প্রতীকী ছবি।
চোলাই মদ্য খাইয়া মৃত্যু হইলেই ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাইবে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কল্যাণে এ হেন একটি বিশ্বাস সম্ভবত জনমানসে প্রতিষ্ঠা পাইয়াছে। তাহাতে মদ্য ব্যবসায়ীদের বিলক্ষণ লাভ। ক্রেতারা বিনা ব্যয়ে বিমার সুবিধা পাইলে আরও নিঃসঙ্কোচে মদ্যপান করিবেন। কিন্তু, অনুমান করা চলে, মদ্যের চোরাকারবারিদের উপকার করা রাজ্য সরকারের মূল উদ্দেশ্য নহে। তাহারা মৃতের পরিবারের পার্শ্বে দাঁড়াইতে চাহে। দুর্জনে বলিবে, তাঁহাদের ভোট আছে বলিয়াই। প্রশ্ন হইল, মৃত্যু যতই দুর্ভাগ্যজনক হউক, মৃতের পরিবার যত বড় সঙ্কটেই পড়ুক, তাহাতে রাজ্য সরকারের দায় কোথায়? দায় না থাকিলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া কেন? অবশ্য, কেহ বলিতে পারেন যে রাজ্য সরকার অবৈধ চোলাই মদ্যের ব্যবসা ঠেকাইতে না পারিবার দায় স্বীকার করিয়া লইতেছে। জানাইতেছে, প্রশাসনের সেই ব্যর্থতার ফলেই এতগুলি মানুষের মৃত্যু। অতএব, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নৈতিক দায়িত্ব রাজ্য সরকারেরই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি এই যুক্তির সহিত সহমত প্রকাশ করেন, তবে তাঁহার ক্ষমতায় থাকা লইয়াই প্রশ্ন উঠিবে। আর, যদি ক্ষতিপূরণকে প্রশাসনিক ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি হিসাবে না দেখেন, তবে জবাব দিতে হইবে, এই ক্ষতিপূরণ কেন? ২০১১ সালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় বিষমদ্যে মৃত্যুর পর দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া লইয়াও একই প্রশ্ন উঠিয়াছিল। তাহার পর বেশ কয়েক বার এই গোত্রের মৃত্যু হইয়াছে, সরকার ক্ষতিপূরণ দেয় নাই। শান্তিপুরের ঘটনায় ফের টাকা দেওয়া হইল কেন? ভোট দরজায় কড়া নাড়িতে আসিয়াছে বলিয়াই কি?
প্রশাসনিক ব্যর্থতা অবশ্য বিপুল। গ্রামবাংলায় চোলাই এখন কুটির শিল্প হইয়া উঠিয়াছে। কে বানাইতেছে, কে তাহা এক জায়গা হইতে অন্য জায়গায় লইয়া যাইতেছে, কে বেচিতেছে— অভিজ্ঞ জনেরা বলেন, সবই প্রশাসনের জানা। তবু, ব্যবসা নির্বিঘ্নে চলে। মাঝেমধ্যে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হইলে সাময়িক হইচই হয়, কিছু ধরপাক়়ড়ও হয়। তাহার পর যথাপূর্বম্। দুর্জনে বলিবে, রাজনীতি ও প্রশাসনের মদত ভিন্ন এই ভাবে ব্যবসা চালাইয়া যাওয়া সম্ভব নহে। অভিযোগটিকে এক কথায় উড়াইয়া দেওয়া মুশকিল। এই রাজ্যে যত বেনিয়ম রাজনীতি ও প্রশাসনের যোগসাজশে চলে, চোলাই মদ্যের ব্যবসাও সেই তালিকাভুক্ত হইবে না কেন, তাহার তর্কাতীত কারণ নাই। যদি ধরিয়া লওয়া যায় যে প্রশাসন সত্যই এই মারাত্মক ব্যবসা ঠেকাইতে চাহে, তাহা হইয়া উঠে না কেন? চোলাই মদ্য তৈরি, পরিবহণ ও বিক্রয়, কোনওটিই খুব গোপনে করিবার উপায় নাই। এই রাজ্যে অবশ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষার ভড়ংটুকুও নাই। কেন গ্রেফতার করা যায় না বেআইনি মদ্য প্রস্তুতকারকদের? কেন তাহার জোগান ব্যবস্থা ভাঙিয়া দেওয়া যায় না? পুলিশ চাহিলেও তাহা পারে না, এমনটা ভাবা মুশকিল। অতএব, যোগসাজশের সন্দেহটিকে ছাড়িয়া দিলে পড়িয়া থাকে আর দুইটি সম্ভাবনা— এক, এই বেনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কথা পুলিশ ভাবে না; দুই, সস্তায় নেশার দ্রব্য জোগানের পথ বন্ধ করিয়া মানুষকে চটাইবার আগ্রহ প্রশাসনের, বা রাজনৈতিক নেতাদের, নাই। রাজ্যের পক্ষে প্রতিটি সম্ভাবনাই মারাত্মক। চোলাই মদ্যের মতোই। শান্তিপুরের মৃত্যুগুলিও প্রশাসনকে সক্রিয় করিতে পারিবে, তেমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। কে জানে, হয়তো এই মৃত্যুমিছিলেই চোলাই মদ্যের ব্যবসা বন্ধের পথ রহিয়াছে। মদ্যে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর ঘটনা যদি ঘটিতেই থাকে— বস্তুত, তাহার সংখ্যা যদি বাড়ে— তবে হয়তো মানুষের মনে প্রকৃত ভয় জন্মাইবে। মদ্য ও মৃত্যুর মধ্যে সরলরৈখিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হইলে মানুষ হয়তো এই বেআইনি মদ্যপান হইতে বিরত থাকিবে। যে রাজ্যে প্রশাসনের বারো মাসই শীতঘুম, সেখানে মৃত্যুর হাতেই মৃত্যু ঠেকাইবার ভার ন্যস্ত করিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy