সোশ্যাল মিডিয়া শ্রেণিনির্বিশেষে মানুষের ঘরে ঢুকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা জিনিস আবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাঙালি আদতে তার রক্তে এবং সংস্কৃতিতে সেই চণ্ডীমণ্ডপের ঐতিহ্য বহন করে। সব কিছু হাট করে না দেখানো অবধি স্বস্তি পায় না। এর কল্যাণে অনেকেরই ব্যক্তিগত জীবন আঁচ করতে আমাদের আর অসুবিধা হয় না। প্রাইভেসি বস্তুটি হাটে-বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে কিছু কিছু মানুষ অবশ্য এখনও খোলা বাজারে বেডরুমের পর্দার রং দেখাতে উৎসাহী নন। তবে তাঁরা হাতে গোনা।
ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম— প্রধানত এই তিন ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে প্রবীণরা এখনও মোটের উপর ফেসবুকেই বেশি স্বচ্ছন্দ। কেউ সক্রিয়, কেউ নিষ্ক্রিয়— অন্যের পোস্ট বা স্টেটাস দেখেই তাঁদের দিন কাটে। আবার চোদ্দো থেকে পঁচিশের ছেলেমেয়েরা অনেক স্বচ্ছন্দ ইনস্টাগ্রামে। প্রধানত এদের নিয়েই কথা বলব এই লেখায়।
ইনস্টাগ্রাম হল প্রধানত ছবি বা ভিডিয়ো শেয়ার করার পরিসর। দুনিয়ায় ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন প্রায় আশি কোটি। এর মধ্যে মেয়েদের অনুপাত ৬০ শতাংশের বেশি। ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীর সংখ্যায় ভারতের স্থান দ্বিতীয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই। এ দেশে কিন্তু ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের তিন-চতুর্থাংশই পুরুষ। মনে রাখবেন, ইনস্টাগ্রামে অনেক সময়েই যুবকদের কাজ হল সুন্দরী তরুণীদের খোঁজা।
অতএব ছবিতে নিজেকে অতি আকর্ষক করার প্রতিযোগিতা চলে ইনস্টাগ্রামে। তার পর সেই সব ছবিতে লাইক পড়ে এবং ফলোয়ারও জুটে যায়। এবং এখানেই আসল খেলা। আজকের বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা অনেকেই সারা দিন হিসেব করছে, ইনস্টাগ্রামে কার কত অনুগামী। ধরা যাক ক-এর ফলোয়ার ৩০০। খ-এর ২০০। এ বার খ চেষ্টা চালাল ক-এর ফলোয়ারের সংখ্যাকে টপকে যেতে। স্বভাবতই তার নিজের ফলোয়ারের সংখ্যা বাড়াতে হয়। কী ভাবে? একমাত্র অন্যদের পাসওয়ার্ড হ্যাক করেই সম্ভব তাদের ফলোয়ারকে নিজের করে নেওয়া। পাসওয়ার্ড হ্যাক? এই নেক্সট জেন কিশোরকিশোরীদের কাছে পাসওয়ার্ড হ্যাক করা কোনও ব্যাপারই নয়। সুতরাং, ক-এর পাসওয়ার্ড হ্যাক করে খ ঘোষণা করল, ‘‘আমার অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে।’’ ক-এর অনুগামীরা ভাবল, এটি ক-ই বলছে। আসলে কিন্তু বলছে খ। যথারীতি ফলোয়াররা হ্যাকড অ্যাকাউন্ট ভেবে নিজেদের সরিয়ে নিল। এই ভাবে খ ক-এর ফলোয়ারদের সরিয়ে নিল। ভাববেন না, এটাই একমাত্র উপায়। তা নয়, ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য নানা প্রলোভনও দেখানো হয়।
ভাববেন না এ সব কোনও দাগি অপরাধীর কাজ। আপনার কিশোর কন্যা বা পুত্রকে আপনি ভালবেসে স্মার্টফোন কিনে দিয়েছেন, সে হয়তো পড়াশোনা, স্কুল যাওয়া, টিউশনের ফাঁকে ফাঁকে এই সব করে যাচ্ছে। আপনি বা আপনার বয়সি স্বজনবন্ধুরা টেরও পাচ্ছেন না। কারণ এই বয়েসি ছেলেমেয়েরা অনেকেই ইনস্টাগ্রামে ঢুকে প্রথমেই বন্ধুর তালিকা থেকে আত্মীয়স্বজন বয়োজ্যেষ্ঠদের ব্লক করে দেয়। কেন, তা ব্যাখ্যা করার নিশ্চয়ই প্রয়োজন নেই!
আর একটি ব্যাপার ইনস্টাগ্রামে হামেশাই চলে। তা হল, আমি আসলে যা, তার চেয়েও আকর্ষক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা। বয়স্ক মহিলাদের থেকেও তরুণীদের ইনস্টাগ্রামে আসক্তি বেশি, কারণ এই সাইটটিতে আছে নিজেকে সাজানোর কিছু ‘ফ্ল্যাটারিং টুলস’, যা খুব সহজেই তাদের মন জিতে নেয়। মানুষ সাধারণত অন্যদের কাছে নিজেকে যতটা সম্ভব সুন্দর করে তুলে ধরতে চায়। এবং সেই বাসনা পূরণের জন্য আছে প্রযুক্তির কারিকুরি। অনেক সময়েই প্রযুক্তির কল্যাণে ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে, বাস্তবের একটি মানুষের চেহারার সঙ্গে ইনস্টাগ্রামের সেই মানুষটির ছবির সাদৃশ্য সামান্যই।
অর্থাৎ, সোজা কথা হল, মিথ্যাচার দিয়েই কিশোরকিশোরীরা অনেকে এখন জীবনের পাঠ শুরু করছে। আর তাদের অন্তরঙ্গে চলছে তার দহন। বস্তুত, তাদের সমস্যাসঙ্কুল জীবনে এ আর এক নতুন সমস্যা। এমনিতেই লেখাপড়ার চাপ, বাবা-মায়ের চাপ— প্রতিযোগিতায় যেন পিছিয়ে না পড়ে। দ্বিতীয়ত, নিজের কাছে নিজের এই চাপ— সমাজে তাকে এই বয়সেই এক জন সুন্দরী বা কেউকেটা প্রতিপন্ন করতে হবে। এই সাঁড়াশি চাপে বহু কৈশোর মুখ থুবড়ে পড়ছে— শুধুই খেলেধুলে, ছুটে বেড়ানোর বয়সে তাদের গ্রাস করছে অগাধ বিষণ্ণতা। তখন মা-বাবারা আসল কারণটি সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকে নয় বকাবকি এবং মারধর করছেন, আর একটু স্পর্শকাতর বাবা-মা হলে ছেলেমেয়েকে নিয়ে মন-চিকিৎসকের কাছে ছুটছেন।
এমন একটি শূন্যগর্ভ সময়েই আমাদের সন্তানেরা বড় হচ্ছে। তরুণীরা ভাবছে সহপাঠীর কাছে নিজেকে কতটা আকর্ষক করে তোলা যায়। কিশোর ছেলেটিও সেই আকর্ষণেই বিভোর হয়ে থাকতে চাইছে। মাঝখান থেকে সহজ, শর্তহীন বন্ধুত্ব ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। এটাই কি কাম্য ছিল?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy