Advertisement
E-Paper

অম্বিকার পুজো দিয়ে বাণিজ্যে যেতেন সওদাগরেরা

তাম্রলিপ্ত মহাভারতের কালের জনপদ। এলাকার এক জনপদ বৈঁচবেড়ে গড়ের সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের নিদর্শন দেবী অম্বিকা। রাধাবল্লভের রথযাত্রা হয় রাতে। লিখলেন সুশীলকুমার বর্মনএখন গড়ের চিহ্ন নেই। তবে রাজার বংশধরেরা এখনও বৈঁচবেড়ে রয়েছেন। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’তে তাম্রলিপ্ত রাজার গড়ে ৫০ জন অশ্বারোহী এবং এক হাজার পদাতিক সেনার উল্লেখ আছে।

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৯ ০১:০৯
অতীত: রাধাবল্লভের মন্দিরের বর্তমান অবস্থা। নিজস্ব চিত্র

অতীত: রাধাবল্লভের মন্দিরের বর্তমান অবস্থা। নিজস্ব চিত্র

মহাভারতে উল্লেখ আছে, দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় তাম্রলিপ্তের রাজা উপস্থিত ছিলেন। ময়ূরধ্বজ, তাম্রধ্বজ, সম্রাট অশোক, শশাঙ্ক, গোপীচন্দ্র হয়ে কৈবর্তরাজা কালু ভুঁইয়া তাম্রলিপ্তে রাজত্ব করেছেন। আকবরের শাসনকালে এ রাজ্য মোগলদের নজর কাড়ে। মোগলরা তাম্রলিপ্তের রাজাদের রায় উপাধি দেন। তখন সিংহাসনে ৫১তম রাজা নরনারায়ণ রায় (১৭০৩-৩৭)। তাম্রলিপ্ত রাজবংশের উত্তরপুরুষ দীপেন্দ্রনারায়ণ রায়ের একটি রচনাতে দেখা যায়, তাম্রলিপ্ত রাজধানী আট মাইল দূর দিয়ে গড়খাই দিয়ে ঘেরা ছিল। এবং জায়গায় জায়গায় গড় ছিল। তারই একটি গড় তমলুক থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার পশ্চিমে বৈঁচবেড়ে গড়।

এখন গড়ের চিহ্ন নেই। তবে রাজার বংশধরেরা এখনও বৈঁচবেড়ে রয়েছেন। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’তে তাম্রলিপ্ত রাজার গড়ে ৫০ জন অশ্বারোহী এবং এক হাজার পদাতিক সেনার উল্লেখ আছে। তথ্যানুসারে, নরনারায়ণের পুত্র কৃপানাথের পত্নী রানি কৃষ্ণপ্রিয়া এই গড়ে বাস করতেন। কৃষ্ণপ্রিয়ার মৃত্যুর পর রাজ্য পান আনন্দনারায়ণ। কৃষ্ণপ্রিয়ার গড়ে প্রাচীনকাল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ব্যাঘ্রবাহিনী চতুর্ভূজা অম্বিকার নিত্য ও বার্ষিক পুজো। আগের প্রথা অনুযায়ী, তাম্রলিপ্তে বর্গভীমার থানের আশপাশে অন্য শাক্তপূজা নিষিদ্ধ ছিল। বৈঁচবেড়ে গড়ে রাজারা অম্বিকাকে দুর্গারূপে পুজো করতেন। পুজোয় তাম্রলিপ্ত থেকে রাজপরিবারের সদস্যরা এখানে আসতেন। রীতি অনুসারে রাজকুমারীরা দেবীবরণ করতেন।

অম্বিকার গড়ে অম্বিকাপুজোর জৌলুস আর নেই। আনন্দনারায়ণ রায়ের উত্তরসূরী শোভননারায়ণ রায় বললেন, এখন দুর্গাপুজোর একমাস আগে বৈঁচবেড়ে অম্বিকামন্দিরে ঘটস্থাপন করা হয়। ঘট জরাজীর্ণ দুর্গাদালানে দুর্গাপ্রতিমার সামনে রেখে অনাড়ম্বরে পুজো হয়। তাত্ত্বিকদের মতে, অম্বিকা প্রথমে হিন্দুদেবী ছিলেন না। ইনি জৈনদের উপাস্য দেবী। ২২তম তীর্থঙ্কর নেমিনাথের শাসনদেবী অম্বিকা। যিনি সিংহবাহিনী, চতুর্ভূজা। যাঁর বাম কোলে এক শিশু, ডানহাতে আম্রপল্লব, মাথায় ফল-সহ আম্রশাখা। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশিয়াড়ি ব্লকের প্রাচীন জৈনক্ষেত্র কিয়ারচাঁদ সংলগ্ন রানা গ্রামের শিবমন্দির প্রাঙ্গণে জৈন-অম্বিকার পাথরে মূর্তি এবং পাশের মড়াদিঘি ও রণবনিয়া গ্রাম সীমানায় শীতলা মন্দিরের সামনে তীর্থঙ্করের মূর্তির কাছে অম্বিকার দ্বিখণ্ডিত মূর্তি আছে। জৈনদেবী কালক্রমে ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতিতে অম্বিকা হিসেবে পূজিত হচ্ছেন। মূর্তির কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। হিন্দু অম্বিকা ব্যাঘ্রবাহিনী। চতুর্ভুজা, কোথাও অষ্টভুজা, কোথাও হাতের সংখ্যা ২০। হাতে অস্ত্রশস্ত্র, শঙ্খ, পদ্ম। ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’তে বিনয় ঘোষ লিখেছেন, ‘জৈনদেবী অম্বিকা খুব সহজেই বাংলায় দুর্গার ধ্যানমূর্তির মধ্যে লীন হয়ে গেছেন’। চণ্ডীমঙ্গলে ফুল্লরার বারমাস্যায় অম্বিকা পুজোর উল্লেখ আছে, ‘আশ্বিনে অম্বিকা পূজা সুখী জগজনে/ ছাগ মেষ মহিষ দিয়া বলিদানে’। এখন বাংলায় অম্বিকা পুজোর তেমন প্রচলন না থাকলেও অন্য প্রদেশে অম্বিকার পুজো হয়। ওড়িশার বারিপদাতে অম্বিকার বিশাল মন্দির রয়েছে।

কথিত আছে, বৈঁচবেড়ে গড়ে অম্বিকার পুজো দিয়ে সওদাগরেরা তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে বাণিজ্যে পাড়ি দিতেন। বৈঁচবেড়ের এলাকায় প্রাচীন জলপথ ছিল। এই এলাকার কাছে সিমুলিয়া, নিমতৌড়ি গ্রামে পুকুর খোঁড়ার সময়ে কাঠের নৌকার বিশাল কাঠামো পাওয়া যায়। জৈনগ্রন্থ ‘কল্পসূত্র’ থেকে জানা যায়, এই সম্প্রদায়ের গোদাস শাখার চারটি স্থানভিত্তিক উপশাখার মধ্যে একটির নাম তাম্রলিপ্তিকা বা তাম্রলিপ্তিয়া। খ্রিস্টীয় প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে তাম্রলিপ্তের রাজা খারবেল ছিলেন জৈন ধর্মানুরাগী। তমলুকের কাছে তিলদা থেকে জৈন তীর্থঙ্করের ভগ্নমূর্তি পাওয়া গিয়েছে। এই সব নিদর্শন প্রমাণ করে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের আগে তাম্রলিপ্তে জৈন ধর্মের প্রভাব ছিল। সুতরাং এই অঞ্চলে জৈনদেবী অম্বিকার পুজো এবং পরে হিন্দু অম্বিকার পুজোর প্রচলন স্বাভাবিক। সংস্কারের পর বৈঁচবেড়ের জীর্ণ অম্বিকামন্দির সাদামাটা চেহারা নিয়েছে। গর্ভগৃহে মূর্তি বেশ ছোট। দেড়-দু’ফুট উচ্চতার প্রাচীন অষ্টধাতুর ব্যাঘ্রবাহিনী অম্বিকামূর্তি গত শতাব্দীর ষাটের দশকে চুরি গিয়েছে।

বৈঁচবেড়েতে রাধাবল্লভের উৎসব হয় যথেষ্ট জাঁকজমকে। রাধাবল্লভের নবরত্ন মন্দির ও পাশের পঞ্চরত্ন মন্দির এক শৈল্পিক স্থাপত্য। অম্বিকা মন্দিরের দক্ষিণে প্রায় পঞ্চাশ ফুট তফাতে এই দু’টি মন্দির অবস্থিত। বর্তমানে মন্দিরগুলো জীর্ণ। আষ্টেপৃষ্ঠে লতা-গুল্ম জড়িয়ে রয়েছে। রাধাবল্লভের কষ্টিপাথরের মূর্তি ও রাধারানির মূর্তি, গোপীনাথের পিতলের যুগলমূর্তি এবং শ্যামচাঁদের কালোপাথরের যুগলমূর্তি এখন অম্বিকামন্দিরে অম্বিকার সঙ্গে পূজিত। গবেষক তারাপদ সাঁতরার ধারণা, রাধাবল্লভ মন্দির অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নির্মিত। নবরত্ন মন্দির দক্ষিণমুখী। এর আনুমানিক দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা যথাক্রমে ৩২ ফুট, ২৫ ফুট ও ৫০ ফুট। পাতলা পোড়া ইটের দেওয়াল। চুন-সুরকির গাঁথনি। দক্ষিণে ও উত্তরে একই রকম দু’টি বারান্দা ছিল। দক্ষিণের বারান্দা আর নেই। বিলুপ্ত মন্দিরের চূড়ার দু’টি রত্ন। মন্দিরে এখন সাতটি রত্ন। উত্তরের বারান্দায় খিলান করা তিনটি প্রবেশদ্বার। মাঝেরটি চওড়া। খিলানে অর্ধচন্দ্রাকার ঝালর। পলেস্তরায় কলকা ও পঙ্খের কারুকার্য। স্তম্ভগুলোতেও নকশা। দেওয়ালে কুলুঙ্গি। চওড়া দরজা পেরিয়ে গর্ভগৃহ। তার মাথায় ডোম। গর্ভগৃহের পূর্ব দিকে একটি কক্ষ। খিলান করা প্রবেশদ্বারে কাঠের পাল্লা। কক্ষে পশ্চিমমুখী প্রতিমাবেদি। উত্তরের বারান্দার পশ্চিম প্রান্ত থেকে দেওয়ালের সিঁড়ি বরাবর দোতলার ছাদে যাওয়ার ইটের সিঁড়ি।

মূল মন্দিরের পূর্বদিকে চার ফুট ছেড়ে উত্তরমুখী পঞ্চরত্ন মন্দির। এটির আনুমানিক দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা যথাক্রমে ২৫ ফুট, ২৫ ফুট ও ৩০ ফুট। গর্ভগৃহে উত্তরমুখী বেদিমঞ্চ। বৈঁচবেড়ে হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক গোরাচাঁদ মাইতি পঞ্চরত্ন মন্দিরের স্তভের গায়ে টেরাকোটার দু’টি আকর্ষণীয় ফলক দেখালেন। একটি ফলকে এক সুঠামদেহী পুরুষ, দাঁড়িয়ে। তার সামনে একটি বাঘ সামনের দু’পা তুলে সোজা দাঁড়িয়ে। বাঘের দৈর্ঘ্য পুরুষের কোমর পর্যন্ত। অন্য ফলকে মালা হাতে একই রকম সুঠামদেহী পুরুষ। মুখোমুখী দাঁড়িয়ে আরেক মূর্তি। ক্ষয়াটে ও অস্পষ্ট। পুরুষমূর্তি হয়তো বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়। কারণ তাম্রলিপ্ত বন্দর এলাকা এক সময়ে সুন্দরবনের মতো গভীর জঙ্গলে ঢাকা ছিল।

কার্তিক মাসের উত্থান একাদশীতে রাধাবল্লভের রাসলীলা ও রথযাত্রা উপলক্ষে বৈঁচবেড়ে জমজমাট হয়। বিয়াল্লিশ ঘট স্থাপনে যজ্ঞ হয়। সন্ধ্যায় পদ্মপুকুরে কমলেকামিনীর আয়োজন। তিন যুগলমূর্তিকে নৌকায় পুকুরের চারদিকে সাতবার ঘুরিয়ে চলে নৌকাবিলাস। তার পর দেবমূর্তি রথে বসিয়ে রাতে ভক্তরা পদুমপুর গ্রামে মাসির বাড়ি নিয়ে যান। মাসির বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় রাধাবল্লভের রাসলীলা। রাধাবল্লভের রাত্রিকালীন রথযাত্রা শুধু বাংলায় নয় সারা ভারতে বিরল। রাধাবল্লভের ৩৪৫ একর এস্টেটের আয় থেকে আগে উৎসবের খরচ চলত। এখন আয় কমায় গ্রামের সাধিকা রক্ষা কমিটি উৎসবের আয়োজন করে।

লেখক লোকসংস্কৃতি এবং প্রত্নতত্ত্ব গবেষক

Tamralipta Mahabharat
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy