Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২

‘লেখা যেন কোনভাবেই মহত্‌ না হয়ে যায়’

আমার সংগ্রহে থাকা হারাণ মাঝির বিধবা বউয়ের মড়া বা সোনার গান্ধী মূতির্ এবং নাঙা হাড় জেগে উঠছে, ভাইটো পাঁঠার ইস্টু (নাটক) হারিয়ে গেছে বারবার স্থানান্তরে। আমি সুবিমল মিশ্রকে পড়েছি সেই ১৯৬৯-’৭০ থেকে। মনে পড়ে তিনি পাণ্ডুলিপি থেকে পড়ছেন ‘নাঙা হাড় জেগে উঠছে’ গল্পটি। পড়ছেন ‘নুয়ে গুয়ে দুই ভাই’। একাল পত্রিকায় পড়ছি তাঁর ‘বাগানের ঘোড়া নিম গাছে দেখন চাচা থাকতেন’ সেই অসামান্য গল্পটি। এই সব গল্প আমাদের আরম্ভের দিনে অবাক করেছিল।

অমর মিত্র
শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

আমার সংগ্রহে থাকা হারাণ মাঝির বিধবা বউয়ের মড়া বা সোনার গান্ধী মূর্তি এবং নাঙা হাড় জেগে উঠছে, ভাইটো পাঁঠার ইস্টু (নাটক) হারিয়ে গেছে বারবার স্থানান্তরে। আমি সুবিমল মিশ্রকে পড়েছি সেই ১৯৬৯-’৭০ থেকে। মনে পড়ে তিনি পাণ্ডুলিপি থেকে পড়ছেন ‘নাঙা হাড় জেগে উঠছে’ গল্পটি। পড়ছেন ‘নুয়ে গুয়ে দুই ভাই’। একাল পত্রিকায় পড়ছি তাঁর ‘বাগানের ঘোড়া নিম গাছে দেখন চাচা থাকতেন’ সেই অসামান্য গল্পটি। এই সব গল্প আমাদের আরম্ভের দিনে অবাক করেছিল। সুবিমল মিশ্র লিখবেন তা সুবিমল বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর গল্পে। সুবিমল মিশ্র (এখন তিনি লেখেন সুবিমলমিশ্র, পদবি আর নাম এক করে দিয়ে পদবি লুপ্ত করেছেন নিজেকে) কোনও বড় বা মাঝারি প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদপত্রে, সাহিত্যপত্রে একটি বর্ণও লেখেননি। তাঁর নিজের নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত আছে। এই এত বছর ধরে দূর থেকে দেখেছি তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে হিমালয়ের মতো অটল। আমার দেখা এই একমাত্র লেখক যিনি নিজেকে সমস্ত প্রচার মাধ্যম, নামী সাহিত্য পত্রিকা থেকে সরিয়ে রেখে একাকী লিখে গেছেন। স্রোতের বিরোধিতা করেছেন প্রকৃত অর্থেই। সেখানে রাষ্ট্র, বড় প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র, অ্যাকাডেমি, বিশ্ববিদ্যালয় কিছুই বাদ দেননি। কাহিনির বলয় ভাঙতে ভাঙতে এমন জায়গায় পৌঁছেছেন যা আমাদের সাহিত্যে তাঁকে এক বিরল প্রকৃতির লেখকের সম্মান দিয়েছে।

তাঁর অ্যান্টিগল্প, অ্যান্টি-উপন্যাস, নানা নিবন্ধ, সাক্ষাত্‌কার চার খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এই বইগুলি তাঁর রচনা সংগ্রহ নয়, যে যে বই এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে, তারই সংগ্রহ। ফলে এই চার খণ্ডের বইসংগ্রহে কোনও সম্পাদক নেই, নেই সংকলকও। কিন্তু প্রথম বইয়ে আছে ধীমান দাশগুপ্তের একটি নিবন্ধ, ‘গল্প থেকে প্রতিগল্প থেকে নি-গল্প’। নিবন্ধটিতে সুবিমল মিশ্রকে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। হ্যঁা, যে গল্প আমি পড়েছি সেই বছর চল্লিশ আগে। এত বছর বাদে পড়তে গিয়ে টের পেলাম গল্পের অভিঘাত তেমনই আছে। হারাণ মাঝির বিধবা বউয়ের মড়া বা সোনার গাঁধী মূর্তি, নাঙা হাড় জেগে উঠছে বা তৃতীয় বই দু-তিনটে উদোম বাচ্চা ছুটোছুটি করচে লেবেলক্রশিং বরাবর (বইসংগ্রহ ১), সব মিলিয়ে ৪৮টি গল্প অথবা প্রতিগল্প। সুবিমলের হারাণ মাঝির অভাবী বিধবা বউটার কোনও উপায় ছিল না, গলায় দড়ি দিয়ে মরা ছাড়া। বাইশবছরী আঁটো মড়া তরতর করে ভেসে যাচ্ছে খালের ঘোলা জলে। আর সেই মৃতদেহই হয়ে ওঠে সকলের বিড়ম্বনার হেতু। যত্রতত্র তার বাসি মড়া পথ আগলে থাকে। তাতে সুখী মানুষ, ক্ষমতাবান মানুষের ঘুম যায়। তখন দেশে আসছে আমেরিকায় তৈরি হওয়া এক সোনার গাঁধী মূর্তি। বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপ্রধান হাজির। বিউগল বাজছে। জাতীয় পতাকা উড়ছে। খোলা হল কাঠের বাক্স। দেখা গেল তার ভিতরে শুয়ে আছে সেই বিধবার পচা মড়া। ‘সকলে সমবেত চমকালেন, নাকে রুমাল দিলেন এবং বুঝতে পারলেন হারাণ মাঝির বিধবা বউয়ের মড়া না সরালে সোনার গান্ধীমূর্তির নাগাল পাওয়া যাবে না।’ ১৯৬৯-এ লেখা এই গল্পেই যেন সুবিমল মিশ্রের যাত্রা শুরু।

প্রথম বইসংগ্রহের উত্‌সর্গপত্রে তিনি বলছেন, ‘মহত্‌ সাহিত্য হয়ে উঠেছে কি গেল... তোমার লেখা যেন কোনভাবেই মহত্‌ না হয়ে যায়...’ সেই গত শতাব্দীর ষাট আর সত্তরের দশকের প্রথম ভাগ ছিল টিকে থাকা, টিকিয়ে রাখাকে অস্বীকার করার সময়। আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তা যেমন সত্য হয়েছে, সাহিত্যেও। দুটি সাহিত্য আন্দোলন, ক্ষুধার্ত প্রজন্ম আর শাস্ত্রবিরোধী, এই দুই আন্দোলনের বাইরে থেকে একা সুবিমল ভেঙে দিয়েছেন গল্পের প্রচলিত লিখন প্রক্রিয়া। আর হ্যাঁ, বিরোধিতার প্রচলিত ছকও। তাঁর সেই সব গল্প, পার্ক স্ট্রিটের ট্রাফিক পোস্টে হলুদ রং, পরী জাতক, আর্কিমিদিসের আবিষ্কার ও তারপর, ৭২-এর ডিসেম্বরের এক বিকেল, ধারাবিবরণী-৭১, ব্যবসায়ীগণ সত্বর বকেয়া জমা দিন, নুয়ে গুয়ে দুই ভাই, আসুন ভারতবর্ষ দেখে যান, ময়নার মার ঘরে এখন বাবু এসেছে... আবার পড়তে গিয়ে মনে হতে থাকে সুবিমলের বিরোধিতাকে প্রতিরোধের কোনও উপায় নেই। গল্পকে ভেঙে ‘আপনি যখন স্বপ্নে বিভোর কোল্ড ক্রিম তখন আপনার ত্বকের গভীরে কাজ করে’ নামে যে গল্প লিখেছিলেন গত শতাব্দীর সত্তর দশকে, সেই বিজ্ঞাপন-জীবন এখন তো গিলে খেয়েছে আমাদের। সুবিমলকে পড়ে বিড়ম্বিত হবেন পাঠক। কিন্তু তাঁকে কাউন্টার করার কোনও উপায় খুঁজে পাবেন না। তার দরকারও নেই। মনে হয়েছে তাঁর এই স্রোতের বিরুদ্ধ-যাত্রা আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর কোনও কোনও অ্যান্টিস্টোরি পড়তে পড়তে বুক হিম হয়ে যায় ভয়ানক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে। চতুর্থ বইসংগ্রহের বাব্বি বইটির অনেক গল্পই সেই হাড়-হিম-করা বাস্তবতাকে ছুঁয়েছে। বাব্বি, ঐতিহাসিক অবতরণ, শেকড়সুদ্ধ, হেরম্ব নস্কর, মৌসুমী নস্কর, জটাধারী নস্কর... পড়তে পড়তে ধরা যায় গত ৪০ বছর ধরে আমরা বুঝি একই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছি। বদলায়নি তা।

সুবিমল মিশ্র গল্পকে ভেঙেছেন যেমন, আবার পরিপূর্ণ কাহিনিও লিখেছেন। তিনি কোনও একটি আঙ্গিকে স্থিত হননি। যে লেখক জানেন নির্মাণ, তিনিই তো ভাঙতে পারেন। যিনি গড়তে না জেনে সুবিমলের আঙ্গিক ভাঙাকেই আশ্রয় করবেন প্রথমেই, তাঁকে কোথাও আটকে যেতে হবে। সুবিমল তো হারাণ মাঝি... দেখনচাচা... পরিজাতক, নাঙা হাড়... লিখেছেন। বার বার ভেঙেছেন নিজের গড়া দুর্গই। সুবিমলের বিরুদ্ধে সুবিমল (বইসংগ্রহ ৩) বইটিতে তাঁর বিরোধিতার দর্শনটিকে আন্দাজ করা যায় মাত্র। আসলে সুবিমল মিশ্রর সেই বিরোধিতায় অন্য কোনও মতের স্থান নেই। তিনি অসম্ভব আক্রমণাত্মক। তিনি বলছেন, ‘প্রতিষ্ঠিত শক্তিই প্রতিষ্ঠান। তার চরিত্র হল জিজ্ঞাসাকে জাগিয়ে তোলা নয়, দাবিয়ে রাখা। যে কোনও স্বাধীন অভিব্যক্তির মুখ চেপে বন্ধ করা, তা অবশ্যই শ্রেণি স্বার্থে।’ সুবিমল বড় কাগজের বিপরীতে ছোট কাগজের কথা বলেছেন। তাঁর সমস্ত জীবনের লেখালেখি নিয়ে অবশ্যই তা মান্য। হ্যাঁ, তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা আমাদের কাছে সাহিত্যের এক নতুন পরিসর উন্মুক্ত করেছে নিশ্চয়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাঁর মন্তব্য নিয়ে বিরোধিতার জায়গা আছে। তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। তিনি তাঁর বিরোধিতার সঙ্গে মিলিয়েছেন ঋত্বিক ঘটককে। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বা অমিয়ভূষণকে। তৃতীয় খণ্ডে আছে ‘ঋত্বিককুমার ঘটক: একটি ব্যক্তিগত তীর্থযাত্রা একটি আবেগায়িত উন্মোচন, আপাতভাবে’। পাঠক বুঝতে চাইবেন, একমত হবেন কিংবা হবেন না কোনও কোনও সিদ্ধান্তে। অনেক জায়গায় একমত না হলেও সুবিমলকে সহ্য করতে হবে বহু সময় ধরে। তাঁর গদ্য তীক্ষ্ন ফলার মতো।

বইসংগ্রহ ২ তাঁর অ্যান্টি-উপন্যাস সংগ্রহ। প্রথম প্রতিউপন্যাসটি আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো ঢোঁড়াইয়ের গল্প নয়, কিন্তু তা হতে কোনও বাধা ছিল না। এই প্রতিউপন্যাস পাঠে কেন, সমগ্র সুবিমল পাঠেই প্রয়োজন অন্যমনস্কতাহীন অভিনিবেশ। এখানে ব্যবহার করা হয়েছে খবরের কাগজের সংবাদ, চিঠি, রিপোর্টাজ... উপাদান তাই-ই। অনেক নিরুপায় জীবন মিলিয়ে যে একটি জীবন হয়, অনেক নিরুপায় মানুষ যে একে অন্যের সঙ্গে অন্বিত হয়ে থাকে, তা সুবিমলের এই রামায়ণ চামার না হয়েও হয়ে যাওয়া প্রতিউপন্যাসে প্রত্যয় হয়। সুবিমলের লেখায় আছে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা, এই সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রতি সেই উপহাস, যা ঘৃণা থেকেই উদ্গত হয়। যে সব ঘটনা বা কাহিনিরেখা এই প্রতিউপন্যাস সংগ্রহে আছে, তা আপনাকে উপদ্রুত এলাকায় নিয়ে যাবে নিশ্চিত। সুবিমল মিশ্র আমাদের সাহিত্যে একটি উপদ্রুত এলাকা সৃষ্টি করেছেন।

বইসংগ্রহ চারটি খণ্ডে প্রকাশকের যত্নের চিহ্ন স্পষ্ট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE