Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

অবনঠাকুরকে মনে পড়ায়

তিনি কলমের আঁচড়ে জাদু তৈরি করতে পারতেন, তাঁর চরিত্রগুলো সজীব হয়ে উঠত। শৈলেন ঘোষ হচ্ছেন সেই জাদুকর।

শুভশ্রী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

হা ন্স অ্যান্ডারসনের লেখা ‘টিনের সেপাই’-এর জ্যাক-ইন-দ্য-বক্সের জাদুকরকে মনে আছে? তার জন্য টিনের সেপাইকে কী ছোটাছুটিটাই না করতে হয়েছিল। শেষে অবশ্য ঘটনাচক্রে সে আবার সেই ঘরেই ফিরে এল, ফিরে এল তার ভালবাসার নাচিয়ে পুতুলের কাছে। সবই কিন্তু সেই জাদুকরের কেরামতি। শৈলেন ঘোষ হচ্ছেন সেই জাদুকর। তিনি কলমের আঁচড়ে জাদু তৈরি করতে পারতেন, তাঁর চরিত্রগুলো সজীব হয়ে উঠত। তাঁর ‘ফাটিস’ গল্পে ভেড়ার আঁকা পাখিটা যেমন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে জানলার বাইরে চলে গিয়েছিল, ঠিক তেমনই। তাঁর চরিত্র বাগডুম সিং-কে দেখলে সেই টিনের সেপাইয়ের কথা মনে পড়তে বাধ্য।

দিশি রূপকথার চেয়ে বিদেশি প্রভাব তাঁর লেখায় বেশি দেখা যায়। তাঁর আগে বাংলায় রূপকথার জগতে দক্ষিণারঞ্জন আর উপেন্দ্রকিশোর দু-রকম ধারার সৃষ্টি করেছেন। দক্ষিণারঞ্জনের ঠাকুমার ঝুলি প্রসঙ্গে শৈলেন ঘোষ নিজে এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষায় লেখা রূপকথার গল্প যদি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ হত তাহলে বিশ্ব সাহিত্যে জয়জয়কার থাকত ঠাকুমার ঝুলির’। তবে ঠাকুমার ঝুলি রূপকথা হলেও শিশুপাঠ্য কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। তাতে যে ভাবে প্রতিহিংসা, নিষ্ঠুরতা দেখানো হয়েছে সেগুলো শিশু মনের বিকাশে যথেষ্ট ক্ষতিকর হতে পারে। উপেন্দ্রকিশোরের গল্পের বহু জায়গাতেও জন্তু-জানোয়ারদের জব্দ করে মানুষ শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছে। কিছু জায়গায় বোকা লোককে ঠকানোর পর চালাকের জয় হয়েছে। শৈলেন ঘোষ এঁদের কোনও দিক দিয়েই গেলেন না। তাঁর সঙ্গে বরং খানিকটা মিল পাওয়া যায় অবনঠাকুরের। ‘বুড়ো আঙলা’ আর মিতুল যেন আলাদা নয়।

প্রথম জীবনে ভাল ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন শৈলেন ঘোষ। তাঁর লেখার মধ্যে সেই পরিচয় ধরা পড়ে যায়। তাঁর চরিত্রগুলো ছটফটে ফুটবলের মতো গল্পের আঙিনা জুড়ে এখান থেকে ওখানে কেবল ছুটে বেড়ায়। কখন কোথায় যে তারা যাবে আর কী কাণ্ড পাকাবে সে কথা কেউ আন্দাজও করতে পারে না। উনি নিজেও আগে থেকে অত পরিকল্পনা করে লিখতে বসতেন না বলেই মনে হয়। চরিত্রগুলোই যেন চলমান হয়ে একটা থেকে আর একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁকে টেনে নিয়ে চলে। গল্পের এই গতিময়তাই তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্য। তাঁর গল্প পড়তে বসলে পুরোটা রুদ্ধশ্বাসে শেষ না করে ওঠা যায় না। ছোট ছোট বাক্য, তাতে অনেক ধ্বন্যাত্মক শব্দ, সহজ-সরল, স্বতঃস্ফূর্ত তাদের চলন। ছোট ছোট ছন্দোবদ্ধ ছড়াও ঢুকে পড়ে অনেক সময়। ঠিক যেমন করে ছুটতে ছুটতে বেশি আহ্লাদ হলে ছোটরা একটু নেচে নেয়। মনে রাখতে হবে গদ্য লিখে খ্যাতি এলেও তাঁর সাহিত্যিক জীবনে পথ চলা শুরু হয় ‘মাসপয়লা’ মাসিক পত্রিকায় লেখা একটি কবিতা দিয়েই। সেই ছন্দ, সেই সুর তাঁকে আজীবন ছেড়ে যায়নি। প্রায় ত্রিশটির বেশি নাটক লিখেছেন, অভিনয় করিয়েছেন ‘শিশুরংগন’ এর কচিকাঁচাদের দিয়ে।

শৈলেন ঘোষের গল্পের শীর্ষচিত্র, শিল্পী: পূর্ণেন্দু পত্রী। শারদীয় আনন্দমেলা, ১৯৭৩

আমাদের বাংলা ভাষায় সদ্য পড়তে শেখা শিশুদের জন্য খুব কমই গল্প লেখা হয়। প্রাইমারের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, বর্ণ পরিচয়, সহজ পাঠ আর হাসিখুশি-র পরে তেমন বাংলা প্রাইমার কোথায়? শিশুসাহিত্য বলে আজকাল যা চলে তার বেশিরভাগই গোয়েন্দা গল্প। মনের অন্ধকার দিক নিয়ে তাদের কারবার। শিশুমনে নিরন্তর আলো জ্বালানর কাজটি কিন্তু শৈলেনবাবু করে গিয়েছেন অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে।

সেই যে স্কুলপড়ুয়া ছোট্ট ছেলেটি আনন্দবাজারে সোমবারের পিছনের পাতায় শিশুদের বিভাগে লেখা দিতে এসে ডাকবাক্সে তাঁর প্রথম গল্প ‘মা’-এর পাণ্ডুলিপি রেখে দিয়ে গেল— সেই শুরু। তারপর আনন্দমেলায় ধারাবাহিক ভাবে তাঁর একের পর এক উপন্যাস বেরোতে শুরু করে। ‘টুইটুই’, ‘মিতুল নামে পুতুলটি’, ‘বাজনা’, ‘আমার নাম টায়রা’, ‘আজব বাঘের আজগুবি’— আরও কত। তাঁর লেখার সঙ্গে সমানে সমানে সঙ্গত করে গিয়েছেন বিমল দাস, অতুলনীয় সব অলংকরণ উপহার দিয়ে। তারপর তাঁর বয়স বেড়েছে, কিন্তু মনটা শেষদিন পর্যন্ত সেই সহজ সরল শিশুসুলভই রয়ে গিয়েছে।

এ তো গেল তাঁর কাহিনির বাইরের চেহারা। তাঁর কাহিনিগুলি কেন এত বিপুল সংখ্যক পাঠকের মন জয় করে নিল সেটা এবার একটু ভাবা যাক। সেগুলোর ভেতর খুব সন্তর্পণে প্রায় কাউকে বুঝতে না দিয়ে উনি বুনে দিতেন ভালত্বের বীজ। শিশুরা তো কাদামাটির তাল, তাদের যেমন করে গড়া হবে তেমনটিই সে তৈরি হবে। তাঁর অনেক চরিত্রের মধ্যেই ভাল খারাপের দ্বন্দ্ব আছে। অবশ্য পুরোপুরি খারাপ উনি কাউকে বলতে নারাজ। ‘টুইটুই’ উপন্যাসে এক রাজা, তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের হারিয়ে নিষ্ঠুর হয়ে যান। রাজ্যের সব পাখিদের মেরে ফেলার হুকুম দেন। তার আগে কিন্তু রাজা ওরকম ছিলেন না। তারপর ছোট্ট শান্ত আর তার বোন চুমকির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। জানতে পারেন তাদের হারানো পোষা পাখিটিকে তাঁরই জন্য মরতে হয়েছে। তখন তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন, আবার ভাল হয়ে যান। তাঁর রাজ্যের সব মরা পাখি বেঁচে ওঠে। আবার ‘বাগডুম সিং’ গল্পে উল্টো ব্যাপার। সে যখন পুতুল ছিল তখন তার মন অনেক সরল ছিল। সম্পদ আর ক্ষমতার লোভে রাজা হতে গিয়েই গোল বাধল। যে খারাপ কাজগুলো সে করে ফেলল তার ফলে সে আবার পুতুল হয়ে গেল। তার সব সোনা লোহা হয়ে গেল। মণিমুক্তোগুলো হল কাচের টুকরো। ভালদের সব সময় জিতিয়ে দিয়েছেন তিনি।

তা বলে কি তাঁর কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো সব খুব শান্ত শিষ্ট? একেবারেই না। দুষ্টুর একশেষ। ঝগড়াও কি আর করে না? একটু নমুনা দেওয়া যাক, ‘হুপ্পোকে নিয়ে গপ্পো’ তে হুপ্পো বাঁদরছানা আর হাঁসছানার ঝগড়া চলছে: ‘‘ফুসকুড়ি বলতেই হুপ্পো চটিতং! গাছ থেকে মাটিতে লাফ দিয়ে একেবারে তেড়েমেরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই বেগনি, আমায় ফুসকুড়ি বললি কেন রে! আমি ফুসকুড়ি তো তুই ছোলাভাজা’।

ছোলাভাজা বলতে বেগনিও রেগে আগুন, তেলে-বেগুন। প্যাঁক-প্যাঁক স্বরে খেঁকিয়ে বলল, ‘আমি ছোলাভাজা তো তুই গুড়-মুড়ি’।

হুপ্পোও ছাড়বে না। বলল,

তুই ডুগি-তবলা!

তুই সরষের তেল’।/ ‘তুই ফ্যান-ভাতে’!

তুই তেঁতুলবিচি’!/ ‘তুই লাউডগা’!’’

এমন সব মজার গালাগাল ক্যাপ্টেন হ্যাডকও দিতে পারবে কিনা সন্দেহ। ‘রাজার ঘরে টিকটিকি’ গল্পে রাজা মন্ত্রীর মধ্যে মারপিটের কারণ কী? না, রাজা বলেছেন মন্ত্রীকে আরশোলা হয়ে তাঁর ঘরের টিকটিকি ধরে দিয়ে আবার মানুষ হয়ে যেতে। মন্ত্রী তাতে মোটেই রাজি নন। এর চেয়ে বেশি জটিলতা নেই ওনার লেখায়।

ঝগড়ার মতো মারামারিও আছে তাঁর গল্পে। ‘বাজনা’ ছুটতে ছুটতে বেড়ালের গলা কেটে দুখানা করে দিয়েছে বটে, কিন্তু তাতে বেড়ালটা কিন্তু মোটেও মরেনি। সে হয়ে গিয়েছে একটা শেয়াল। আবার তাকে মারতে সে হয়ে গেল একটা বাঘ। মারতে গিয়ে সে তার নিজের বিপদ বাড়িয়েছে বই কমাতে পারেনি। ‘আজব বাঘের আজগুবি’ গল্পে ছোট বাঘটির মা মানুষখেকো হয়ে উঠেছিল বলে তাকে মানুষের গুলিতে মরতে হয়। কিন্তু তার আগে মানুষই যে তার বাবাকে ফাঁদ পেতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সে কথাও মনে করাতে ভোলেননি উনি। তাঁর গল্পের না-মানুষরাও মানুষের ভাষাতেই কথা বলত, ভালবাসত। জীবজন্তু তো বটেই তাঁর জাদু-কলমের ছোঁয়ায় জড় পদার্থও প্রাণ পেয়ে যেত।

বড় ভালবাসায় মায়ায় মাখানো গল্পগুলি। অনেক অনাথ বাচ্চার কথা লিখেছেন বিভিন্ন গল্পে। তারা ভালবাসার কাঙাল। ভূতের গল্প ‘বন্ধ ঘরের কান্না’-র অনাথ ছেলে সায়র চলে গিয়েছিল একটি বিশাল বড় বাড়িতে। শুরুতে মনে হবে যে বাচ্চাটিই হয়তো ভূতের খপ্পরে পড়তে চলেছে। তারপরেই বোঝা যায়, ভূত আসলে লোভী, নিষ্ঠুর, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মানুষের মনে। বৃদ্ধ লোকটির তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে সায়র নদীতে ডুবে মারা যায়। প্রথমে সেটা সে নিজে বুঝতেও পারে না। কিন্তু ভূত হয়ে তার সাহস হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় সে ফিরে যায় সেই বাড়িটায়, যেখানে তাকে অন্যায় ভাবে চোর সাব্যস্ত করা হয়েছিল। সেখানে গিয়ে সে যখন তাদের মুখোমুখি হয়, তারাই উলটে তাকে ভয় পেতে শুরু করে। তাঁর ‘টুইটুই’–এর শান্তও এই রকম সাহসী। সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভয় পায় না।

তাঁর গল্পে মাঝে মাঝে খুব সহজ ভাবে খুব কঠিন কথা বলা থাকে। বাজনা যখন ছাগল চরানো বুড়োকে বদ্যির বাড়িটা কোথায় দেখিয়ে দিতে বলে সে উত্তর দেয়:

‘‘এখন সময় নেই। এখন কাজের সময়’। /

কখন সময় হবে?’/ ‘যখন কাজ শেষ হবে’।

কখন কাজ শেষ হবে?’/ ‘যখন সময় হবে’।

বাজনা বুড়োর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মনটা কেমন চুপসে গেল। বলল, ‘বাবা, এ যে বড়ো গোলমেলে ব্যাপার!’’

পত্রিকার লেখাগুলি আনন্দ পাবলিশার্স থেকে আলাদা আলাদা করে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এ বার পারুল প্রকাশনী চার খণ্ডে শৈলেন ঘোষের উপন্যাস (উপন্যাস সমগ্র ১-৩ খণ্ড প্রতিটি ২০০.০০, ৪ খণ্ড ২৫০.০০) এবং গল্প (২৫ রূপকথা, ১৫০.০০) প্রকাশ করে পাঠকদের সেই রূপকথার জগতে ঢুকে পড়ার ছাড়পত্র দিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abanindranath tagore sailen ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE