Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২

এখনও বাকি আছে ‘আরণ্যক’ আবিষ্কার

আরণ্যক-এর পুনর্জন্ম অপেক্ষা করে আছে। পুনর্জন্ম কথাটা সুপ্রযুক্ত হল না হয়তো। বিভূতিভূষণের অন্য বেশ কিছু বহুলপঠিত রচনার মতোই আরণ্যক কখনও অবসিত হয়নি। তবু, তাকে আবিষ্কার এখনও বাকি আছে। গত কয়েক দশকে আমাদের বোধের জগতে যত পরিবর্তন এসেছে, তার প্রেক্ষিতে এর পাঠও বদলে যাওয়ার কথা। ভানুমতীর কুড়িয়ে আনা কয়েকটা ফুল আদিবাসী রাজা দোবরু পান্নার সমাধির ওপর ছড়িয়ে দিয়ে সত্যচরণের মনে হয়েছিল, এই প্রথম আর্যজাতির পক্ষ থেকে কেউ একজন অনার্যকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করল।

যুধাজিত্‌ দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

আরণ্যক-এর পুনর্জন্ম অপেক্ষা করে আছে। পুনর্জন্ম কথাটা সুপ্রযুক্ত হল না হয়তো। বিভূতিভূষণের অন্য বেশ কিছু বহুলপঠিত রচনার মতোই আরণ্যক কখনও অবসিত হয়নি। তবু, তাকে আবিষ্কার এখনও বাকি আছে। গত কয়েক দশকে আমাদের বোধের জগতে যত পরিবর্তন এসেছে, তার প্রেক্ষিতে এর পাঠও বদলে যাওয়ার কথা। ভানুমতীর কুড়িয়ে আনা কয়েকটা ফুল আদিবাসী রাজা দোবরু পান্নার সমাধির ওপর ছড়িয়ে দিয়ে সত্যচরণের মনে হয়েছিল, এই প্রথম আর্যজাতির পক্ষ থেকে কেউ একজন অনার্যকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করল। এই বাক্য ১৯৩৭-৩৮-এ লেখা! দলিত উত্থান, নিম্নবর্গীয় চর্চা, অরণ্যের অধিকার আইন, অরণ্যবাসীদের জড়িয়ে আন্দোলন ইত্যাদি সাম্প্রতিক ইতিহাসের জমি আরণ্যক-এ জেগে উঠছে। এদিকে দেখছি অরণ্য-পর্যটনের নামে প্রমোদলোলুপ মানুষের দাপাদাপি। আরণ্যক-এর পুনর্জন্মের এই-ই প্রকৃষ্ট সময়।

আরণ্যক উপন্যাস বটে, কিন্তু তার উপাদান বিভূতিভূষণের অভিজ্ঞতা থেকে টেনে আনা, তা নিঃসন্দেহে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। আলোচ্য বইটি সেই প্রত্যক্ষদর্শিতার সূত্র টেনেই গাঁথা। তাই ৭২৮ পৃষ্ঠার গ্রন্থে আরণ্যক ছাড়াও বিভূতিভূষণের অরণ্যভ্রমণকাহিনি, অরণ্যবাসের বিবরণ সংবলিত দিনলিপি, গল্প, চিঠিপত্র আছে, কিন্তু আদ্যোপান্ত কল্পনায় গাঁথা চাঁদের পাহাড় নেই। অক্লান্ত চারণিক বিভূতিভূষণের অরণ্য-অভিজ্ঞতার পরিসরটা ছোট নয়। প্রথম জীবনে গোরক্ষণী সভার প্রচারক হয়ে আরাকান ইয়োমা-র অরণ্যে একের পর এক ডাক-হরকরার সঙ্গ নিয়ে তিনি হেঁটে গেছেন গভীর বন ভেদ করে। খেলাতচন্দ্র ঘোষের এস্টেটের ম্যানেজার হয়ে ভাগলপুরের দিয়ারার জঙ্গল-প্রান্তরে পদব্রজে, ঘোড়ায় চড়ে ভ্রমণ। শেষ জীবনে ওড়িশা, সিংভূম, মধ্যপ্রদেশের নানা অরণ্যে মোটরে, পদব্রজে যাত্রা। এ ছাড়া শিলং, চট্টগ্রাম ইত্যাদি। নিয়মিত সঙ্গীদের অন্যতম ডি এফ ও যোগেন্দ্রনাথ সিংহ। তাঁর হিন্দিতে লেখা ‘পথের পাঁচালি-কে বিভূতিবাবু’র বাংলা অনুবাদ এখানে যুক্ত হয়েছে। কালানুক্রমিক ভ্রমণপঞ্জির সঙ্গে উল্লিখিত স্থানগুলির মানচিত্র থাকলে ভাল হত।

বিভূতিভূষণ নিয়মিত বিশদ দিনলিপি লিখতেন। দিনলিপির বৃত্তান্তকে প্রসাধিত ভ্রমণকাহিনির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার ঝোঁক আসে স্বভাবত। সুপ্রভা দত্ত (চৌধুরী)কে এক চিঠিতে লেখা কোনও অপরাহ্ণের ঘটনাপ্রবাহ প্রায় অপরিবর্তিত উঠে এসেছে ‘অরণ্যে’ গল্পে। আবার দিনলিপি আর ভ্রমণকাহিনির অসঙ্গতি ভবিষ্যতের গবেষকদের কৌতূহলী করে তুলবে বলে মনে হয়।

বইটির দীর্ঘ ভূমিকার অধিকাংশ জুড়ে সম্পাদক চণ্ডিকাপ্রসাদ ঘোষাল বিভূতিভূষণের অরণ্যমগ্নতার পিছনে কোন প্রেরণা কাজ করেছিল তার সন্ধান করেছেন। অরণ্যের বিস্তারে সৌন্দর্যের অন্বেষণ আসলে শিক্ষিত নাগরিক মনের কাজ, এটা বিভূতিভূষণের উপলব্ধি। সম্পাদক প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন যে, তিনি সেটা পেয়েছিলেন ইউরোপীয় বা মার্কিন সাহিত্যের সূত্রে, যেখানে অরণ্য ১. নাগরিক কোলাহল থেকে পলায়নের এক সবুজ পরিসর, ২. ঈশ্বরের প্রতিনিধি, ৩. ‘ল্যান্ডস্কেপ-সন্ধানী পর্যটক দৃষ্টিসুখ চরিতার্থ’ করার মাধ্যম। আঠারো-উনিশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যের উদ্ধৃতি টেনে সম্পাদক তাঁর মত সাজিয়েছেন। সুনীতিকুমার অথর্ববেদের সূত্র টেনে লিখেছিলেন, বিভূতিভূষণ ‘আরণ্যসূক্তের... দ্রষ্টা ভাবযুক্ত এ যুগের এক নবীন ঋষি।’ তাঁর আরণ্যক চেতনার মূল উপনিষদে। বর্তমান সম্পাদক এটি নাকচ করেছেন। তাঁর মত, ধন্‌ঝরি শৈলমালায় বিভূতিভূষণের দৃষ্টি ছিল আদিমতর, প্রাক-বৈদিক পৃথিবীর দিকে নিবদ্ধ। সুনীতিকুমারই সঠিক এমনটা বলতে না চাইলেও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, সালতামামির প্রশ্ন ওঠে প্রকৃতির শরীর সম্পর্কে। দ্রষ্টার অন্বেষণ এগোয় শরীরকে জড়িয়ে অথচ তাকেও ছাড়িয়ে গভীরতর, ব্যাপকতর সংযোগের দিকে। সেই ভাবনা কোনও কালসীমায় গিয়ে ঠেকে যাওয়ার নয়।

আঠারো-উনিশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যের প্রকৃতিবরণই বিভূতিভূষণের মানসজগত্‌ গড়েছিল কি না তা শেষ অবধি তেমন ফোটে না। বরং সম্পাদকের বাড়িয়ে দেওয়া অন্য আর-এক ভাবনা বেশি স্পষ্ট— যদিও, সিদ্ধান্ত সঠিক হওয়া সত্ত্বেও বর্ণনার সময় কোথাও কোথাও প্রেক্ষিতটা বিকৃত হয়েছে। জে ডি হুকার প্রমুখ প্রকৃতিবিদকে ভারত সহ পৃথিবীর নানা ক্রান্তীয় অঞ্চলে ঠেলে পাঠানোর মূলে কিন্তু সে সব দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্বেষণ, ল্যান্ডস্কেপ রচনার তাগিদ ছিল না। ছিল অর্থকরী উদ্ভিদ আয়ত্তে রাখার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিযোগিতা। কিন্তু যেহেতু এই মানুষেরা ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, তাই ঔপনিবেশিক স্বার্থ চরিতার্থ করার পাশাপাশি (কখনও তা বিসর্জন দিয়েও) তাঁরা মানুষের মজ্জায় যে এক্সপ্লোরার রয়েছে, তাকেই অনুসরণ করেন। বিভূতিভূষণের বন্য রোমান্টিকতা আসলে এই এক্সপ্লোরারদের পদাঙ্কবাহী। কুক, হুমবোল্ট থেকে হুকার, হাক্সলি, ডারউইন, ওয়ালেস, বেটস, স্প্রুস সহ আরও অনেকের নাম আসবে এই প্রসঙ্গে। তাই তাঁর ভ্রমণকাহিনির নাম ‘অভিযাত্রিক’। অরণ্য বিভূতিভূষণের কাছে দুর্জ্ঞেয়, রহস্যময় প্রকৃতিরই এক বিশেষ প্রকাশ, বারংবার অন্বেষণেও যার অন্তস্তলটি যেন অধরাই থেকে যায: ‘কিন্তু যে-কথাটা বার বার নানা ভাবে বলিবার চেষ্টা করিতেছি, কিন্তু কোনো বারই ঠিকমতো বুঝাইতে পারিতেছি না, সেটা হইতেছে এই প্রকৃতির একটা রহস্যময় অসীমতার, দুরধিগম্যতার, বিরাটত্বের ও ভয়াল গা-ছম-ছম-করানো সৌন্দর্যের দিকটা। না দেখিলে কী করিয়া বুঝাইব সে কী জিনিস!’ এই ‘বিরাট’ সৌন্দর্যের বিন্দুতেই ওয়ালেস-জিনস-হকিং-এর বিশ্ব আর উপনিষদীয় বিশ্ব এসে পরস্পরের হাত ধরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE