বৃদ্ধের একাকিত্ব যে একটি সামাজিক সমস্যা, তাহা অজানা নহে। এখন গবেষকরা বলিতেছেন, তাহা একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা। নানা মহাদেশে, বহু মানুষের উপর অনেকগুলি সমীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করিয়া বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, অস্বাস্থ্যের পরিচিত যে লক্ষণগুলি নিয়মিত মাপা হইয়া থাকে, যেগুলি মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করিতে পারে বলিয়া সুবিদিত, সেগুলির তুলনায় একাকিত্ব কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নহে, বরং কয়েকটির তুলনায় অধিক। এক কথায়, একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতা থাকিলে আয়ু কমিতে পারে। প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে ইতিমধ্যেই ‘একাকিত্বের মহামারী’ শুরু হইয়া গিয়াছে, উন্নয়নশীল দেশে তা ঘটিবার অপেক্ষায়। সকল দেশেই পুষ্টি ও চিকিৎসায় উন্নতির ফলে বার্ধক্য প্রলম্বিত হইতেছে। পরিবার ছোট হইতেছে, সামাজিক সংযোগের পরিচিত নকশা বদলাইতেছে, গ্রাম হইতে শহরে আসিবার ঝোঁক বাড়িতেছে। তাহার অবধারিত ফল নিঃসঙ্গতা। নিজের পুষ্টি, পরিচর্যা, চিকিৎসার ভার বহিতে বয়স্করা যত অক্ষম হইয়া পড়িবেন, ততই মৃত্যু ত্বরান্বিত হইবে, ইহা আশ্চর্য নহে।
‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে একাকী ইন্দির ঠাকরুন বাঁশবাগানে পড়িয়া মরিয়াছিল। আজও সেই দৃশ্যের পুনরাভিনয় হইতেছে, কখনও দরিদ্রের কুটিরে, কখনও ধনীর অভিজাত আবাসনে। কেবল রোগজনিত মৃত্যু নহে, বয়স্কদের একাকিত্ব তাঁহাদের দুর্বৃত্তদের সহজ শিকার করিয়া তোলে। কলিকাতা শহরেই নিয়মিত বৃদ্ধদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটিয়া চলিতেছে। কখনও পরিচারক, কখনও অপর কোনও পরিচিত বা অপরিচিত ব্যক্তি তাঁহাদের অসহায়তার সুযোগ লইয়াছে। কলকাতা পুলিশ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আপৎকালীন সহায়তার নানা প্রকল্প লইয়াছে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও বৃদ্ধদের সহায়তা করিয়া থাকে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এমন পরিষেবা অপ্রতুল, তাহার নিয়মিত জোগানও সহজ নহে। বিশেষত প্রয়োজন নির্দিষ্ট নহে, বহুমাত্রিক। পুষ্টি ও চিকিৎসার জোগানই যথেষ্ট নহে, বহু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সন্তানের নিকট নিগৃহীত হইয়া থাকেন। প্রধানত সম্পত্তি লইয়া বিবাদের জন্য নিজগৃহে পরবাসীর ন্যায় বাঁচিয়া থাকিতে হয় তাঁহাদের। বার্ধক্যের দোসর বিস্মৃতি যাঁহাদের গ্রাস করিয়াছে, তাঁহারা প্রায়ই সন্তানের দ্বারা পরিত্যক্ত হন।
আবার পরিজন-পরিবৃত হইয়াও বয়স্করা নিঃসঙ্গ হইয়া যান, যখন কোনও দীর্ঘমেয়াদি রোগের জন্য ক্রমাগত যন্ত্রণায় ভুগিতে থাকেন। ব্যথা শুধু দৈহিক কষ্টের কারণ নহে, অপরের সহিত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহা মানুষকে একা করিয়া দেয়। এই সংকটগুলির হাত থেকে মুক্তি পাইবার উপায় নাই। অতএব বার্ধক্যকে সহনীয় করিবার উপায় খুঁজিতে হইবে। এমন প্রতিষ্ঠান গড়িতে হইবে যাহা প্রবীণদের নিঃসঙ্গতা কমাইতে পারে। ভারতে আজও বৃদ্ধাবাসকে হীনদৃষ্টিতে দেখা হয়। কিন্তু সংসারে উপেক্ষিত হইবার তুলনায় সুপরিচালিত বৃদ্ধাবাসে নিঃসঙ্গতা কম, পরিচর্যা অধিক হইতে পারে। সমান মনোভাবের বন্ধুরা বার্ধক্যে একসঙ্গে থাকিবার ব্যবস্থাও করিতেছেন। রাষ্ট্রের তরফে পেনশন ও বার্ধক্য-সহায়তার নানা প্রকল্পকে সঞ্জীবিত করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা, দৈহিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতা। একটি সমাজ কত স্বাস্থ্যবান, তাহার পরিচয় চাহিলে বৃদ্ধদের দিকে তাকাইতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy