Advertisement
E-Paper

বধ্যভূমি বস্তারের সাহসী কথকতা

ভরদুপুরে টাড়মেটলার জঙ্গলে দাঁড়িয়ে যে গন্ধটা আচমকা নাকে এসেছিল, সেই গন্ধ আরও অনেক তীব্র ভাবে পেয়েছিলাম ২০১০-এর এপ্রিলে। মাওবাদীদের হামলায় আধা সামরিক বাহিনী সিআরপিএফের ৭৬ জন জওয়ান মারা গিয়েছেন।

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০

ভরদুপুরে টাড়মেটলার জঙ্গলে দাঁড়িয়ে যে গন্ধটা আচমকা নাকে এসেছিল, সেই গন্ধ আরও অনেক তীব্র ভাবে পেয়েছিলাম ২০১০-এর এপ্রিলে। মাওবাদীদের হামলায় আধা সামরিক বাহিনী সিআরপিএফের ৭৬ জন জওয়ান মারা গিয়েছেন। ছত্তীসগঢ়ের দন্তেওয়াড়ার মুকরম ও টাড়মেটলা গ্রামের মাঝখানে সেই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে বারুদের পোড়া গন্ধ ছাপিয়ে যে আঁশটে গন্ধ নাকে এসেছিল সেটা যে কীসের তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

কিন্তু সেই হত্যালীলার আরও কয়েক বছর পরে টাড়মেটলা কেমন আছে জানতে ফের যখন সেই জঙ্গলের মাঝে দাঁড়ালাম, হাল্কা হলেও সেই আঁশটে গন্ধটা আবার নাকে এল। হয়তো মনের ভুল, কিন্তু সঙ্গী স্থানীয় যুবক যা বলেছিলেন, সে কথাটাও যে ভোলার নয়! যুবকটি বলেছিলেন, ‘আপনি আচমকা গন্ধ পাচ্ছেন আর আমরা তো মাঝেমধ্যেই পাই! পোড়া গন্ধই তো আমাদের সঙ্গী!

সত্যিই তো! গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে স্পেশাল পুলিশ অফিসারের (এসপিও) দল। বার বার অভিযোগ উঠেছে, ‘সালওয়া জুড়ুম’ অভিযানের অঙ্গই হয়ে উঠেছে ‘মাওবাদীদের সমব্যথী’ গ্রাম জ্বালানো, অশক্ত, অসহায়কে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া, মাওবাদীদের সন্ধানে এসে বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে আদিবাসী তরুণীকে ধর্ষণ করে খুন— পোড়া গন্ধ নাকে তো আসবেই!

নন্দিনী সুন্দরের দ্য বার্নিং ফরেস্ট/ইন্ডিয়া’জ ওয়ার ইন বস্তার গ্রন্থটি হাতে নিয়ে সেই পোড়া গন্ধ আবার নাকে এল! অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া বস্তারের এক আশ্চর্য কথকতা শুনিয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষক নন্দিনী। শুনিয়েছেন মাওবাদী আন্দোলনের দুর্গ বলে পরিচিত বস্তার ও সেই আন্দোলনকে দমন করার নামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কথা। শুনিয়েছেন এক দিকে নিরাপত্তা বাহিনী, অন্য দিকে মাওবাদীদের টানাপড়েনের মাঝে পড়ে হতদরিদ্র আদিবাসীদের যন্ত্রণার কথা। একটা গ্রাম কী ভাবে বার বার নিরাপত্তা বাহিনী এবং এসপিও-দের ‘তল্লাশি অভিযান’-এর লুঠপাট ও আগুনে নেই-গ্রাম হয়ে যায়, নন্দিনী শুনিয়েছেন সে কাহিনিও।

দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে ছত্তীসগঢ়ের দক্ষিণ প্রান্তের এই অংশে আসছেন, সেখানকার জল-জঙ্গল-জমিন আর মানুষজন নিয়ে লাগাতার লেখালেখি করছেন মানবাধিকার কর্মী নন্দিনী। ঘন জঙ্গলে ঘেরা যে বস্তারের আখ্যান তিনি শুনিয়েছেন, সেই বস্তার প্রচারের আলোয় আসে শুধুমাত্র ‘মাওবাদী তাণ্ডব’-এর ‘রিফ্লেক্টেড গ্লোরি’র জন্য! অথচ, বস্তারের আদিবাসী জীবনের দীর্ঘ কালের সুগভীর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্যের কথা সে ভাবে প্রচার পায় না। অবশ্য ইলিনা সেনের মতো মানুষজন ব্যতিক্রম।

৪১৩ পাতার এই আখ্যানকে নন্দিনী ভাগ করেছেন তিনটি পর্বে। প্রথম পর্বে আছে বস্তারের ভূমিপুত্রদের প্রতি বঞ্চনার সামাজিক সূত্র এবং সেখান থেকে প্রতিরোধ তৈরি হওয়া, দ্বিতীয় পর্বে নন্দিনীর বিশ্লেষণে উঠে এসেছে সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযানের নানা ধরন এবং সেই অভিযান কী ভাবে এক ভারতীয় আদিবাসী নাগরিকের জীবনে প্রভাব ফেলছে, কী ভাবেই বা আদিবাসীরা সশস্ত্র গৃহবিপ্লবের জাঁতাকলে পড়ে রয়েছেন। তৃতীয় পর্বে নন্দিনী বলছেন, ঔপনিবেশিক বা সামরিক শাসনের আওতাধীন না হয়েও গণতান্ত্রিক কাঠামোয় কী ভাবে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে এবং এ ব্যাপারে উন্নয়নকামী আমলাতন্ত্র, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, সংবাদমাধ্যম ও বিচার বিভাগের অবস্থান ও ভাষ্য কী।

ভারতবর্ষে মাওবাদী দমন অভিযানকে অন্য মাত্রা দিয়েছে ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’। যা শুরুর সময়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বলেছিল, শুধু নির্দিষ্ট অভিযানের জন্যই এই নামটি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কালক্রমে ছত্তীসগঢ়ের পরিধি ছাড়িয়ে মাওবাদী প্রভাবিত অন্যান্য রাজ্যেও এই অভিযান শুরু হয়। এবং ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ শুরু হওয়ার পরে মাওবাদী সন্দেহে হত্যার ঘটনাবলি ‘সংঘর্ষে মৃত্যু’-তে পরিণত হতে থাকে। অর্থাৎ, এই ধরনের সন্দেহজনক হত্যাকাণ্ড সরকারি বৈধতা পেতে শুরু করে।

মনে রাখতে হবে, ২০০৫-এ মহেন্দ্র কর্মার ‘সালওয়া জুড়ুম’ অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে বস্তারের আদিবাসী সমাজ নিঃস্ব হতে হতে বুঝতে পারে, ভূমিপুত্র হয়েও তাদের কোনও লাভ নেই। তারা লুঠেরা, হত্যাকারী, ধর্ষকদের মর্জির উপরে বেঁচে থাকবে। কিন্তু, ২০০৯ সালে ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ শুরুর পর থেকে আদিবাসী সমাজ যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে শুরু করে তা তাদের কল্পনারও অতীত ছিল।

নন্দিনী সুন্দর সাংবাদিক নন, তিনি সমাজতাত্ত্বিক। কিন্তু তাঁর দেখার চোখটি সংবেদনশীল সাংবাদিকের মতো, তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তাঁর গ্রন্থে এসেছে বটে, সেটা আসা অত্যন্ত স্বাভাবিক, কিন্তু তার বাইরে যা বার বার উঠে আসে, সেটা মানবজমিন। একেবারে ‘মাইক্রো লেভেল’-এ পৌঁছে গিয়ে যে মানবজমিনের সন্ধান তিনি আমাদের দিয়েছেন তা একেবারে বাস্তব। যাঁরা বস্তারের অন্দরমহলে পা রেখেছেন তাঁরা বুঝবেন, নন্দিনীর এই কথকতা সত্যকে কতটা ছুঁয়ে যায়।

সবথেকে দুর্ভাগ্যের বিষয়, একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিশ্বাস করে না। তার চোখে বস্তারের আদিবাসীরা ‘সালওয়া জুড়ুম’-এর সমর্থক না হলেই তারা মাওবাদী! কেন? তার নিরপেক্ষ হওয়ার কোনও অধিকার নেই? আর নিরপেক্ষ হলেই যে সেই মানুষটা নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকবে তা-ও তো নয়! ‘সালওয়া জুড়ুম’ সমর্থকরা তো অসংখ্য মানুষকে স্রেফ নিকেশ করে দিয়েছে তারা ‘মাওবাদী সমর্থক’ এই সন্দেহে। আবার মাওবাদীরাও অনেককে হত্যা করে ‘শাস্তি’ দিয়েছে তারা ‘পুলিশের চর’, এই সন্দেহে। নন্দিনী এ নিয়েও প্রশ্ন তু‌লেছেন।

কিন্তু, এই প্রশ্ন তোলাটা একেবারেই নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিমায় নয়, বরং বস্তারের ভূমিপুত্রদের দীর্ঘ দিন খুব কাছ থেকে দেখার সহমর্মিতা থেকেই এই প্রশ্ন উঠে এসেছে।

মাওবাদীদের দুর্গ হিসেবে পরিচিত বস্তার নিয়ে এর আগেও একাধিক গ্রন্থ আমরা পেয়েছি। যেমন, রাহুল পান্ডিতা-র হ্যালো বস্তার, শুভ্রাংশু চৌধু্রীর লেটস কল হিম বাসু, অরুন্ধতী রায়ের ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস, গৌতম নাভলাখা-র ডেজ অ্যান্ড নাইটস ইন দ্য হার্টল্যান্ড অব রেবেলিয়ন। পেয়েছি সৌমিত্র দস্তিদারের মাই ডেজ উইথ পিপলস লিবারেশন আর্মি, যে গ্রন্থে বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়ের মাওবাদী আন্দোলনের কথা বিবৃত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে সুদীপ চক্রবর্তীর রেড সান: ট্রাভেলস ইন নক্সালাইট কান্ট্রি।

এতগুলি গ্রন্থের পরেও নন্দিনীর এই সুবৃহৎ গ্রন্থপাঠের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বস্তারের আদিবাসী ও তাদের তছনছ হয়ে যাওয়া জীবনচর্চাকে নন্দিনী বড় মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন।

আম আর তেঁতুলগাছে ঘেরা যোগীর কুঁড়েঘর। সে মেয়ে ঘর ছেড়ে জঙ্গল থেকে মহুয়া কুড়োতে বেরিয়েছিল সেই ভোর সাড়ে ৪টে নাগাদ। সে ফিরল বাড়িতে। সেখা‌নে অপেক্ষায় তার বাবা হুঙ্গা, কয়েক বছর আগে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পা ভাঙা। চলতে পারেন না। স্পেশাল পুলিশ অফিসারেরা বাহিনী নিয়ে আচমকা এল দুপুরে। কেউই তখন পালাতে প্রস্তুত নয়। হুঙ্গাকে দু’জন রাইফেলের বাট দিয়ে মারল। বাবাকে বাঁচাতে দৌড়ে গেল যোগী। দলের বাকিরা যোগীকে টেনে নিয়ে গেল বাড়ির ভিতর। সময় নিয়ে ধর্ষণ-পর্ব সমাধা হওয়ার পরে তারা গুলি করে যোগীকে।

সে দিন সন্ধ্যায় শিবিরে ফিরে বাহিনীর কম্যান্ডার সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন। জলপাই-রঙা উর্দি পরা এক নারীর দেহ দেখিয়ে সগর্বে তিনি বলতে থাকেন, দু’পক্ষে প্রবল সংঘর্ষের পরে গেরিলা স্কোয়াডের এই কম্যান্ডারের দেহ উদ্ধার হয়েছে।

সে রাতে আতঙ্কে স্তব্ধ বস্তারের করুথগুড়া গ্রাম জঙ্গল থেকে আর বাড়ি ফেরেনি। তার পরের দিনও নয়। দূর থেকে গোটা গ্রামের মানুষ নির্বাক হয়ে দেখেছে, তাদের গ্রাম জ্বলছে। ফসল, টাকা, গয়না, মানমর্যাদা লুঠ হয়ে গিয়েছে। চলে গিয়েছে প্রাণ।

নির্বাক হয়ে যাওয়া বস্তারের অন্তরের সেই ভাষা চরম সাহসিকতার সঙ্গে শুনিয়েছেন নন্দিনী সুন্দর।

এই গ্রন্থ সম্পর্কে যথার্থই মূল্যায়ন করেছেন অমর্ত্য সেন। বলেছেন, ‘আ ডিপলি ডিস্টার্বিং অ্যানালিসিস অব দ্য স্যাক্রিফাইস অব ট্রাইবাল লাইভস অ্যান্ড কমিউনিটিজ কট বিটুইন দ্য ক্যামোফ্লাজড বারবারিটি অব দ্য সিকিউরিটি ফোর্সেস অ্যান্ড দ্য ভায়োলেন্ট অ্যারোগ্যান্স অব আ ডিফ্লেক্টেড রেবেলিয়ন।’

বস্তারের অন্দরমহল পর্যন্ত ‘উন্নয়ন’-এর রথের চাকা পৌঁছতে পারে হয়তো, কিন্তু তার মানবজমিনের অন্তরমহলেও কি এ ভাবে পৌঁছনো যায়?

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy