Advertisement
E-Paper

তাঁরাই বোনেন সমাজকাপড়ের টানাপড়েন

কাউয়া কো কো, আমাগো বাড়িতে আজ শুভ নবান্ন।’ জীবনের একেবারে শুরুর দিকে কলকাতা শহরের কাঠখোট্টা বাতাবরণেই ছাতে উঠে নবান্নর চাল-ফলমাখা খাওয়াতে শিখিয়েছিলেন কাকেদের ডেকে, আমার দিদা।

যশোধরা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
পুবালি পিঞ্জিরা। সামরান হুদা। গাঙচিল, ৪৫০.০০

পুবালি পিঞ্জিরা। সামরান হুদা। গাঙচিল, ৪৫০.০০

কাউয়া কো কো, আমাগো বাড়িতে আজ শুভ নবান্ন।’ জীবনের একেবারে শুরুর দিকে কলকাতা শহরের কাঠখোট্টা বাতাবরণেই ছাতে উঠে নবান্নর চাল-ফলমাখা খাওয়াতে শিখিয়েছিলেন কাকেদের ডেকে, আমার দিদা। সেই সব দিদা, সেই সব মা-মাসিমারা, যাঁরা নিজেদের জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গে, একেবারে প্রকৃতির বুকে, একটি ভরভরন্ত সমাজে। গ্রাম-শহরের দুর্লঙ্ঘ্য দূরত্ব তৈরি হয়নি তখনও। নিজেদের গ্রামীণ, কৃষি-কৃষ্টির শিকড় তখনও জলজ্যান্ত। কোথাও কোনও বিচ্ছেদ নেই, আম্বিলিকাল কর্ড কাটা মাতৃ-ছিন্নতার বোধ নেই।

তারপর আসে তাঁদের জীবনের ঝড়বিধ্বস্ত সময়গুলি। আসে দেশভাগ। মনের ভেতর শুধু থেকে যায় প্রাচীন সেই যুগবাহিত কৃষি ঐতিহ্য, জলজ ঐতিহ্য।

স্মৃতি মানুষের সংস্কৃতি। আত্মবিস্মৃত মানুষ পাষাণের মতো। আর এই স্মৃতিকথনের মধ্যে দিয়েই তাই রচিত হয় ইতিহাস। রাজারাজড়ার ইতিহাস নয়, ব্যক্তি-মানুষের, বিন্দু বিন্দু বেঁচে থাকার ইতিহাস। বহু আগে পড়েছিলাম আইকন হয়ে যাওয়া বই কল্যাণী দত্তর থোড়-বড়ি-খাড়া। কিছু দিন আগেই পড়েছি সুনন্দা শিকদারের দয়াময়ীর কথা। পড়েছি শান্তা সেনের পিতামহী।

মেমোয়ার নামের একটি খাঁচায় ঠিক আটকে রাখা যায় না এই গ্রন্থদের। মূল সুর অবশ্যই অতীতযাপন। কোন অতীত? সেই যে, সুস্বাদ কথ্যতার যে আবহমানতা আমাদের ছোটবেলায় ছিল, নারীপ্রজন্মগুলিতে, যাদের আজকের কেউ কেউ ‘পূর্বপুরুষ’-এর আদলে ‘পূর্বনারী’ও বলে থাকেন। ইতিহাসের বড় বড় অক্ষরে তাঁদের কথা লেখা হয় না। অথচ তাঁরাই বয়ন করেন সমাজকাপড়ের টানাপড়েন। তাঁরাই সুতো হয়ে ধরে থাকেন।

পূর্ণলক্ষ্মীর একাল-সেকাল। পূর্ণা চৌধুরী। উর্বী প্রকাশন, ১৫০.০০

ইতিহাস এখন ধরা থাকে গোষ্পদে। রাজারাজড়াদের ইতিহাস বিগত এখন। সাধারণ মানুষের ইতিহাসের অঞ্চলটিতে আলো পড়ছে। যে ভাবে ছোট ছোট মানুষের অঞ্চলে, সে ভাবেই মানুষীদের অঞ্চলেও জমে থাকা জলগুলিতে মুখের ছায়া দেখে নিজেদের খুঁজে পাওয়ার সময় এখন। এমনই দুই প্রান্ত থেকে দু’টি বই এসে বেঁধে দিল গিঁট। সাধারণ মানুষের জীবনের ছোট ছোট কথার ভেতর দিয়ে একটা গোটা সময় উঠে আসছে। দুই বইতেই। দু’ভাবে।

পুবালি পিঞ্জিরা-র মধ্যে পাই বহুস্তরীয় একটি কথন। এক দিকে খুঁটিনাটিতে ক্লোজ-আপ দেখি মুসলিম অন্তঃপুরের এক জটিল সূক্ষ্ম ছবি। পরনের কাপড়, ব্যবহার্য আসবাব এবং অনেক তৈজসপত্রের বিবরণের পাশাপাশি পাই, মুরগির ডিম রক্ষা করে, মুরগিকে তা দিতে প্ররোচিত করে ফুটিয়ে বাচ্চা করানোর অথবা পোষা মেনি জরিনা বিবির ইতিবৃত্ত। একটা পরিবারে মানুষের সঙ্গে গাছপালার, মানুষের সঙ্গে পশুপাখির জড়াজড়ি করে থাকার নিখুঁত ছোট ছোট আঁচড়।

দ্বিতীয় এক তলে, মিড শটে ইতিহাস-কথা-গল্প-কিংবদন্তির তিতাসপাড় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কথা, চট্টগ্রামের কথা। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ধর্মভীরু মুসলমানের অত্যন্ত ধীর, নিরুচ্চার, মানবিক, যাপিত জীবন। তার অন্তঃপুরের কথা এক অদ্ভুত ছলাচ্ছল জলের মতো গদ্যবাংলায়।

তৃতীয় তলে, এক লোক সংস্কৃতির যাত্রাপালার পাশাপাশি, অন্ত্যজ গানে-গল্পে বুনে তোলা বিয়ে-শাদি-সন্তানজন্ম-প্রেম-ধর্মাচরণ-রান্নাবান্নায় গাঁথা সমাজের বয়ান, হেঁশেলনামা, পাখিশিকার, মাছধরা, মেয়েলি পাঠের বই ছাড়াও এ এক বিপুল বিচ্ছেদ-বেদনার বইও। ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে যেন ধরা রইল, যে সমাজ আর ফিরে আসে না, আশির দশকের পরবর্তী পাল্টে পাল্টে যাওয়া বাংলাদেশি সমাজের প্রেক্ষিত থেকে পিছনে তাকানো এক সবুজ, নরম, অতি করুণ, আপাতস্বাধীন, সচ্ছল অতীতকথন। যা হারায়, তা কেবলই হারায়। আর পাশাপাশি চিরমানবিক সে সব বেদনাগাথাও লিখে রাখে। সন্তান হারানো মায়ের কান্না অথবা শ্বশুরঘরে মেয়েকে ছেড়ে আসা পাগলিনী মায়ের কষ্ট।

‘‘সমাজ অন্তঃপুরবাসিনীর সামনে যত বড় আয়নাই আঁকতে পছন্দ করুক তার পটে এখনো খেলা করে জিন-পরীদের আসর, অন্তরমহলের কানাকানি, পাগল পড়শি, মাজারে নেশাড়ুদের গানবাজনা, যাত্রাদলে পালানো যুবক, নিজের শরীর চেনা, শিশুমৃত্যু, দাই...ওঝা...ধর্মান্ধতা...’’ (প্রথম ভেতর-প্রচ্ছদের একাংশ)। আর সেই কথাই পুরনো ছাপাই ছবি আর নতুন লিনোকাটের সাজে সাজে মুখর করে উপহার দেওয়া হয়েছে ২৭৯ পাতার বইতে। ছাপাই ছবিগুলোর পাশাপাশি গম্ভীরা গান, তালুকদারের গীত, সিরাজগঞ্জের মেয়েলি গীত, ময়মনসিংহের পালাগান। এই সব মণিমুক্তো তুলে আনার পাশাপাশি ঘরোয়া আসবাব, তৈজসপত্রের বিবরণ মুহূর্তে টেনে নেয় অতীতের বসবাসে। দূরের বসবাসেও।

এই বই থেকেই জানি, হিন্দু ঘরে মা-ষষ্ঠীর ব্রতপালনের জন্য পোষা বেড়ালের প্রতি মায়া-মমতার মতোই মুসলিম ঘরেও সন্তানবতী নারীর পশু সংরক্ষণের ঐতিহ্য। প্রচলিত স্টিরিওটাইপের বাইরে দেখতে শিখি কত না যত্নময় শাশুড়িকে, বউমার প্রতি স্নেহবশ।

পূর্ণলক্ষ্মীর একাল-সেকাল বইটির প্রস্থানবিন্দু আলাদা। এ বই দুই সময়কে ধরতে চেয়েছে। এও অতীত চয়ন করে। কিন্তু আত্মজৈবনিক অথচ আত্মজৈবনিক নয় এ বই। এ বই আমাদের সবার আবার বিশিষ্টও বটে। হিন্দু মধ্যবিত্ত, পূর্ববঙ্গের একদা প্রতিষ্ঠিত সচ্ছল এবং উদ্বৃত্ত উপভোগ করা একটি রক্ষণশীল পরিবারের সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার শিক্ষিত হয়ে উঠতে চাওয়া, লিবারাল হয়ে ওঠার যাত্রাকথন বোধহয় পূর্ণা চৌধুরীর পূর্ণলক্ষ্মীর একাল-সেকাল।

এ বই পড়তে পড়তে, সব কিছুই মনে হয় ‘কেমন যেন চেনা-চেনা’! আমার মনে পড়ে, মা-মাসি-দিদা, ঠাকুমা, পিসিদিদা...এঁদের চোখ গোল করে কথা বলা বকুনি গল্পবলা কাহিনিকথন চুটকি ছড়াকাটা গানবাঁধা— সব মিলিয়ে একটা ধারাবাহিক আড্ডার মেজাজ। যে বাড়িগুলোর ছাত হত উঁচু, খাটে থাকত কাঠের কারুকার্য, আর যে বাড়িগুলো হত বহুমানুষসম্পৃক্ত। এবং সে সব মানুষ একে অপরের সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মিলেমিশে থাকত, অথচ কে যে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আর কে অনাত্মীয়, সে প্রশ্ন উঠত না।

এই সমাজটা এখন বিলীয়মান। একটা জগৎ ছায়াবাজির মতো মিলিয়ে যাওয়ার আগে বালির ওপর দাগ রেখে যাওয়ার মতো রেখে যাচ্ছে কিছু স্মৃতি, কিছু স্বপ্ন-স্বপ্ন-ছবি, কোনও কোনও তরুণীর মনে, কোনও কোনও বড় হয়ে যাওয়া নাতনির ভেতরে। তা থেকে নিজেকে মুক্তি দিতেই অনেকে এগিয়ে আসছেন এই প্রাচীন, হারানো সময়টাকে লিখে রাখতে, লিখে ফেলতে। স্বাদু গদ্যে, অনেকটা সেই আড্ডাগুলির মতোই, যেগুলি ঘটে উঠত ছাতে-ছাতে, বারান্দায়-বারান্দায়, ঘরে-ঘরে। আর পাচ্ছি অনেকটা তথ্য, রসালো স্মৃতির ভিয়েনে জড়ানো। টুকরো একটা সংস্কৃতি। সে গদ্যে অবলীলায় ঢুকে যায় স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে সুচিত্রা সেন, ইংরেজি শিক্ষা থেকে বিদেশিনি বউমাকে অনায়াসে কাছে টেনে নেওয়া।

পূর্ণলক্ষ্মীর ভেতরে ভরা আছেন আমাদের অনেকের দিদারা। যাঁদের ভেতর দিয়ে পরতে পরতে বয়ে গিয়েছে গোটা ইতিহাসটাই। আর পূর্ণা চৌধুরী কতগুলি সূক্ষ্ম উল্লম্ফনশীল বিবরণে তাদের ধরে ফেলেছেন। পারিবারিক ইতিহাস আর পারিবারিক থাকেনি তখন, হয়ে উঠেছে পারম্পর্যে সম্পৃক্ত।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy