন্য কাকারা, পিতামহ কালিকাপ্রসাদ, পিতামহী সরোজিনী, আদিবাসী বুড়ো বুখলা, তার পালিত সন্তান কালুয়া, চা-বাগানে কাজ করা প্রতিবেশী, তাদের সন্তান, ধবলু, পল্টু, ভুতো, পুচকুন... কত চরিত্র, তাদের পূর্ণতা-অপূর্ণতার কাহিনি। হ্যাঁ, এও যেন এক পৃথিবীর পাঠশালা, আশা আকাঙ্ক্ষা হিংস্রতার কত রূপের কথা। উদারতার ভিতরেও যে স্বার্থপরতার পারিবারিক কাহিনি রচনা করেছেন লেখক, তা যেন শৈশবে সৃজিত ফুলের বাগান তছনছ করে দেয়। তাই শেষ অবধি পারিবারিকতার বাইরে গিয়ে এই উপন্যাস বৃহৎ সমাজের চালচিত্র হয়ে দাঁড়ায়।