Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

বাইশে আইন

এরা টাকা থাকার লজ্জায় দুঃখের কথাটা পেড়ে উঠতে পারছিল না। ম্লান মূক মুখে ভাষা দেওয়া সোজা, কইয়ে-বলিয়েকে প্যারাগ্রাফ জুগিয়ে দেওয়াটা মাস্টারস্ট্রোক।আমার সম্পর্কে সবাই একটাই কথা বলছে: দু’মাস আগে কেউ ছেলেটার নামই শোনেনি, আর এখন সে মোদীকে কাঁদিয়ে ছাড়ছে! এর জন্যে পতাকা উড়ছে, শহর পুড়ছে! আরে ভাই, ঠিকঠাক মহাপুরুষরা এ ভাবেই ওঠে, ধূমকেতুর বাবার মতো!

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

আমার সম্পর্কে সবাই একটাই কথা বলছে: দু’মাস আগে কেউ ছেলেটার নামই শোনেনি, আর এখন সে মোদীকে কাঁদিয়ে ছাড়ছে! এর জন্যে পতাকা উড়ছে, শহর পুড়ছে! আরে ভাই, ঠিকঠাক মহাপুরুষরা এ ভাবেই ওঠে, ধূমকেতুর বাবার মতো! গুজরাত জুড়ে দু’মাসে প্রায় একশোটা সভা করেছি, অামদাবাদে মিটিং-এ লাখ লাখ লোক তুড়ি মেরে জোগাড় করেছি! এমন টিআরপি তুলতে গাঁধীজিকেও বেশ ক’বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অবশ্য বেচারার ফেসবুক ছিল না, হোয়াট্‌সঅ্যাপও না, হয়তো আমার মতো প্রতিভাও ছিল না! বাইশ বছর মাত্তর বয়স, এর মধ্যেই হয়ে গেলাম পটেলদের নেতা! তা ছাড়া গাঁধী বেচারা গাড়িফাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার থ্রিল একদম বুঝত না। আমি অন্য ভাবেও থ্রেট করছি, সবজি বন্ধ করে দেব, দুধ বন্ধ করে দেব! ভক্তরা আমাকে বল্লভভাই পটেলের সঙ্গে তুলনা করছে। দোষ কী? জুলাই মাসে একটা পার্টি তৈরি করেছি, আর অগস্ট শেষ হতে না হতে তার সঙ্গে আলোচনা করার জন্যে মুখ্যমন্ত্রী কমিটি তৈরি করছে, এমন কাণ্ড যে-সে ঘটাতে পারে? আসল কথা, যদ্দিন এই রিজার্ভেশন বস্তুটি থাকবে, তদ্দিন আমার মতো লোক ছুঁচ হয়ে ঢুকবে, যাতে সুপার-ফালের এফোঁড়-ওফোঁড় সাফল্য ভাগে উপচে পড়ে।

অবশ্য আমরা সংরক্ষণ চাইছি বলে লোকের চোখ কপালে! পটেলরা গুজরাতের অতি সমৃদ্ধ কমিউনিটি। তা হলে তারা সংরক্ষণ চাইবে কেন? আচ্ছা, প্রথমে একেবারে শেকড় ধরে টান মারা যাক। সংরক্ষণ ব্যাপারটার মানেই বা কী? কেন কিছু লোক সরকারের কাছ থেকে সুবিধে পাবে, আর কিছু লোক পিয়োর প্রতিযোগিতায় লড়ে মরবে? মানুষ যদি পিছিয়ে থাকে, তাকে সরকার কাঁধ দেবে কেন? মুরোদ নেই বলেই তো সে পিছিয়ে পড়েছে। যে ধর্ষিতা হয়, কেন হয়? দুর্বল বলে। তার যদি গায়ের জোর থাকে, সে কিলিয়ে ধর্ষককে কাঁটাল পাকিয়ে দিক না, কেউ তো বারণ করেনি। আমি আমার পরিশ্রমে আর বুদ্ধিতে পয়সা করব, তুমি গবেট আর কুঁড়ে বলে গরিব হবে, তা হলে আমি তোমাকে শোষণ করলে সেটাই তো জাস্টিস। তুমি হেরো পার্টি, মুখ নিচু করে ফোঁপানি সামলাও, হঠাৎ সরকারকে দোস্ত পাতিয়ে বাজিমাত করছ কেন? ঘাটতিটাকে ট্রাম্প কার্ড করে খেলছ কোন এথিক্‌সে?

কী? পৃথিবীটা প্রো-কবাডি ম্যাচ নয়? এ প্যাঁচ মেরে জিতল আর তালি পেল, অন্য গ্রুপ দুয়ো পেল, এই সরল ফর্মুলায় সভ্যতা চলে না? রাষ্ট্রের কর্তব্য হল সবাই যাতে সমান লেভেলে উঠে আসতে পারে তা দেখা, এগিয়ে থাকা-কে বলা, একটু সবুর করো, ওর জন্যে দাঁড়াও, আর খঞ্জকে বলা: ভাই আমার কাঁধে হাত দাও? বাব্বা, তাইলে শোনো। ওর সামাজিক কষ্টটা দেখলে, আর আমার ছেলেটা ৬০% পেয়ে বাদ পড়ল, ও ওবিসি বলে ৩৩% পেয়ে নাচতে নাচতে ক্লাসে ঢুকে গেল, তাতে আমার ছেলের ট্রমা-টা দেখলে না? ও যদি দেশের দীর্ঘ কালের পাপের ভিকটিম হয়, আমি তো সেই পাপশুদ্ধির চেষ্টার ভিকটিম! আমারটা শর্ট রানের দুঃখু বলে যথেষ্ট বেদ্‌না নয়! ওর চোদ্দো পুরুষ নিপীড়িত, তাই উঠে দাঁড়াতে পারেনি, আজ এসকালেটর দরকার, ভাল কথা। কিন্তু আমি এগিয়ে আছি বলে কী ক্রাইম করলাম, যে তুমি একটা সম্প্রদায়ের কুঁজটা পিঠ থেকে ডিলিট করে আমার সম্প্রদায়ের ঘাড়ে কন্ট্রোল ভি করে দিলে!

সমগ্রদৃষ্টির চেষ্টাটাই বিকৃত। গ্র্যান্ড বন্দোবস্তের নিরিখে ইতিহাসের গণিত কষে, শৈশবে নাগাড়ে উপোস করা সিড়িঙ্গে ক্যান্ডিডেটকে যৌবনে গলায় বাঁশ দিয়ে গিলিয়ে মোটা করা যায় না। তবে, আমার আসল পয়েন্ট আলাদা। আমিও পিছিয়ে পড়া। চট করে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু আমাদের পলেস্তারা খসছে। হ্যাঁ, হিরের ব্যবসা আমাদের প্রায় একচেটিয়া, কিন্তু গত ছ’মাসে প্রায় দশ হাজার হিরেকর্মী ছাঁটাই হয়েছে, দেড়শোটা ব্যবসা উঠে গেছে। আমাদের বহু রকম ব্যবসা আছে, কিন্তু সব ক’টাই প্রায় ছোট আর মাঝারি, আর কোনওটাই এই যুগের আধুনিকতায় চোবানো নয়। আমরা বুঝতে পারছি, নিজের ব্যবসায় মন দিতে গিয়ে, উঁচু শিক্ষাকে পাত্তা না দিয়ে কম বয়সেই ব্যবসায় ঢুকে যাওয়ার অভ্যেসে, আমরা টক করে বেমানান হয়ে যাচ্ছি, চলতি নাচের স্টেপ মিস করে ফেলছি। এমনিতে আমাদের লেগে থাকার ক্ষমতাকে সব্বাই স্যালুট করে। আমেরিকায় ‘মোটেল’কে ইয়ার্কি মেরে বলা হয় ‘পোটেল’, কারণ অনেক মোটেলই পটেলদের আন্ডারে। কিন্তু এখন আমরা চাই চাকরি আর কলেজে রিজার্ভড সিট, কারণ আমরা ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ারও হতে চাই, ঢুকে পড়তে চাই ইনক্রেডিব্‌ল ইন্ডিয়ার ইকড়িমিকড়িতে। তা নইলে, দামি গাড়ি চড়ে, হাঁইহাঁই ঢাল বেয়ে ডোডোপাখির খাঁচায় সেঁধিয়ে যাব।

সবাই জিজ্ঞেস করছে, এ সব দাবি তো কিস্যু নতুন নয়, তা হলে আমার উত্তাল পপুলারিটি কীসে? আসল কথা, এত বড় একটা সম্প্রদায় ফুকারি উঠতে চাইছিল, টাকা থাকার লজ্জায় দুঃখের কথাটা পেড়ে উঠতে পারছিল না। ম্লান মূক মুখে ভাষা দেওয়াটা সোজা, কইয়ে-বলিয়েকে যথাযথ প্যারাগ্রাফ জুগিয়ে দেওয়াটা হচ্ছে মাস্টারস্ট্রোক। কেউ অবশ্য বিশ্বাস যাচ্ছে না, সবাই বলছে, বস, তোমার পেছনে কে আছে, কংগ্রেস না বিজেপিরই একটা সেকশন? না ‘আপ’? হাহা, পেছনে কেউ নেই রে পাগলা, আছে আমার সামনে। আরও কত্ত পটেল আছে, টাকাওলা আছে, দুঃখে বুক ফেটে যাওয়া কোটিপতি আছে, শ্যাম্পেন খাচ্ছে আর কোন পথে ক্যাম্পেন করা যায় ভাবছে, আমি তাদের সব্বার মসিহা। ওরে, ভাল জামাকাপড় পরার কি কম জ্বালা? কোমরের দাদটা অবধি ভাল করে চুলকোনো যায় না, ডিগনিটি বাগিয়ে সইতে হয়। গরিবকে নিয়ে হইহই অনেক হল, এ বার অ-গরিবের ভগবান এসে গেছে, সাম্যের শামিয়ানা ফুটো করে দেবে!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE