Advertisement
E-Paper

আদর্শই নয়, প্রাচ্যচেতনার ধ্রুপদী উদাত্ততাও

সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত মনীষা সাহা-র একক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষপাশ্চাত্যের তুলনায় প্রাচ্যে, বিশেষত: দূর প্রাচ্যে নিসর্গের অনুধ্যান অনেক প্রাচীন ও ধ্রুপদী প্রজ্ঞাদীপ্ত। পাশ্চাত্যে ব্যক্তিশিল্পীর আত্মবোধ নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে প্রকৃতিকে। প্রাচ্যে সে রকম নয়। মানবিক চৈতন্য তার বিনতি দিয়ে সেখানে প্রকৃতির কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে।

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
শিল্পী: মনীষা সাহা

শিল্পী: মনীষা সাহা

পাশ্চাত্যের তুলনায় প্রাচ্যে, বিশেষত: দূর প্রাচ্যে নিসর্গের অনুধ্যান অনেক প্রাচীন ও ধ্রুপদী প্রজ্ঞাদীপ্ত। পাশ্চাত্যে ব্যক্তিশিল্পীর আত্মবোধ নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে প্রকৃতিকে। প্রাচ্যে সে রকম নয়। মানবিক চৈতন্য তার বিনতি দিয়ে সেখানে প্রকৃতির কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে। বিশ্ব চৈতন্যের সঙ্গে একাত্মতার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে অনুধাবনে প্রয়াসী হয়েছে। চিন ও জাপানের নিসর্গ রচনায় এই ধ্রুপদী একাত্মতার প্রকাশ দেখা যায়।

আমাদের দেশে আধুনিকতা থেকে আধুনিকতাবাদে উত্তরণের পর্বে দূর-প্রাচ্যের এই প্রজ্ঞা প্রভাবিত করেছে অনেক শিল্পীকে। অবনীন্দ্রনাথ একটা পর্যায়ে জাপানি শিল্পের প্রকরণ আয়ত্ত করেছেন। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের নিসর্গ রচনায় উদাত্ততা ও নির্জনতাবোধের যে দ্বান্দ্বিক অভিক্ষেপ, তার অনেকটাই দূরপ্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা অনুপ্রাণিত। শান্তিনিকেতনের নিসর্গ রচনার কোনও একক চরিত্র নেই। রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিনোদবিহারী বা রামকিঙ্কর তাঁদের নিসর্গে চার রকম আঙ্গিকে চতুর্মাত্রিক বিশ্বদৃষ্টির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে ঐক্যের সেতু যেটা, তা হল স্বদেশ ও বিশ্বের আধ্যাত্মিক সমন্বয়। সেখানে দূর-প্রাচ্যের উদাত্ততাকে সবচেয়ে বেশি আত্মস্থ করেছিলেন বিনোদবিহারী।

এই উদাত্ততার প্রকাশ কেমন করে ঘটছে সাম্প্রতিক নবীন শিল্পীদের নিসর্গ-রচনায়, তার পরিচয় পাওয়া গেল অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মনীষা সাহা-র তৃতীয় একক প্রদর্শনীতে। ‘নেচার বেকনস্’ শিরোনামের এই উপস্থাপনায় শিল্পী এঁকেছেন মূলত নিসর্গের ছবি। আর সেই নিসর্গে অনেক সময়ই বিনোদবিহারীর পরোক্ষ উত্তরাধিকারের দূরতর প্রচ্ছায়া প্রতিফলিত হয়। এটা নিছক প্রভাব নয়। আত্তীকরণের মধ্য দিয়েই শিল্পী গড়ে তুলতে চেয়েছেন প্রকাশের নিজস্ব আত্মপরিচয়।

মনীষা কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের ছাত্রী ছিলেন। তাঁর প্রশিক্ষণের বিষয় ছিল ভারতীয় চিত্ররীতি। পাশ করে বেরোনোর পর অবশ্য ভূগোল বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার পর ওই বিষয়েই শিক্ষকতায় যুক্ত হয়েছেন। নিজের ছবির জগতে ফিরতে সময় লেগেছে অনেকটা।

প্রথম প্রদর্শনী করেছেন দু’বছর আগে। দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয়েছে দিল্লিতে। নিসর্গের ছবি দিয়েই তিনি ফিরে এসেছেন তাঁর সৃজনের জগতে। এ বারের তৃতীয় এককের প্রায় ৪০-টি ছবিতেও নিসর্গই তাঁর প্রধান বিষয়। কয়েকটি ড্রয়িং-এ অন্য বিষয়ও এসেছে।

লক্ষণীয় যেটা, তা হল — ভারতীয় রীতিতে শিখলেও, নিজের ছবিতে তিনি সেই আঙ্গিক অনুসরণ করেননি। গতানুগতিক ভারতীয় চিত্ররীতিতে এখনও কতকগুলি নির্দিষ্ট প্রকরণ ও আঙ্গিক-পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যার ভিতর সাম্প্রতিকের সময় চেতনার স্পন্দন থাকে না। শান্তিনিকেতনে বিনোদবিহারী স্বদেশচেতনার দায়বোধে সম্পৃক্ত থেকেও, সেই গতানুগতিকতাকে সম্পূর্ণ পরিহার করেছিলেন।

মনীষা সেই আদর্শকেই অনুসরণ করেছেন। প্রাচ্যচেতনার ধ্রুপদী উদাত্ততাকে তিনি অনুসরণের চেষ্টা করেছেন কিন্তু আঙ্গিকের মধ্যে এনেছেন প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের এক সংশ্লেষ। তাঁর তেলরঙের ব্যবহারও খুব পরিচ্ছন্ন ও আত্মপ্রত্যয়দীপ্ত। নিসর্গের উদাত্ত সৌন্দর্যই তাঁর সন্ধানের বিষয়, আজকের উন্নয়ন ও জনসংখ্যার চাপে যে সৌন্দর্য ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে। তাঁর নিসর্গ-রচনা সেই বিপন্ন মানবিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

রেখা ও ছায়াতপে গড়া ড্রয়িংধর্মী রচনাগুলিতেও জনমানবহীন এক ব্যাপ্ত পরিসর তিনি রচনা করেন। পুঞ্জ পুঞ্জ ছায়াতপে বৃক্ষ ও গুল্মের আভাস। আলোয় ঝিলমিল করছে ব্যাপ্ত প্রকৃতি। দিগন্তরেখার উপরে বিস্তীর্ণ আকাশ। শূন্যতার এক প্রদীপ্ত ভাষা তিনি সন্ধান করেছেন, যা অনেকটাই সাঙ্গীতিক। তেলরঙের ছবিতে তিনি সেই শূন্যতা নির্মাণ করেছেন বর্ণের বুননে।

বৃন্দবাদনের মতো একাধিক বর্ণের সংলাপ তৈরি করেছেন। কখনও বা বালিয়াড়ির মধ্যে প্রবহমান স্রোতস্বিনীর রূপ ধারণ করেছে। কখনও বা এনেছে অরণ্যের আভাস। কোনও মৃত পশু বা পাখি পড়ে আছে ভূমিতলে, এ রকম। এক দিকে বিপন্ন বাস্তবতা আর এক দিকে তাকে অতিক্রম করার চেষ্টা — এই দুই দর্শনে আন্দোলিত হয়েছে তাঁর চিত্রচেতনা।

প্রদর্শনী চলছে

সিমা: • সুষেন ঘোষ ১৯ পর্যন্ত। অ্যাকাডেমি: • চিত্রনিভা চৌধুরী ১৭ পর্যন্ত।

•পার্থ দত্ত ও ডলি দত্ত ১৭ পর্যন্ত।

• শান্তনু রায় ১৭ পর্যন্ত।

• জয়দেব বালা ১৭ পর্যন্ত।

বিড়লা অ্যাকাডেমি: • পেইন্টার্স-৮০ কাল শেষ।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy