Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আইন না মানলে দুর্ঘটনা ঘটবে

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুযায়ী, ভারতে পথ দুর্ঘটনায় গড়ে প্রতি বছর এক-দেড় লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, সড়ক-দুর্ঘটনাপ্রবণ রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান প্রথম দশে।

সাবির আহমেদ
শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:১০
Share: Save:

বসন্ত আসার আগে দুটো ফুল ঝরে পড়ল চিংড়িঘাটার মোড়ে; রাজপথে সে রক্তে মাখা রসগোল্লার দাগ শুকোবার আগে ‘মা’ ফ্লাইওভারে পথ দুর্ঘটনায় এক ছাত্রের মৃত্যু হল। সরকারি তথ্য হিসাবে বাইপাস ও বাইপাস সংযোগকারী ফ্লাইওভারে পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি আনতে তৈরি বিশ্ব বঙ্গ সরণিই শহরের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক। গতিসর্বস্ব উন্নয়নের নজির উন্নত সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি। আর এই উন্নয়নের ‘অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণাম’ ক্রমবর্ধমান পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু, নিদেন পঙ্গুত্ব।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুযায়ী, ভারতে পথ দুর্ঘটনায় গড়ে প্রতি বছর এক-দেড় লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, সড়ক-দুর্ঘটনাপ্রবণ রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান প্রথম দশে। গত বছর এ-রাজ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় সাত হাজার মানুষ মারা গিয়েছেন; ষোলো হাজার জনের স্থায়ী শারীরিক ক্ষতি হয়েছে। কলকাতা শহরেই গত তিন বছরে গড়ে চার হাজারেরও বেশি পথ দুর্ঘটনায় পাঁচশো থেকে সাতশো মানুষ নিহত হয়েছেন। মুর্শিদাবাদে সম্প্রতি একটা বড় পথ দুর্ঘটনা প্রায় চল্লিশ জন নিহত।

বিশ্ব নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে ২০১২ সালে প্রকাশিত রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্ব স্বাস্থ্য প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে, ভারতে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতি জিডিপির ৩ শতাংশের সমান। এটা অবশ্য আর্থিক ক্ষতির হিসাবমাত্র, দুর্ঘটনায় হতাহতের ক্ষতি অপূরণীয়, বিশেষ করে দরিদ্র দেশের গরিব মানুষের পক্ষে। এই মৃত্যু এবং ক্ষয়ক্ষতির মিছিল থামানো কি সত্যিই খুব কঠিন কাজ?

চিংড়িঘাটার দুর্ঘটনার পরে বাইপাস সংলগ্ন এলাকায় পথচারীদের নিরাপত্তার জন্য সরকার তড়িঘড়ি কিছু ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছে। এই জোড়াতালি ব্যবস্থা সরকার পরিচালনার একটা অঙ্গ বলেই, পথ দুর্ঘটনা প্রাত্যহিক বিষয়। দুর্ঘটনা স্থলের অদূরে নিকো পার্কের কাছেই দেখা যায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার পথচারী রাস্তা পার হচ্ছেন। পরবর্তী দুর্ঘটনা ঘটলে হয়তো এখানে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই সব বিচ্ছিন্ন দায়সারা ব্যবস্থায় কতটা কাজ হয়, আমরা বিলক্ষণ জানি।

কী কী কারণে এত বেশি দুর্ঘটনা ঘটে, কী কী পদক্ষেপ করলে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভব— এ-সব বহু-আলোচিত। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো ও ঝুঁকিপূর্ণ যান চালানোর কারণেই প্রায় আশি শতাংশ পথ দুর্ঘটনা ঘটে। চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৫৬ শতাংশ। গাড়ি চালানো সময় মোবাইল ফোনের ব্যবহার ও ড্রাইভারের অসতর্কতার কারণে এখন প্রায় বারো শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ নমুনা মুর্শিদাবাদের দৌলতাবাদের মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনা।

পরিসংখ্যান তলিয়ে দেখলে কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের শতকরা নব্বই ভাগই পুরুষ। সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের অর্ধেকই ১৫-৩৪ বছরের। তার একটা বড় অংশ স্কুলের ছাত্র। গাড়ি চালানোর সময় অল্পবয়স্কদের মধ্যে ঝুঁকি নেওয়ার ঝোঁক বেশি লক্ষ করা যায়। ইদানীং এর সঙ্গে যোগ হয়েছে যান চালানোর সময় মোবাইলে কথা বলার তীব্র প্রবণতা। এ-ছাড়া রাস্তার ঝুঁকিসংকুল জায়গায়, বিশেষ করে রেল লাইনে নিজস্বী তোলার হিড়িকে এ-রাজ্যেই শতাধিক যুবক প্রাণ হারিয়েছেন। দুর্বার গতিতে মোটর সাইকেল রেষারেষিতেও এ-শহরে বেশ কিছু যুবকের প্রাণ গেছে। হেলমেট ও সিট বেল্ট ব্যবহারে অনীহাও এর একটা বড় কারণ।

ট্রাফিক আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও আইনরক্ষকদের ঢিলেঢালা ভাব ও দুর্নীতির কারণে গাড়িচালকদের মধ্যে আইন ভাঙার প্রবণতা বাড়ছে। জাতীয় সড়কেও দেখা যায়, সব নিয়ম ভেঙে চালকরা উলটো দিকে গাড়ি চালাচ্ছেন।
সর্বভারতীয় তথ্য বলছে, ৩ শতাংশ পথ দুর্ঘটনা ঘটে ভুল দিকে গাড়ি চালানোর কারণে। চালকদের একটা বড় অংশ আবার মদ্যপান করে গাড়ি চালান। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি। গাড়িচালকদের জন্যও প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে।

পথচারীদেরও গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, বিশেষ করে ট্রাফিক আইন মেনে চলার ব্যাপারে আমাদের মানসিকতার আমূল বদল চাই। পথ নিরাপত্তা বাড়াতে ২০১৫ সালে প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকার ফলে দেশে নানা সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের রাজ্যে ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ প্রচার অভিযান চলে, রাস্তা আটকে ‘পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ’ পালিত হয়, পাঠ্যপুস্তকেও এ-নিয়ে আলোচনা আছে, কিন্তু ট্রাফিক আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে না। আমরা যা প্রচার করি তা পালন করি না। পাঠ্যপুস্তকে শিশু পড়ছে, “রেড রেড লাইট, রেড রেড লাইট। হোয়ট ডু ইউ সে। আই সে স্টপ। আই সে স্টপ রাইট আওয়ে।” অথচ স্কুল থেকেই বেরিয়েই লাল বাতি দেখেও বাবা-মা গাড়ির ফাঁক দিয়ে চোরপুলিশ খেলার ঢঙে রাস্তা পার হচ্ছেন। শিশু কী শিখছে বড়দের কাছে? এর মূল্য আমাদের গুনতে হচ্ছে, এবং হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Accident Traffic Rules
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE