Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

কলকাতা শহর ও এক অবাঙালি

দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোকটির মনে তখন এই একটি নয়, প্রচুর প্রশ্ন গিজগিজ করছে। ১৯৫৫ সালে বাইশ বছর বয়সে কেরল থেকে কলকাতায় এসেছিলেন পরমেশ্বরন থনকপ্পন নায়ার। পকেটে মাত্র কুড়ি টাকা, স্কুলের পড়াশুনোর সঙ্গে টাইপ আর শর্টহ্যান্ডটা জানা আছে, কিন্তু এ শহরে তাঁর কোনও মুরুব্বি নেই

ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

তেতাল্লিশ বছর আগের কথা। ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় এক দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোক প্রশ্ন তুললেন, মেয়র্স কোর্ট তো বরাবর সাহেবপাড়ায় ছিল, তবে উত্তর কলকাতায় একটা রাস্তার নাম ওল্ড মেয়র্স কোর্ট হল কী করে? ‘কলিকাতা-দর্পণ’ প্রথম পর্বে এ কথার সপ্রশংস উল্লেখ করলেন কলকাতা-গবেষক রাধারমণ মিত্র: ‘‘চমৎকার প্রশ্ন! এক জন বাঙালির পক্ষেই এ-প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আশ্চর্য, কোনও বাঙালি এ প্রশ্ন তুললেন না, তুললেন এক জন অবাঙালি ভারতীয়।’’

দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোকটির মনে তখন এই একটি নয়, প্রচুর প্রশ্ন গিজগিজ করছে। ১৯৫৫ সালে বাইশ বছর বয়সে কেরল থেকে কলকাতায় এসেছিলেন পরমেশ্বরন থনকপ্পন নায়ার। পকেটে মাত্র কুড়ি টাকা, স্কুলের পড়াশুনোর সঙ্গে টাইপ আর শর্টহ্যান্ডটা জানা আছে, কিন্তু এ শহরে তাঁর কোনও মুরুব্বি নেই। কলকাতার ইতিহাস লিখবেন, এমন ভাবনা স্বপ্নেও ছিল না। চাকরি পেলেন টাইপিস্টের। ট্রামে চেপে আর পায়ে হেঁটে ঘুরতে ভালবাসেন, তাই শহরটার গলিঘুঁজিও চেনা শুরু হল। চাকরিসূত্রে মাঝে কয়েক বছরের জন্য শিলঙে থাকতে হয়েছিল, সেই ফাঁকে গ্র্যাজুয়েশনটা করে নেন। ফিরে এসে ভবানীপুরের কাঁসারিপাড়া রোডের ফ্ল্যাটে সেই যে থিতু হলেন, আর নড়েননি। পঞ্চাশ বছর কেটে গেল সেখানেই। লেখালিখির শখ ছিল, নানা কাগজে লেখা পাঠাতেন, ছাপাও হত। পুরনো, নজর-কাড়া বাড়ি দেখলেই চেষ্টা করতেন তার সম্বন্ধে জানতে। সাংবাদিকতার চাকরিও করলেন কিছু দিন। লেখার রসদ পেতেই যাওয়া শুরু হল জাতীয় গ্রন্থাগারে, ভবানীপুরের বাসা থেকে হেঁটে মাত্র দশ মিনিট! তাতেই প্রশ্নগুলো খোঁচা দিতে শুরু করল।

জাতীয় গ্রন্থাগারে কলকাতার ইতিহাসের নানা দিক নিয়ে অজস্র বই, নথিপত্র। ঘাঁটতে ঘাঁটতে নায়ারের মনে হল, এত বই লেখা হয়েছে শহরটা নিয়ে, কিন্তু অনেক তথ্যই তো সে সবে নেই। আকর সূত্রগুলো তেমন খুঁটিয়ে বিশেষ কেউ দেখেননি। সমসাময়িক পত্রপত্রিকা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাগজপত্র, কলকাতায় আসা দেশিবিদেশি অতিথিদের লিখে রাখা বৃত্তান্ত, পুরসভার নথি, এশিয়াটিক সোসাইটির নথি— কত কী ভাল করে দেখার আছে। তা ছাড়া শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটলেই নানা প্রশ্ন জাগে, সে সবের উত্তরই বা কোথায়? এমনই এক বেয়াড়া প্রশ্ন সাড়া জাগিয়েছিল রাধারমণ মিত্রের মনে, তিনিও তো হাঁটতে হাঁটতেই খুঁজে পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের দয়েহাটার বাসা কি মাইকেলের শেষজীবনের ঠিকানা।

নায়ার ঠিক করে ফেললেন, কলকাতাই হবে তাঁর বাকি জীবনের ধ্যানজ্ঞান। তত দিনে বিয়ে করেছেন, ছেলেমেয়ে হয়েছে। স্ত্রী স্কুলে পড়িয়ে সংসার চালান, ছেলেমেয়ে মানুষ করেন। নায়ার এক বেলা খান, সারা দিন পড়ে থাকেন গ্রন্থাগারে আর নানা নথিখানায়। সংবাদপত্র থেকে দরকারি খবর কেটে রাখেন সযত্নে। নিয়মিত ঢুঁ মারেন ওয়েলিংটন বা কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকানে— ‘‘ওরা নতুন কিছু পেলেই আমার জন্য রেখে দেয়।’’ টুকরো টুকরো করে জড়ো করেন কলকাতার ইতিহাসের খুঁটিনাটি সূত্র। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে মেলামেশায় একদমই আগ্রহী নন। একেবারে কলকাতাচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ ‘হোলটাইমার’।

চার দশক পেরিয়ে গিয়েছে ঠিক একই ছন্দে। কলকাতা পুরসভার উদ্যোগে লিখেছেন ‘আ হিস্টরি অব ক্যালকাটাজ় স্ট্রিটস’ আর পুরসভার ইতিহাস, এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে তিনটি বিশাল খণ্ডে সম্পাদনা করেছেন সোসাইটির উনিশ শতকের প্রথমার্ধের ‘প্রসিডিংস’ আর দু’খণ্ডে ‘ক্যালকাটা টারসেন্টিনারি বিবলিয়োগ্রাফি’, সঙ্কলন করেছেন নানা জনের লেখায় সতেরো-আঠারো-উনিশ শতকের কলকাতার বিবরণ, কলকাতার নামের উৎস, সংবাদপত্র, পুলিশ, হাইকোর্ট, দক্ষিণ ভারতীয় গোষ্ঠী, জাতীয় গ্রন্থাগারের ইতিবৃত্ত, জেমস প্রিন্সেপ আর বিএস কেশবনের জীবনী, এমনকি জোব চার্নককে নিয়ে দুর্লভ লেখাগুলি। তাঁর ঝুলিতে এখন ৬২টি বই, কয়েকটি বাদে সবই কলকাতা সংক্রান্ত। কলকাতায় গাঁধীজিকে নিয়ে ৬৩ সংখ্যক বইটি প্রকাশিত হতে চলেছে। এত বিপুল পরিমাণ কাজের নিরিখে কলকাতা-গবেষক হিসেবে সম্মান, সমালোচনা দুই-ই জুটেছে তাঁর। সমালোচনার মূল কথা, নায়ার বাংলা পড়তে পারেন না, ফলে কলকাতার ইতিহাসের দিশি উপকরণ তিনি আদৌ দেখেননি। এই কারণে তাঁর বিশ্লেষণে প্রচুর ত্রুটি থেকে গিয়েছে। নায়ার নিজে মনে করেন, বাংলা না-জানায় তাঁর কোনও সমস্যা হয়নি, ইংরেজি আকর থেকেই তিনি পর্যাপ্ত উপকরণ পেয়েছেন। তবে তাঁর কাছে ‘তথ্য-সংগ্রাহক’ অভিধাটিই যথেষ্ট, এর বেশি কিছু তাঁর প্রত্যাশা নেই।

এ বছর ৩০ এপ্রিল পঁচাশি বছর বয়স পূর্ণ করেছেন পি টি নায়ার। এখনও যান জাতীয় গ্রন্থাগারে। আঠারো বছর আগেই দেশে ফিরে যাওয়া মনস্থ করেছিলেন, কিন্তু সাধের শহরটা ছাড়তে পারেননি। এ বার ২২ নভেম্বর সত্যিই স্থায়ী ভাবে কেরলে ফিরে যাচ্ছেন তিনি। বিপন্ন ঐতিহ্যের এ শহর যে আরও দরিদ্র হল তাতে সন্দেহ নেই।

এক দিন ভেবেছিলেন, কলকাতা তো তাঁকে অনেক কিছু দিয়েছে, কলকাতার ইতিহাস লিখে সে ঋণ শোধ করবেন। পি টি নায়ার কথা রেখেছেন। আমরা কী করেছি? টাউন হলে সংরক্ষণের জন্য ১৯৯৯ সালে তাঁর তিন হাজার মূল্যবান বইয়ের সংগ্রহ দশ লক্ষ টাকায় কিনে নিয়েছিল কলকাতা পুরসভা। টাউন হল সংরক্ষণের অজুহাতে আজ তা গুদামবন্দি। সংরক্ষণের কাজ মাঝপথে থেমে গিয়েছে অর্থাভাবে, তাই সে বইপত্র কবে আবার আলোর মুখ দেখবে কেউ জানে না। তবু নায়ার তাঁর বাকি বইও টাউন হলেই দিয়ে যেতে চান। নায়ারের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই অনেক দিন ছাপা নেই। তাতে কী? আমরা নিশ্চিন্ত থাকতেই পারি। আবার নিশ্চয়ই কোনও ‘অবাঙালি’ গবেষক ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে চলে আসবেন এ শহরে...।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Parameswaran Thankappan Nair Researcher Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE