এমনকি সুপ্রিম কোর্টও প্রশ্ন করেছেন, তা হলে কি হল-মালিকেরা নিজেরাই ‘ভবিষ্যতের ভূত’ ছবি দেখানো বন্ধ করেছিলেন? অলিখিত বা মৌখিক নির্দেশ জারি করা হয়েছিল কি না, সে-বিষয়ে রাজ্য প্রশাসন নিশ্চুপ। ভূত নিয়ে ছবি যখন, তখন ভুতুড়ে নির্দেশ আশ্চর্যের নয়। প্রশ্ন হল, যে রাজ্যে ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্তরা ছাড় পেয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়ায়, গণপিটুনিতে মানুষ বেমালুম মারা যায়, মদ্যপান কিংবা ডিজে বাজানোর প্রতিবাদ করলে ধরাধাম ছাড়তে হয়, সেখানে পুলিশের কি সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে চাওয়া ছাড়া আর কাজ ছিল না?
রাজ্য প্রশাসনের আরও কয়েকটি কাজের কথা সম্প্রতি জানতে পারা গেল। যেমন ধর্না মঞ্চে গিয়ে প্রশাসনিক আলোচনা করা। অনশনকারীদের হটিয়ে জায়গা খালি করানো এবং অবশ্যই রাজনৈতিক আইনশৃঙ্খলা ব্যাহত হতে না দেওয়া। মহামান্য আদালত আইনের শেষ কথা হয়েও এ হেন অভূতপূর্ব আইনের খোঁজ না পেয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, রাজনৈতিক আইনশৃঙ্খলাটি কী? ‘আইন’ শব্দটিকে পুলিশের ব্যবহৃত শব্দবন্ধটি থেকে সরিয়ে নিলে যা পড়ে থাকে সেটিই ক্রমশ আমাদের অলঙ্কার হয়ে উঠছে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
কিন্তু এই অলঙ্কারের ঠেলায় রাজ্যবাসীর মৌলিক অধিকারগুলি ভৌতিক ভাবেই ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। যে কোনও রকম রসবোধ বা কটাক্ষ হজম করা কিংবা সমালোচনা গ্রহণ করার শক্তি তো অনেক আগেই হারিয়ে ফেলা গিয়েছে। এখন এক নতুন আবেগ বাঙালির চেতনায় জাগ্রত হল, যে আবেগের উৎস বা তাৎপর্য আদালত খুঁজে না পেলেও তাকে রক্ষা করতে না পারলে প্রশাসনের ঘুম উড়ে যায়। চলচ্চিত্রের প্রদর্শন বন্ধ করে সেই আবেগকে টিকিয়ে রাখতে হয়।
এমন আবেগ বড় সর্বনেশে। ভোটের বাজারে এই আবেগের বশবর্তী হয়েই দেশপ্রেম এবং অসহিষ্ণুতা গুলিয়ে যায়, গুলিয়ে যায় উন্নতি, উন্নয়ন, বৈদেশিক নীতি এবং গণতান্ত্রিক পথ। আবার এই আবেগের জেরে শেক্সপিয়র আর রবীন্দ্রনাথ একই মঞ্চে নাটক করেন, নোটবন্দির সাফল্য আর চাষি-মজুরদের আত্মহত্যার খতিয়ান একই মাঠের জনসভায় গলাবাজি করে; মৃত জঙ্গির সংখ্যা নিয়ে ঐকমত্য হয় না, গোরক্ষকদের স্পর্ধিত ঔদ্ধত্য আর দেশপ্রেম হাত ধরাধরি করে নাচে আর বাক্স্বাধীনতার অধিকার ভূতের ভয়ে আদালতে আশ্রয় চায়।
গণতন্ত্রের মধ্যে বসে থাকা জনগণ অবশ্য এ সব অপছন্দ হলে ব্যালটে সব উল্টো করে দিতে জানে। কিন্তু উন্নয়ন যখন ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ের যাবতীয় সিলেবাস বদলে দেয়? তখন যে গণতন্ত্রে আবেগের জবরদখলে ভোটের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে, সেই গণতন্ত্রই নন্দনে নান্দনিকতার আন্তর্জাতিক ফ্লেক্স টানায়, আর সেই কথা মুখ ফুটে বলতে গিয়ে ভূতের নির্দেশক তাঁর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে ফেলেন। মৌলিক অধিকার যে রাজ্যে থাকে সে রাজ্যে উন্নয়ন থাকতে পারে না জেনেই বাঙালি ভোটের দিন মাংস-ভাত খায় আর দুপুরে ঘুমোয়। সন্ধেয় হিসেব নেয় ভোট লুটের, ইভিএম কারচুপির আর ভোট-শহিদের। নিজের ভোট নিজে দিতে গিয়ে যে বাঙালি ঝুঁকি নেয় না, সে যে ভবিষ্যতের ভূতের জন্য খুব বেশি মারমুখী হবে না (বুলেটে বা ব্যালটে), তা রাজনৈতিক আবেগের রক্ষাকারীমাত্রেই জানে। চলচ্চিত্র পরিচালকেরও বলিহারি! এত সব না জেনেই ভবিষ্যতের ভূত নিয়ে লেগে পড়লেন!
বিবাদী পক্ষের আইনজীবী সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ হওয়ার ক্ষতিপূরণের দাবি তুলেছেন। কিন্তু আইন যে ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়— পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে— সেগুলি রক্ষিত হয় না। আসলে আইনের উপর আইনরক্ষকদের অধিকার এতটাই একচেটিয়া যে রাজার সিংহাসন যা বলে তা-ই আইন। এক জনের সিদ্ধান্ত দশ জনের জনসভায় জানিয়ে দিলেই তা যখন আইনের সমতুল্য হয়ে দাঁড়ায় তখন এ কথা স্পষ্ট যে, দেশ ক্রমেই মানবাধিকারকে চূড়ান্ত ভাবে লঙ্ঘনের পথে এগোচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে কোন ভূতের দখলদারি আসবে তা জানা নেই। তবে মনে রাখা ভাল, উন্নয়নের জয়পতাকা পতপত করে উড়লেও মানবাধিকারের প্রশ্নটি যেখানে বাক্রুদ্ধ, সেখানে মনুষ্যত্বের চরম অবমাননা ছাড়া আর কিছু জনসাধারণের ভাগ্যে জোটে না।
‘ভবিষ্যতের ভূত’ চলচ্চিত্রের হিসেবে গুরুতর রকমের তাৎপর্যপূর্ণ যদি না-ও হয়, বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি শিল্পের প্রকাশভঙ্গির স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এই চলচ্চিত্রটিকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি গুরুতর কয়েকটি প্রশ্ন তুলে দিল। তবু বাঙালি নিশ্চুপ, কেননা প্রশাসন কথিত সেই আবেগের শৃঙ্খলে বাঙালি ক্রমেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ‘পদ্মাবত’-এর মুক্তির সময় যে রাজ্যটি নিরপেক্ষ ভাবে শিল্পের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উচ্চকণ্ঠ ছিল, সেই রাজ্যেই একটি চলচ্চিত্রের প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়ার ভুতুড়ে নির্দেশিকা জারি হওয়ার ঘটনাটি নিশ্চয়ই ভেবে দেখার মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy