Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

‘নজর’ বড় খারাপ, রাজনীতির ক্ষমতা মুঠোয় রাখার রূপক

এক যে ছিল গ্রাম। সেখানে ছিল এক কুচক্রী প্রধান। গরিব এক চাষিকে নিজের কাজে লাগিয়ে সে চায় গ্রামের দখল। যেন হালফিলের রাজনীতির চিত্র।

নীহার বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:২১
Share: Save:

গ্রামের নাম নীলগঞ্জ। গ্রামটি যেমন সুন্দর, নির্মল, অপরূপ, গ্রাম প্রধান ঠিক তার বিপরীত। ধূর্ত, ঠগ, নির্মম, নিষ্ঠুর। এই গ্রামেই থাকেন ছানোয়ার হোসেন। গ্রাম প্রধান তাঁকে তাচ্ছিল্যের সুরে ডাকেন ‘ছুনু’। সেই থেকে সকলেই তাকে ছুনু মিঁয়া বলে ডাকে। এই ছুনুকে নিয়েই গল্প।

গ্রামের সরল সাধাসিধে মানুষদের বোকা বানিয়ে, অন্ধ কুসংস্কারের মধ্যে তাদের ডুবিয়ে রেখে শয়তান গ্রাম প্রধান ওসমান গণি কী ভাবে একছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বাসিন্দাদের শোষণ করে চলেছে, সেটাই গল্পের মূল প্রতিপাদ্য। ছুনুর গরিবির সুযোগ নিয়ে গ্রাম প্রধান তাকে ‘নজর’ দেওয়ার অলৌকিক ক্ষমতাধর বলে গ্রামে রটিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য, নিজের স্বার্থসিদ্ধি। গ্রাম প্রধানের কূট চালে গ্রামে রটে যায়— ছুনু যার দিকে তাকায়, সে ভস্ম হয়ে যায়। যে গাছের দিকে তাকায়, রাতারাতি সেই গাছ মরে যায়। যে গরুর দিকে তাকায় সেই গরু মুহূর্তের মধ্যে মারা যায়। ছুনুও গ্রাম প্রধানের থেকে কিছু নজরানার লোভে তা মেনেও নেয়। এ দিকে, রটনাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করতে গ্রাম প্রধান সরকারি প্রকল্পের টাকায় ছুনুর জন্য এক ডজন বিদেশি কালো চশমা কিনে আনে। ছুনু দিনরাত ২৪ ঘণ্টা সেই চশমা পরে নিজের ‘নজর’ আড়াল করে রাখে। মাঝেমধ্যে চশমা খুলে গ্রামের মানুষদের ভয় দেখিয়ে মজাও পায় সে।

এই ভাবে গ্রামের মানুষদের ছুনুর নজরের ভয় দেখিয়ে সরকারি প্রকল্পের টাকা হাতাচ্ছিল গ্রাম প্রধান। একশো দিনের কাজের টাকা, পুকুর খননের টাকা— এমন সব সরকারি প্রকল্পের কাজ না করেই খাতায়কলমে কাজ দেখিয়ে দিব্যি চলছিল তাঁর। কিন্তু দিল্লি থেকে যখন সরকারি কাজের অবস্থা খতিয়ে দেখতে এক অফিসার গ্রামে আসেন, তখনই গ্রাম প্রধানের এই ফন্দি ধরা পড়ে যায়। ছুনুও একমাত্র মেয়ের জন্য এই সব ফন্দিফিকির ছেড়ে ভাল হওয়ার অঙ্গীকার করে। বেগতিক দেখে সেই অফিসারকে খুন করে ছুনুর নজরকে দায়ী করে গ্রাম প্রধান। ছুনুকেও পরিকল্পনা করে খুন করার ছক কষে সে। কিন্তু গ্রামের ক্ষমতা তো ছাড়া যাবে না। তাই নিজের আর এক শাগরেদের চোখে কালো চশমা পরিয়ে দ্বিতীয় ছুনু তৈরি করে ‘নজর’ দেওয়ার বুজরুকি প্রচার করে গ্রামবাসীদের পদদলিত করে রাখে গ্রাম প্রধান।

হুমায়ুন আহমেদের ছোট গল্প থেকে ‘ছুনু মিঁয়ার কিস্সা’ নাটকটি তৈরি হয়েছে। তার মূল গল্পই হল, কী ভাবে ছুনুদের মতো মানুষদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে আমআদমিকে বোকা বানিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয় নেতারা। এবং সেই ক্ষমতা কায়েম রাখতে প্রয়োজনে একাধিক ‘ছুনু’ তৈরি করে ফেলে তারা। চলতে থাকে জুলুমও।

হুমায়ুন আহমেদের এই গল্পকেই ভবেন্দু ভট্টাচার্য ও শুভম ভট্টাচার্য নাট্যরূপ দিয়েছেন। সম্প্রতি এই নাটকটি বালুরঘাটের নাট্যতীর্থে মঞ্চস্থও হয়েছে। বালুরঘাটের সমমনের প্রযোজনায় এই নাটকে ছুনু মিঁয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মনোজ গঙ্গোপাধ্যায়। গ্রাম প্রধানের চরিত্রে হারান মজুমদার, ছুনুর মেয়ে মরিয়মের চরিত্রে স্বাতীলেখা কুণ্ডু, অফিসারের চরিত্রে শুভদীপ পাল ও মিরাজের চরিত্রে প্রদীপ্ত দত্তের অভিনয় মনে রাখার মতো। মঞ্চ সাজিয়েছেন নীল কৌশিক, আলোয় সৌমেন চক্রবর্তী এবং আবহ সংগীতে শুভম ভট্টাচার্য।

ছুনু, তার কালো চশমা এবং সেই দুই ‘অস্ত্রকে’ ব্যবহার করার এই রাজনৈতিক রূপকটিই সব থেকে বেশি আকর্ষণ করেছে সমমনের সদস্যদের। বিশেষ করে সমকালীন রাজনীতি এর মধ্যে দিয়ে চমৎকার ফুটে উঠেছে, জানাচ্ছেন দর্শকরাও। সব থেকে বড় কথা, এই গল্পটি দেশকালের বেড়া ভেঙে দেখিয়েছে, তৃতীয় বিশ্বের দুর্নীতি আর রাজনীতি সব জায়গাতেই এক।

সমমনের সদস্যরা বলেন, ‘‘এই গল্প শোষক এবং শোষিতের। বর্তমান রাজনীতিতে একটি ধারা তৈরি হয়েছে তা হল, যে কোনও মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে হবে। সেখানে বিরোধী, বিরোধিতার কোনও সুযোগ থাকবে না। সাধারণ মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে হাতিয়ার করে তাদের শোষণ করার এই ধারা গণতন্ত্রের পক্ষে, সর্বোপরি সমাজের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক। এই বিষয়টিই নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।’’

একটা দৃশ্যে, ছুনুর একমাত্র মেয়ে মরিয়ম তার বাবাকে বোঝায়, ‘নজর’ দেওয়ার মিথ্যে ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে রোজগার করে তাকে খাওয়াতে হবে না। বরং কাজ করে নুন-ভাত খেয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচব। কিন্তু মেয়ের কথাতেও ছুনু বুঝতে চায় না, ছাড়তে চায় না ‘নজর’ দেওয়ার ক্ষমতাকে। তার পর মরিয়ম যখন বাবাকে বলে, গ্রাম প্রধান যদি তার শরীর নষ্ট করে দিয়ে গ্রামে রটিয়ে দেয়, ছুনুই নিজের মেয়ের সর্বনাশ করেছে নিজের ‘নজর’ দিয়ে, তখন সে পারবে তো সহ্য করতে? স্কুলে পড়া ছোট্ট মেয়েটার মুখে এমন কথা শুনে হতবাক ছুনু দুই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে মঞ্চের ঠিক মাঝখানে হামাগুড়ি দিয়ে পড়ে যায়। আর তখনই মঞ্চ অন্ধকার হয়। একটা আলোর রেখা শুধু ছুনুর মাথায়। পিছনে বাজছে আবহ সংগীত।

বাপ-মেয়ের এই কথোপকথনের সঙ্গে অভিনয়, আলো, আবহ সংগীতের মিশেলে সমাজের বাস্তব ছবি মঞ্চে ধরা পড়ে যায়। তখনই যেন নাটকটি আর শুধু নাটক থাকে না। হয়ে যায় সাধারণ গ্রামের মানুষগুলোর বারোমাস্যা, তাদের কষ্টের কাহিনি।

এক ঘণ্টা ৫০ মিনিট পরে নাটকের যবনিকা পতন হলে দর্শকদের কানে শুধু মরিয়মের শ্লেষাত্মক কথাই বাজতে থাকে.. ‘‘তোমার ক্ষ্যামতা সব মিথ্যে।’’

(লেখকের মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Humayun Ahmed Theatre Samaman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE