জা ক দ্যুত্রঁক ‘খারিজ’-এর জন্য জুরি পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন মৃণাল সেনের হাতে। কান চলচ্চিত্র উৎসব, ১৯৮৩। সাদা কালোয় পাতাজোড়া ছবি, কাইয়ে দ্যু সিনেমা-র মোটাসোটা ঝলমলে বই— কান সিনেমা/ আ ভিশুয়াল হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (১৯৩৯-২০১০), তার পাতা ওলটালেই বেরিয়ে পড়বে ছবিটা, তলায় মৃণাল সেনের পরিচিতি: বেঙ্গলি ইন্ডিয়ান ডিরেক্টর। এই বইয়ে আর কোনও ভারতীয় পরিচালকের ছবি নেই।
আগের বছরই, ’৮২-তে কান-এ জুরর/ জুরি মেম্বার ছিলেন মৃণাল, ‘খারিজ’ তৈরি হচ্ছে তখন, শুটিংয়ের কয়েকটা ছবি নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলেন জিন মাসকোভিচ’কে। জিন কলকাতায় এসেছিলেন শুটিং দেখতে, যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন ‘মৃণাল, আমি একটা ভাল ছবির গন্ধ পাচ্ছি।’ সিনেমার এই বিশিষ্ট আলোচক সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের কাছে প্রথম শোনেন মৃণাল, ষাটের দশকের শুরু তখন, তাঁর ‘বাইশে শ্রাবণ’ সদ্য দেখানো হয়েছে ভেনিস ফেস্টিভ্যালে, আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও ভেনিসে যেতে পারেননি অর্থাভাবে। বিদেশেরই কোনও ফেস্টিভ্যালে জিনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সত্যজিতের, জিন’কে তিনি পছন্দও করতেন খুব, কলকাতায় ফিরেই তাঁর সম্পর্কে পরিচিতি দিয়ে মৃণালকে ফোন করলেন— ‘ফেস্টিভ্যালে-ফেস্টিভ্যালে ঘুরে বেড়ায়, থাকে প্যারিসে। এ বার যখন বাইরে যাবেন, অবশ্যই দেখা করে নেবেন, আপনার ‘বাইশে শ্রাবণ’ ভেনিসে দেখেছে, খুব বলছিল তা নিয়ে, লিখেছেও।’ জিন একা নন, লিখেছিলেন জর্জ মাদুল-ও, ফরাসি একটি পত্রিকায়।
‘বাইশে শ্রাবণ’ই আন্তর্জাতিক সিনেমার দুনিয়ায় সম্মানিতদের সারিতে মৃণাল সেনকে দাঁড় করিয়ে দেয় প্রথম। দিল্লির কেন্দ্রীয় মন্ত্রক অবশ্য উপদেশ পাঠিয়েছিল: একটা ক্ষুধার্ত মানুষ শীর্ণকায় আঙুলে ভাত চটকে চটকে যাচ্ছে, এ দৃশ্য বাদ দিতে হবে। শোনেননি মৃণাল। বিদেশের নানান ফেস্টিভ্যালে মৃণালের সঙ্গে নিয়মিত যেতেন গীতা সেন, স্ত্রী হিসেবে তো বটেই, তাঁর ছবির বিশিষ্ট অভিনেত্রী হিসেবেও। ‘এমনই এক ফেস্টিভ্যালে দেখা হয়ে গিয়েছিল জিনের সঙ্গে। আমাদের পরিচয় দেওয়ার আগেই ও নিজে থেকে এগিয়ে এসে আলাপ করল। জমজমাট সম্পর্ক ছিল আমৃত্যু।’ বলতে থাকেন গীতা, ‘ক্যানসার হয়েছিল। শেষ দিকে হুইলচেয়ারে ঘুরে ঘুরে কাজ করত। হাসপাতালেও ওকে দেখতে গিয়েছি আমরা দুজন।’ মারা যাওয়ার খবরটা দিয়েছিলেন ক্যাকটাস ফিল্মের এলিয়ান স্টুটারহাইম, যাঁদের তত্ত্বাবধানে ‘খারিজ’ দেখানো হচ্ছিল কান-এ। মৃণাল আর এলিয়ান সিদ্ধান্ত নেন, জিনকেই উৎসর্গ করা হবে ছবিটা। ছবি শুরুর আগে পরদায় ভেসে উঠল: ‘জিন মাসকোভিচ স্মরণে।’ আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন মৃণাল সেন। তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছিল, ‘বাইশে শ্রাবণ’ দেখে জিন বলেছিল, ‘সাবটাইটেল ছিল না, তবুও ছবিটা দেখে বুঝেছিলাম, সাবটাইটেল থাকলে কী ভাল হত!’