Advertisement
E-Paper

বাঙালির ইতিহাসে ’৪৭ কেবল খণ্ডিত মুহূর্ত

আগরতলার পনেরো মাইল দূরে সীমান্তে কমলাসাগর গ্রাম। সীমান্তরেখা পেরোলেই ভিনদেশ পূর্ব পাকিস্তান। সেখান থেকে রাতের অন্ধকারে এক মহিলা তাঁর শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে পালিয়ে এলেন। সঙ্গে আনতে পারলেন না অশীতিপর অসুস্থ স্বামীকে।

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১

আগরতলার পনেরো মাইল দূরে সীমান্তে কমলাসাগর গ্রাম। সীমান্তরেখা পেরোলেই ভিনদেশ পূর্ব পাকিস্তান। সেখান থেকে রাতের অন্ধকারে এক মহিলা তাঁর শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে পালিয়ে এলেন। সঙ্গে আনতে পারলেন না অশীতিপর অসুস্থ স্বামীকে। ‘এক দিকে পঙ্গু স্বামী, অন্য দিকে শিশুপুত্র, এক জনকে বাঁচাতে গিয়ে আর এক জনকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ফেলে আসতে হল শেষে।… সীমান্তে দাঁড়িয়ে দূর গ্রামের দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখে অঝোর ধারা।’

ভাষা ও ভাব দুটোই খেয়াল করার মতো। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকার এই প্রতিবেদন বুঝিয়ে দেয়়, পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির খবর তখন কী ভাবে পশ্চিমবঙ্গীয় পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, কত তীব্র সহমর্মিতার পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে। সীমান্ত, বাঙালি, সবই আবার নতুন চোখে দেখতে সাহায্য করছে সেই পরিবেশ। বাঙালি আইডেন্টিটির নতুন ইতিহাস তৈরি হচ্ছে। ইতিহাস তো কেবল ঘটনা দিয়েই তৈরি হয় না, ঘটনার বিবরণ কিংবা স্মরণ, যা সামাজিক মনে গভীর, দীর্ঘস্থায়ী ছাপ তৈরি করে রেখে যায়, তার উপর ভর করেও ইতিহাস দাঁড়িয়ে থাকে। তাই, ও-বাংলার মুক্তিযুদ্ধ যেমন বাংলার আধুনিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, এ-বাংলার সংবাদপত্রে সেই সংগ্রামের ধারাবিবরণী যে ভাবে ‘রচিত’ হচ্ছে, সেটাও বাঙালির ইতিহাসের কম জরুরি উপাদান নয়! ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস চতুর্থ খণ্ডের তিনটি পর্বের তিনটি বই হাতে নিয়ে এই কথাটাই মনে হল, কেননা ঘটনার তথ্য পরিবেশনের সঙ্গে অনেকখানি জায়গা এখানে দেওয়া হয়েছে ঘটনার প্রতিক্রিয়া, প্রতিফলন ও পরবর্তী স্মরণের উপর। ভূমিকাতেই বলা আছে, বাংলার সামগ্রিক ইতিহাস রচনার লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ।

‘সামগ্রিক’ কথাটা বেশ সমস্যাজনক। তবু বহুকৌণিক বিশ্লেষণে, বহু-আঙ্গিকের রচনায় একটা বড় ইতিহাসকে ধরার চেষ্টা এতে চোখে পড়বেই। এই বড় ইতিহাসের শেষাংশে এসে চতুর্থ খণ্ডের বিষয় মার্চ ১৯৭১ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭২। কেন এই দেড় বছর এতখানি গুরুত্ব পায়, ভূমিকায় এবং প্রবন্ধগুলিতে সেটা ভাল ভাবেই প্রতিষ্ঠিত। শামসুজ্জামান খান যেমন স্পষ্ট বলেছেন, বাঙালি আসলে ভারতের একটি প্রান্তিক জনবসতি, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারার সমন্বয়ে তৈরি হলেও সেই সব ধারার মূলস্রোত থেকে আলাদা তার নিজস্ব আইডেন্টিটি। আর, স্বতন্ত্রতা-ঋদ্ধ এই বাঙালি জাতির রাজনৈতিক আত্মপ্রতিষ্ঠার সময়টি হল ১৯৭১। পশ্চিমবঙ্গে বসে আমরা নিশ্চয়ই ব্যাপারটা এ ভাবে ভাবি না। কিন্তু মানতেই হবে, মুসলিমপ্রধান পূর্ব বাংলার দৃষ্টি থেকে কথাটির তাৎপর্য যথেষ্ট। সাতচল্লিশ সালের পনেরোই অগস্ট যতই যুগান্তকারী হোক, বাংলার ইতিহাসে সেই মুহূর্তটির গুরুত্ব নেহাতই ক্ষণস্থায়ী এবং খণ্ডিত। বাংলার ইতিহাস, আরও ঠিক করে বলতে গেলে, বাঙালির ইতিহাস ১৯৭১ সালে এসে একটা অর্থময়তা পেল, যদিও তার খণ্ডিত রূপটি ঘুচল না।

তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এ বাংলায় পত্রপত্রিকা কী লিখছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ভাবে বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি তৈরি হয়েছিল, কী ছিল তাদের লক্ষ্য, কী ভাবে তাদের সংগৃহীত অর্থ দিয়ে ত্রাণের কাজ চলত, কিংবা বাঙালি নৌবাহিনীর ভূমিকা, বাঙালি ছেলেদের গেরিলা কর্মপদ্ধতি, এ সব মিলেই বাঙালির ইতিহাসের একটা বড় ছবির নির্মাণ। এত দিন অবধি এই সব ছিল শোনা কাহিনি, কিংবা প্রকাশিত সংবাদ— সুসংবদ্ধ ইতিহাস নয়, কেননা সেগুলি কোনও বড় বিশ্লেষণী কাঠামোয় জায়গা পায়নি। এই খণ্ডগুলির দৌলতে সেই জানাশোনা কাহিনির একটা ইতিহাস পাওয়া গেল, বাঙালি আইডেন্টিটির ক্রমবিবর্তনের অধ্যায় হিসেবে।

বাঙালি আইডেন্টিটির স্ফুরণ বিষয়ে অন্যরা কী ভাবছিল তখন? মায়ানমার, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অনেকগুলো দেশের দৃষ্টিকোণ মেলে বিভিন্ন লেখায়। পশ্চিম পাকিস্তানেরও। পূর্ব পাকিস্তানের ‘গণহত্যা’ বিষয়ে সেখানে সচেতনতা ছিল না বললেই চলে। তুলনায় যাঁরা প্রগতিশীল, তাঁরাও মনে করতেন শেখ মুজিব অতীব বিপজ্জনক, তাঁর ছয় দফা দাবি সমূলে পরিত্যাজ্য, কেননা সেই ছয় দফা দাবি মেনে নিলে পূর্ব পাকিস্তান কেন, সিন্ধু বা বালুচিস্তানের মতো জায়গাও স্বশাসনের ধুয়োটি জোরালো করার অবকাশ পেয়ে যাবে। মানবিকতার প্রশ্ন তো আর পাকিস্তানের সার্বভৌমতার প্রশ্নের চেয়ে বড় হতে পারে না! মুনতাসির মামুনের এই লেখায় অবশ্য ব্যতিক্রমেরও হদিশ: পরের প্রজন্মের মনে সরকারি ইতিহাস পড়ার পরও কী ধরনের প্রশ্নের ভিড় জমে, তার আভাস।

চতুর্থ খণ্ডের প্রতিটি পর্ব প্রায় চারশো পাতার বই। প্রতিটি বই হাতে নিয়ে মনে হয়, এত বড় পরিসরে, বড় আঙ্গিকে বাঙালির ইতিহাস লেখার চেষ্টা করতে এখন ঢাকার বাংলা একাডেমীই পারে। কলকাতা পারে না। ক্ষুদ্রতার প্রাত্যহিক চর্চায় সে যে বড্ড ব্যস্ত!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy