Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক ১...

‘জরায়ুর কান্না’ নয়, সুস্থ স্বাভাবিকতা

ঘোড়ার পিঠে দ্রুত ধাবমান ঝাঁসির রানির পিছনে তাড়া করেছে ব্রিটিশ বাহিনী। সে রাতের মতো রানি আশ্রয় নিলেন কাল্পি-র এক গুদামঘরে। পরদিন ভোরে নিজেকে আকস্মিক রজস্বলা দেখে রাগে, ক্ষোভে রানির কি আকুল কান্না। তাঁর শরীর যেন বিদ্রোহ করল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনের সঙ্গে, লিখছেন বিষ্ণুভাট গডসে ভারসাইকর, ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সমসাময়িক স্মৃতিকথা মাঝা প্রভাস-এ।

বর্ণালী পাইন
এগারোয় পা/ মেয়েদের অন্তরঙ্গ কথা, সম্পা: শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত অহনা বিশ্বাস। গাঙচিল, ৩৫০.০০ শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:১০
Share: Save:

ঘোড়ার পিঠে দ্রুত ধাবমান ঝাঁসির রানির পিছনে তাড়া করেছে ব্রিটিশ বাহিনী। সে রাতের মতো রানি আশ্রয় নিলেন কাল্পি-র এক গুদামঘরে। পরদিন ভোরে নিজেকে আকস্মিক রজস্বলা দেখে রাগে, ক্ষোভে রানির কি আকুল কান্না। তাঁর শরীর যেন বিদ্রোহ করল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনের সঙ্গে, লিখছেন বিষ্ণুভাট গডসে ভারসাইকর, ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সমসাময়িক স্মৃতিকথা মাঝা প্রভাস-এ।

সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক নিয়মে এগারো-বারো বা আর একটু বেশি বয়সে সৃষ্টি জুড়ে সব মেয়ে হঠাৎ এক দিন নিজেকে রক্তাক্ত আবিষ্কার করে। অধিকাংশ মেয়েরই এ বিষয়ে কোনও পূর্বজ্ঞান থাকে না পরিবারের বড়দের কুসংস্কারের কারণে। আদি কাল থেকে প্রায় সব ধর্মই মেয়েদের এই প্রতি মাসের রক্তপাতকে কেন্দ্র করে হাজারো শুচি-অশুচির বিধিনিষেধ জারি করেছে। তাতে তাল দিয়ে সমাজও বিষয়টি নিয়ে গোপনীয়তা রক্ষায় অভ্যস্ত। আলোচ্য বইটিতে বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানের তেরো থেকে নব্বই বছরের ২৯ জন নারী মুখ খুলেছেন অনর্গল স্পষ্টবাদিতায় যন্ত্রণা, দুঃখ, প্রতিবাদ উঠে এসেছে ভিতর থেকে। অনেক কপালেই ভাঁজ ফেলবে এমন বেআব্রু সত্যভাষণ।

অহনা বিশ্বাসের খাঁটি কথা, ‘সমাজ যে স্বাভাবিক ঘটনার ওপর অশুচি তকমা দিয়েছে তার সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনাও অশালীন বিবেচ্য হয়।’ লেখক তালিকায় সর্বজ্যেষ্ঠ নব্বই বছরে সদ্যপ্রয়াত সাধনা চক্রবর্তীর আক্ষেপ, জ্বর-জ্বালায় ভাই, বাবা তাঁর কুশল জানতে চাইলেও ‘মাসের ওই ক’টা দিন’ অতি স্রাব ও পেট, কোমরের যন্ত্রণায় শয্যাশায়ী কিশোরীটির অস্তিত্বই অস্বীকার করতেন তাঁরা। পরে নিজের মেয়েকে উচ্চশিক্ষার সমস্ত সুযোগ দিয়েও তাঁর অনড় অবস্থান, ‘মেয়েকেও কখনও ওই সময় ঠাকুরঘরে ঢুকতে দিইনি। ‘নোংরা রক্ত’ নিয়ে কি ঠাকুরকে ছোঁয়া যায়?’’ ত্রিশ বছরের কলেজ-শিক্ষক সামসুন নিহার এখনও বিশ্বাস করেন, ‘এই না-পাক অবস্থায় আচার নাড়তে নেই। ... তাহলে আচার নষ্ট হয়ে যায়। এই সংস্কারের প্রমাণও আমি হাতেনাতে পেয়েছি।’

মুক্ত মনের মানুষ হয়েও মা কন্যাসন্তানকে এ বিষয়ে সচেতন করেননি বলে আক্ষেপ করেছেন নবনীতা দেবসেন। এই যে ছোট মেয়েটিকে সম্পূর্ণ অজ্ঞ করে রাখা, এই মানসিক পীড়ন আসে অতি প্রিয়জন, যেমন মা’র কাছ থেকে। সুস্থ শারীরিক ক্রিয়ায় ‘শরীর খারাপ’ তকমা এঁটেছে সমাজ। শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত তাঁর এক রগুড়ে মাসির মুখে ‘তোর তো ফোঁড়া ফেটে গেছে’ শুনে অবাক হয়েছিলেন। ‘ফোঁড়া ফাটা’ মানে যে বড় হয়ে যাওয়া, বলেছিলেন মা। এই ‘গোপন’, ‘অশুচি’ বিষয়টির নির্দিষ্ট নাম পর্যন্ত নেই। শর্মিষ্ঠার কথায়, ‘‘চারুদি বিধবা কাজের লোক বলত ‘মাসিক’। ‘শরীর খারাপ’ কথাটাই চালু ছিল সবচেয়ে বেশি।’’ নীপমঞ্জরী সাহা বর্মণ মনে করান, ডাক্তাররা ‘মাসিক’ শব্দটিই ব্যবহার করেন। স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মা জানিয়েছিলেন আমার ‘পিরিয়ড’ হয়েছে... পরে জেনেছিলাম এর ডাক্তারি পরিভাষা ‘মেন্সট্রুয়েশন’।... টের পেয়েছিলাম যে, ইংরেজি ও বাংলা, দুই ভাষার মধ্যে বিভক্ত এক বালিকা-কিশোরীর জীবনে মডার্ন হওয়ার দায় বহন করতে হলে, বাদ পড়ে যায় বাংলা ভাষা সাহিত্য থেকে সংগৃহীত যৌন-অস্তিত্বের শব্দভাণ্ডার।’

এমন যে শরীরের নিয়মমাফিক রক্তস্রাব, তাকে সামাল দিতে কাপড়, তুলো, প্যাড ব্যবহারের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন লেখকরা। স্কুলজীবনে ঘরোয়া প্যাড ব্যবহারে বাধ্য হওয়া যশোধরা রায়চৌধুরীর অকপট স্মৃতি-উদ্ধার, ‘মনে আছে ভেপসে-ওঠা গরমে প্যান্টির ভেতরে লাইনিং ধরে র্যাশ হয়ে যাওয়ার অনুভূতি।... আর মনে পড়তে থাকে সেই মাছের রক্তের গন্ধটা... প্রবল মনখারাপের কৈশোর, অনেকটাই কেটেছে এই বিষাদে।’ বয়ঃসন্ধির বিষাদ চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘বাড়ির সকলের দমচাপা হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে খুব কিছু পাপ করে ফেলেছি। ফাদার ফালোঁ যেমন মরাল সায়েন্স ক্লাসে বারবার আমাদের ‘ঈশ্বরের কন্যা’ বলেন, তেমনটি আর তো রইলাম না।” ট্রান্সপার্সন বা রূপান্তরকামী প্রভাত নিজেকে মনে মনে ছেলে ভাবলেও তার মেয়ে-শরীরে বারো বছর বয়স থেকে মাসিক শুরু। ‘মেয়েরা মাসিক না হলে চিন্তায় পড়ে যায়, আর আমি মাসিক হলে ভাবি যে কেন হল।’ লিঙ্গপরিচয় মানতে না পারার কারণে প্রভাতের যন্ত্রণা দ্বিগুণ হয়ে যায়।

অণিমা বিশ্বাসের মেয়েবেলায় তুতো ভাইবোন মিলে সাতচল্লিশের মধ্যে আঠাশ জন মেয়ে— ‘কখনও দড়ি খালি দেখিনি। শুধু শুকনোগুলোর বদলে ভেজাগুলো জায়গা করে নিত।’ এত কাপড় জোটানো মুশকিল ছিল সীমান্ত-ঘেঁষা নিম্নবিত্ত বাড়িটিতে। ’৭১-এর এক মুক্তিযোদ্ধা ‘দিদি ক্যাঁথা সিলাইবেন’ বলে যে বড় রোল করা প্যাকেট দিয়ে গিয়েছিলেন, অণিমা ‘বড়’ হলে মা সেই যত্নে রাখা গজ কাপড় দিয়ে তাঁকে প্যাড বানিয়ে দেন। আর যাদের পরণেই কাপড় জোটে না, কেমন করে যুঝবে তারা ওই রক্তাক্ত চার-পাঁচ দিন? বাণী সিংহ ছেচল্লিশের মন্বন্তরে দেখেছেন, দুর্ভিক্ষগ্রস্ত মেয়েদের পা দিয়ে সমানে রক্ত গড়াচ্ছে। খরা, বন্যা, নদীভাঙন, রাজনৈতিক তাণ্ডবে ঘরছাড়া হতদরিদ্র মানুষদের ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন থাকে কি?

কেমন আছেন মানসিক হাসপাতালের মেয়েরা? ঠিক এই মুহূর্তের দমবন্ধ অস্বস্তিকর ছবিটা উঠে এসেছে হাসপাতালের চার জন রোগীর কথায়। মানসিক রোগী বলে যাঁরা হাসপাতালে ভর্তি, সুষ্ঠু ভাবে প্যাড নিতে তাঁরা অপারগ হবেন, কর্তৃপক্ষ কি তাও জানেন না? এমনই এক জন বলেছেন, ‘সবাই খুব নোংরা করে, ঠিক করে কিছু নিতে পারে না। বাচ্চাদানি বাদ দিয়ে দিলে মেনোপজ হয়ে যাবে। ... কিন্তু সেটা করা যায় না। ধরো যদি কারও বিয়ে হয়, তখন?’ সত্তরের দশকে প্রচণ্ড অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মাসের পর মাস শহরের বস্তিতে মেয়েদের দেখেছেন কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে জেলে তাঁর অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা— ছেঁড়া কম্বলের টুকরো, চট, বা কাগজ পাকিয়ে যোনির মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতে দেখেছেন মেয়েদের। টানা প্রতিবাদের জেরে ফিমেল ওয়ার্ড থেকে আসা বড় বড় গজ আর তুলো দিয়ে কৃষ্ণার বানানো প্যাড পেয়ে আরাম পেয়েছিল তারা। আর সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে মধ্যবিত্ত স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে বেরনো কৃষ্ণার ছিল বাড়ি থেকে আনা ছেঁড়া শাড়ি ধুতি সম্বল, কাচতে কাচতে জীর্ণ হয়ে গেলে সেগুলিই হত ‘গোপন রান্নার জ্বালানি’।

উম্মেনাদরা ফরজানা, তানভির নাসরিন, কৃত্তিকা তাবাসসুম— এক পরিবারেরই তিন প্রজন্মের নারীর কথা জানা গেল। ফরজানা-র মা ছবি দেখিয়ে মেয়েকে যোনির কার্যকলাপ বুঝিয়েছিলেন, এই মায়ের দিদা শিখিয়েছিলেন শুচিতা রক্ষার নিয়ম। তানভিরের উপর মা ফরজানা ও দিদিমা ধর্মীয় বিধিনিষেধ চাপাননি। তানভির-কন্যা কৃত্তিকা স্বাভাবিককে স্বাভাবিক জেনেই বড় হচ্ছে, যেমন হচ্ছে যশোধরা-কন্যা বা স্বাতী ও কৃষ্ণার বোনঝি-রা। তবে বাবা, দাদা, ভাইয়ের সঙ্গে খোলামেলা কথা, টিভিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন এক দিকে, অন্য দিকে ওষুধের দোকানে ন্যাপকিনের প্যাকেট কাগজ বা কালো প্লাস্টিকে মুড়ে দেওয়ার সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

নীপমঞ্জরী সাহা বর্মণ মা’র কাছ থেকে ‘মামণির বড় হওয়ার সাথে মায়ের এই উপহার’ লেখা বই পেয়েছিলেন। চৈতালী চট্টোপাধ্যায় বলেছেন ইংগা মুসিনো-র কান্ট বইটিতে পড়া প্রথম ঋতুমতী হওয়ার পারিবারিক উদ্যাপনের কাহিনী। বস্তুত গোপনীয়তার উল্টো মেরুতে এর চরম অবস্থান। শরীরের অতিপ্রয়োজনীয় রক্তপাতে স্বাস্থ্য আছে, লজ্জা নেই এতটুকু, এটিই জরুরি শিক্ষা। অহনা বিশ্বাসের উপযুক্ত প্রস্তাব— গোপনীয়তা ভেঙে রেশনের মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে প্যাড বিক্রি হোক, স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি উদ্যোগী হয়ে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পাশাপাশি ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যসম্মত প্যাডকে সহজলভ্য করে তুলুক, ছেলেমেয়ে দু’জনই বয়ঃসন্ধির শিক্ষা পাক, ঋতুমতী হওয়ার অর্থ যে গর্ভধারণের সামর্থ্য তা স্পষ্ট করে দিয়ে কিশোরীটিকে এ হেন বিপদ থেকে মুক্ত রাখুন। কারণ রাতারাতি কেউ ‘বড়’ হয় না। ‘নারী হয়ে ওঠার কোনও লক্ষণই নেই রোগা-পাতলা বালিকাদেহে। খালি তলপেটের নীচে ব্যান্ডেজ। যেন সম্পূর্ণ আমার অজ্ঞাতে কেউ রাত্তিরবেলা ধারালো ছুরিতে ফালাফালা কেটে গেছে আমার অভ্যন্তর। রেখে গেছে একটা দ্বিধা-বিভক্ত অস্তিত্ব। বালিকা ও নারী’। (স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়)

দ্য রিটার্ন অব দ্য ফেমিনাইন (২০১০) বইয়ে রেবেকা ওরলিয়ন লিখেছেন, ‘আমরা মেয়েরা যা রাখতে চাই না, প্রতি মাসের যোনি-রক্তপাতের মধ্যে তা বর্জন করে চলি— গত মাসের দ্বন্দ্ব, আঘাত, যন্ত্রণা ছাড়িয়ে নতুন ভাবে নিজেকে গড়ার প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হই।’ প্রায় অর্ধ শতক আগে লজ্জা ভয় বিসর্জন দিয়ে বাবাকে বুঝিয়ে যৌথ পরিবারের সংস্কারের গণ্ডি পেরিয়ে আমার মা দুটি কন্যা সন্তানের জন্য আলাদা সংসার পেতেছিলেন যাতে নারীজন্মে অশুচি কিছু নেই এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা বাঁচতে শিখি। শেফালী মৈত্রের কথার সূত্র ধরে বলি, যোনিরক্ত মেয়েদের শরীরে স্বাভাবিক-- মাতৃত্বের সঙ্গে সব সময় তাকে জড়িয়ে ফেলা নিষ্প্রয়োজন। এই জরুরি উপলব্ধিই ‘জরায়ুর কান্না’ নামক মিথটিকে জোরাল ভাবে খারিজ করে দেয়। মেয়েদের এই জোরের জায়গাটা তৈরি করার জন্য রক্তের অক্ষরে লেখা এগারোয় পা বইটির গভীর প্রয়োজন ছিল।

জয়পুরিয়া কলেজে ইংরেজির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE