Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

মানুষের সঙ্গে বনপাহাড়ও অপরিহার্য

রুশতী সেন দু’দশকেরও বেশি সময় বিভূতিভূষণ চর্চায় রয়েছেন। ১৯৯৩-এ প্রকাশিত বিভূতিভূষণ: দ্বন্দ্বের বিন্যাস বইটিতে ‘প্রকৃতিমূলক’ বিভূতিভূষণকে খানিক বুঝতে চেয়েছিলেন সমাজ-অর্থনীতিতে। সে কথনে বেশ কিছু নতুন কথা শোনা গিয়েছিল। পরে আরও দুটি বই লেখেন বিভূতিভূষণকে নিয়ে, যার ফলে তাঁর বিভূতিচর্চার একটা ধারাবাহিকতা এবং মান্যতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

রামকুমার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৪ ০০:০২
Share: Save:

রুশতী সেন দু’দশকেরও বেশি সময় বিভূতিভূষণ চর্চায় রয়েছেন। ১৯৯৩-এ প্রকাশিত বিভূতিভূষণ: দ্বন্দ্বের বিন্যাস বইটিতে ‘প্রকৃতিমূলক’ বিভূতিভূষণকে খানিক বুঝতে চেয়েছিলেন সমাজ-অর্থনীতিতে। সে কথনে বেশ কিছু নতুন কথা শোনা গিয়েছিল। পরে আরও দুটি বই লেখেন বিভূতিভূষণকে নিয়ে, যার ফলে তাঁর বিভূতিচর্চার একটা ধারাবাহিকতা এবং মান্যতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বর্তমান বইটি অবশ্য তাঁর সংকলিত ও সম্পাদিত, নানা জনের নানা রকম লেখাপত্রের একটি সংকলন। নানা রকম বলতে উনিশটি প্রবন্ধের পাশাপাশি মুদ্রিত হয়েছে একটি সাক্ষাৎকার এবং পূর্বপ্রকাশিত একটি কবিতা ও একটি গল্প। সাহিত্যে তেমন পরিচিত নয় এই পংক্তিযোগ, কিন্তু বইটিতে বেশ বৈচিত্র তৈরি করেছে নানা রূপের এই সহাবস্থান।

বাইশটি লেখাকে চার ভাগে সাজিয়েছেন সম্পাদক। প্রথম পর্বের ছ’টি লেখার মধ্যে প্রথমটি মণীন্দ্র গুপ্তের। তিনি শোনান বিভূতি জীবন ও সাহিত্যে কেমন বৈভবী হয়ে উঠেছে এই আকাশ-বাতাস, তুচ্ছাতিতুচ্ছ গাছপালা-তৃণ, পশুপাখি। এ সবে বিভূতিভূষণের শিশুর মতো আনন্দ, অন্য দিকে বেদ-এর ঋষিদের মতো তাঁর কল্পনাপ্রতিভা। কিছু পরে মণীন্দ্র গুপ্ত বলেন, ‘ফিকশন লিখিয়েরা বিশেষ জোর দেন গল্পাংশের ওপর। জলবায়ু, ভূখণ্ড, নিসর্গ কথাকারদের কাছে গৌণ। বিভূতিভূষণ কিন্তু এই ব্যাপারে ব্যতিক্রম। তাঁর বইয়ে মানুষ যতটা অপরিহার্য বনপাহাড়, গাছপালা, আলোছায়াও ততটাই। সৃষ্টিতে হাওয়া জল গাছ লতা-ই তো আগে এসেছে— ওদের কোনও ভাষা নেই, ওরা নৈঃশব্দ্যের জাল ছড়িয়ে কথা বলে। চাঁদের কলা যখন বাড়ে কমে, তখন জ্যোৎস্নায় ঝিমঝিম শব্দ হয়।’ সাহিত্য আলোচনায় নানা দেশি-বিদেশি তত্ত্ব প্রচলিত, সে বিকল্পে কবিমন ও প্রজ্ঞার সমবেতে এও বেশ।

বিকাশ চক্রবর্তী তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন ইংরেজি ভ্রমণকথাগুলির বিপরীতে সমর্পিত ও নিমগ্ন বিভূতিভূষণের ভ্রমণবৃত্তান্ত। অন্য এক উপার্জনও সেখানে আঞ্চলিক জীবনযাত্রার প্রবাহে, প্রকৃতি ও বনভূমির রূপ-অরূপে, দিগন্তের সুবিস্তারে এবং অসংখ্য সাধারণ মানুষের অঘোষিত উপস্থিতিতে। পরে আরণ্যক আলোচনায় প্রশ্নবোধক কিন্তু প্রত্যয়ী একটি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রাবন্ধিক, ‘বিভূতিভূষণও কি তাঁর কল্পনার ভূগোল ও ভূগোলের কল্পনার সাহায্যে এক প্রাক্-উপনিবেশিত, এমনকি এক প্রাক্-আর্য, ভারতবর্ষের কল্পনা করছেন না আরণ্যক-এ?’

এই পর্বেই অমর মিত্র ‘বিভূতিবাবুর দেশ’ গল্পে আরণ্যক-এর ভানুমতীর কন্যা রূপবতী এবং পৌত্রী আর এক ভানুমতীর কথা শোনান, যাদের বর্তমানে বন থেকে উৎপাটিত হতে হয় খনিজ ধাতু উত্তোলনের উদ্যোগে।

দেবারতি মিত্রের একটি কবিতা রয়েছে এই পর্বে। ‘পথিক-দেবতা’ কবিতায় জন্ম থেকে মৃত্যু ছুঁয়ে পাঁড়ে, আইনদ্দি, সইমা, পাগলা ছেলে, হাজারী পরটার মতো অজস্র মানুষ বিভূতিভূষণের দেশকাল জুড়ে। সে সব পরিক্রমা অন্তে কবি-উচ্চারণ, ‘অনশ্বর স্বপ্নে ফোটা প্রতিটি অক্ষর/ অনন্তের হিসেব নিকেশ/ লেখেন ডায়রীতে তাঁর বিভূতিভূষণ।’ এ উচ্চারণে বেশ আপন ঠেকে বিভূতিভূষণকে— হয়তো স্বরের অ-আনুষ্ঠানিকতায়, অনুভবের স্বাভাবিক উত্তাপে।

দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে তিনটি লেখা, যার একটি হল স্বপন চক্রবর্তীর কলমে ‘পাঠক অপু: আদিপর্ব’। পাঠক অপুর সঙ্গে প্রথম পরিচয় পথের পাঁচালী-র দশম পরিচ্ছেদে— ‘সে পড়ে মোটে তৃতীয় ভাগ— কিন্তু তাহার দপ্তরে দুখানা মোটা মোটা ভারী ইংরাজী কি বই, কবিরাজী ঔষধের তালিকা, একখানা পাতাছেঁড়া দাশুরায়ের পাঁচালী, একখানা ১৩০৩ সালের পুরাতন পাঁজি প্রভৃতি আছে।’ অপু এ-সব জোগাড় করেছিল নানা জনের কাছে চেয়ে এবং না পড়তে পারলেও রোজ এক বার করে খুলে দেখে। এরই সূত্র ধরে প্রাবন্ধিক লেখেন, ‘অপুর বাকি পাঠকজীবন যেন এই প্রারম্ভিক অক্ষমতার বিরুদ্ধে এক লাগাতার লড়াই, তার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির বিশ্বের নিরন্তর পুনর্নির্মাণ।’ প্রসন্নের পাঠশালায় শ্রুতিলিপির টেক্সট তার কাছে দুর্বোধ্য, কিন্তু বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস থেকে মুখস্থ করা অনুচ্ছেদ তার কাছে এক নতুন জ্ঞানমার্গ খুলে দেয় অজানা শব্দ, ললিত পদের ধ্বনি এবং তার পেছনের এক কুহেলি-ঘেরা দেশের দৃশ্যে। তার সামান্য পরে অন্য এক পাঠক তৈরি হয় যে পাঠ্যবস্তুর মানে বোঝে আর তাই বীরাঙ্গনা কাব্য পড়তে গিয়ে দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে ভগ্ন ঊরু রাজরথীর যন্ত্রণায় কাঁদে। তারপর তার পাঠ-তালিকায় যুক্ত হয় বাবার সর্ব্ব-দর্শন-সংগ্রহ, নরোত্তম দাস বাবাজির প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা, সচিত্র চণ্ডী-মাহাত্ম্য বা কালকেতুর উপাখ্যান এবং বটতলার প্রণয়-প্রতিমা, সরোজ-সরোজিনী, কুসুমকুমারী, সচিত্র যৌবনে যোগিনী নাটক, দস্যু-দুহিতা, প্রেম-পরিণাম, গোপেশ্বরের গুপ্তকথা ইত্যাদি। সঙ্গে শনিবারের খবরের কাগজ, বঙ্গবাসী কাগজে ‘বিলাতযাত্রীর চিঠি’, সুরেশের ইংরেজি বই থেকে ম্যাপ ও ছবি, মানে বইয়ের সাহায্যে ইংরেজি গল্প, রমেশচন্দ্র দত্তের মহারাষ্ট্র জীবন-প্রভাতরাজপুত জীবনসন্ধ্যা। হরিহর-সর্বজয়ার সংসারের মতোই অসংলগ্ন সে পাঠ্যবস্তু, যাকে প্রাবন্ধিক বলেন ‘নির্বিচার ব্যভিচারী পাঠক্রিয়া’। অপু আবার স্কুলে ভর্তি হয় কাশীতে। সেখানে নন্দবাবুর বইয়ের সংগ্রহ থেকে লীলার মাধ্যমে মুকুল, সখা-সাথী ইত্যাদি নতুন পাঠ্যবস্তুতে প্রবেশ করে। এক সময় ‘বাল্যপর্ব অতিক্রান্ত অপু’, মণিকর্ণিকার ঘাটে হরিহরের শেষকৃত্যের কিছুদিন পরে, ‘অবশেষে সত্যিই নিঃসঙ্গ পাঠক’।

বিভূতিভূষণের উপন্যাসগুলির মধ্যে অনুবর্তন তাঁর সবচেয়ে প্রিয়, এমনই কথা এক সময়ে বলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ এবং সে নিয়ে সংকলন-সম্পাদক নানা প্রশ্ন তুলেছেন একটি সাক্ষাৎকারে। উত্তরে শুনি কী ভাবে তাঁরই একটা সত্তা হয়ে উঠেছিল অনুবর্তন-এর স্কুল, ‘তার চেষ্টায় তার ব্যর্থতায়, শিক্ষকদের দীনতায় ক্ষুদ্রতায়, আবার সেই সঙ্গে স্নেহকাতরতায়, যথার্থ শিক্ষাদানের অতন্দ্র উন্মুখতায়’। কৈশোরের সেই অনুভব যুক্তিতে বোঝেন পরে এবং এবং তখন আরও দুটি মাত্রা যোগ হয় সে পাঠে। এর প্রথমটি হল বিভূতিভূষণের তিরিশের দশক জোড়া স্কুল-অভিজ্ঞতার ছায়াপাত আছে গল্পে এবং ‘কমপক্ষে আট-ন’বছর জোড়া একটা সময় এর মধ্যে গোটানো আছে’। ‘শিক্ষক’ লেখকের যে শিক্ষাকেন্দ্রের কাহিনি আলোড়িত করেছিল এক কিশোরকে ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার প্রতিরূপে, সেটাই আবার ব্যক্তি অতিক্রান্ত সর্বজনীনে প্রকাশ পায় পরবর্তী পর্বে। তখন ক্লার্কওয়েল সহ সব মাস্টারমশাইয়ের লাঞ্ছিত দশার ভবিতব্যটাকে সময়ের লাঞ্ছনা বলে অনেক নির্দিষ্টে বুঝতে পারেন।

‘পুঁইমাচা-য় খিদের গন্ধ’ প্রবন্ধে শিলাদিত্য সেন আলোচনা করেন মাঘ ১৩৩১-এ প্রকাশিত ‘পুঁইমাচা’ গল্পটি নিয়ে। স্ত্রী অন্নপূর্ণা, ক্ষেন্তি সহ আরও দুই মেয়ে নিয়ে সহায়হরি চাটুজ্যের অসহায় সংসারযাপনের পরিচিত গল্প এটি। প্রাবন্ধিক নানা গ্রন্থ ও গবেষণা থেকে দেখান ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমাজে নাস্তানাবুদ সহায়হরির সমকালীন ব্রাহ্মণকুল কেমন দ্রুত চ্যুত হয় জাতিগত জীবিকা হতে। বিকল্প জীবিকার সন্ধানে তখনই ব্রাহ্মণশ্রেণির আর গৃহদেবতারও বাস্তু ছেড়ে নগরযাত্রা। ব্রাহ্মণশ্রেণির উত্থান-পতনের কথা গবেষণায় থাকে, কিন্তু বাস্তুচ্যুত গৃহদেবতার বিড়ম্বনার কথা কে বা লেখে! সুমন ভট্টাচার্য ‘বিভূতিভূষণ: জাত আর পাতের পাঁচালি’ প্রবন্ধে দেখান কৌলিন্যপ্রথার সামাজিক দায় আর অর্থনৈতিক অকৌলীন্যে কেমন ঘূর্ণাবর্তে বিভূতিভূষণের কালসন্ধির কুলীন চরিত্ররা। কিন্তু এরই মধ্যে, আত্মপ্রক্ষেপহীন বিভূতিভূষণের উপন্যাসে, ব্রাহ্মণসন্তান জিতু এক বিশিষ্ট প্রশ্ন তোলে এই জাতকুল নিয়ে।

বিভূতিভূষণের অতীন্দ্রিয় বিশ্বাস নিয়ে বেশ একটা টানাপড়েন আলোচক মহলে সময়ে সময়ে। কিন্তু তার যে অন্য মাত্রা থাকতে পারে, তা তেমন ভাবে বিশ্লেষিত হয়নি। বর্তমান সংকলনে অন্য ভাবে দেখার প্রচেষ্টা চোখে পড়ে শ্যামলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সুষমা ও শৃঙ্খলা’ এবং রামচন্দ্র প্রামাণিকের ‘বিভূতি-সাহিত্যে আধ্যাত্মিকতা’ প্রবন্ধে। শ্যামলকুমার গঙ্গোপাধ্যায় দান্তের ডিভাইন কমেডি আর বিভূতিভূষণের দেবযান-এর তুলনামূলক পাঠে লেখেন যে বিভূতিভূষণ ঈশ্বরের প্রেমকে খোঁজেননি, তিনি স্বর্গে খুঁজেছিলেন মানুষের প্রতি মানুষের পার্থিব ভালবাসাকে। বিভূতিভূষণের আধ্যাত্মিকতার নানা লেখাপত্র বিশ্লেষণে রামচন্দ্র প্রামাণিকের মনে হয় এ যেন অনুভূতিলোকে পাঠকের তীর্থযাত্রা।

এ ছাড়াও সংকলনটিতে অলোক রায়, সুতপা ভট্টাচার্য, অনুরাধা রায়, স্বাতী গুহ, সাধন চট্টোপাধ্যায়, সুদক্ষিণা ঘোষ, প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী, তপস্যা ঘোষ, চিত্রিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সোহিনী ঘোষ, শর্মিলা ঘোষ, প্রচেত গুপ্তর আলোচনা আছে বিভূতি-সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে। সব লেখা যে সম মানের, এমন নয়, কিন্তু তথ্য থেকে সূত্রে পৌঁছনোর একটা তাগিদ অধিকাংশ লেখাতেই মেলে।

নিবিড়তর বিভূতি-সাহিত্য পর্যালোচনার উদ্যোগে এই সংকলনটি গুরুত্বপূর্ণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE