Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
ঋণ মকুবের দাবির পাশে কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের কথাও হোক

কৃষকের ক্ষোভ আর ভোট

কংগ্রেস বিলক্ষণ ভাবছে। এই ভোটে কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি ছিল হিন্দি বলয়ের তিনটি রাজ্যে চাষিদের ঋণ মাফ করে দেওয়া হবে। বিজেপি কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি দেয়নি। ২০০৮-এ কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার ৬০ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ মকুব করেছিল। ২০০৯-এর ভোটে ইউপিএ ক্ষমতায় ফেরত আসে। ঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি হয়তো কংগ্রেসকে বাড়তি ভোট এনে দিয়েছিল।   

জয়ী: কৃষিঋণ মকুব করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথ। ভোপাল, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮। পিটিআই

জয়ী: কৃষিঋণ মকুব করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথ। ভোপাল, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮। পিটিআই

দেবর্ষি দাস
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

পনেরো বছরের লম্বা ইনিংসের পর মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান গদিচ্যুত। বিজেপি মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের থেকে লাখ দুয়েক ভোট বেশি পেল বটে, কিন্তু সরকার বানানোর মতো আসন পেল না। শিবরাজ চৌহান ওরফে ‘মামাজি’র কৃষকবান্ধব ভাবমূর্তি ছিল। ভোটের ফল বেরনোর পর মামাজি নাকি আরএসএস-এর দু’নম্বর নেতা ভাইয়াজি জোশীকে নালিশ করেছেন, কেন্দ্রের নীতি কৃষির বারোটা না বাজালে মধ্যপ্রদেশ আর এক বার জেতা যেত।— কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে ভোট রাজনীতির যোগ আছে বইকি। হিন্দি বলয়ের যে তিনটি রাজ্যে কংগ্রেস বিজেপিকে হারাল, তার সব ক’টা কৃষিপ্রধান, গ্রামীণ রাজ্য। গত বছর বিজেপির দুর্গ গুজরাত অল্পের জন্য বেঁচেছে। গ্রামে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ আসন বিজেপি পেয়েছে। শহরাঞ্চল পাশে না দাঁড়ালে গাঁধীনগরের গদি কংগ্রেসের দখলে যেত। গুজরাতে শহুরে জনসংখ্যা বেশি, তাই সে রাজ্যে বিজেপি কোনও মতে জিতেছে। ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল কিন্তু গ্রামীণ। ২০১৯-এ জিততে হলে দলগুলোর চাষিদের নিয়ে ভাবা উচিত।

কংগ্রেস বিলক্ষণ ভাবছে। এই ভোটে কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি ছিল হিন্দি বলয়ের তিনটি রাজ্যে চাষিদের ঋণ মাফ করে দেওয়া হবে। বিজেপি কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি দেয়নি। ২০০৮-এ কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার ৬০ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ মকুব করেছিল। ২০০৯-এর ভোটে ইউপিএ ক্ষমতায় ফেরত আসে। ঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি হয়তো কংগ্রেসকে বাড়তি ভোট এনে দিয়েছিল।

২০০৮ সালে ঋণ মকুবের পিছনের কারণ ছিল চাষিদের আর্থিক দুর্গতি। মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলে হাজারে হাজারে তুলো চাষি আত্মহত্যা করছিলেন। চাষি কেন আত্মহত্যা করেন? সন্ধানী গবেষকরা একটি কারণ বার বার খুঁজে পেয়েছেন: ধার শোধ করতে না পারার গ্লানি। চাষের খরচ বাড়ছে, চাষি মহাজন-ব্যাপারী-আত্মীয়-ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিচ্ছেন, পরে ফসল ভাল হচ্ছে না, বা ভাল দাম পাওয়া যাচ্ছে না, আয় নেই তাই উৎকণ্ঠা, পাওনাদারের তাগাদা, সামাজিক অপমান। শেষ পন্থা আত্মহত্যা। ঋণ মকুব করলে চাষির সুরাহা হয়, সন্দেহ নেই।

কৃষকের দুরবস্থার আর এক কারণ ফসলের কম দাম। মালওয়া অঞ্চল মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমে। শিবরাজ সিংহ চৌহান জমানার প্রথম দশ বছরে মালওয়া উন্নতির মুখ দেখেছিল। হুহু করে বেড়েছিল সয়াবিনের ফলন, দাম বেড়েছিল দশ বছরে প্রায় তিন গুণ। দেশ থেকে সয়াবিন রফতানি সে সময়ে বেড়েছিল দশ গুণ। গত চার বছরে দাম পড়েছে, রফতানিও কমেছে। মালওয়া-নিমাড় অঞ্চলে কংগ্রেস এ বার বিজেপিকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়েও চাষিদের রাগ বিজেপির হারের কারণ।

কেন্দ্রীয় বাজেটে অরুণ জেটলি ঘোষণা করেছিলেন, চাষিকে খরচের দেড় গুণ সহায়ক মূল্য দেওয়া হবে। চাষের কোন খরচকে প্রকৃত খরচ ধরা উচিত, সে প্রশ্নে বিবাদ রয়েছে। কিন্তু যে খরচই ধরা হোক, সরকারের ঘোষিত সহায়ক মূল্য চাষিরা পাচ্ছেন না। কারণ, বহু অঞ্চলে সরকার চাষিদের থেকে কেনে না, প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নেই। আবার মুষ্টিমেয় শস্য (প্রধানত ধান, গম) সরকার চাষির থেকে কেনে। শান্তা কুমার কমিটি রিপোর্ট বলছে, গোটা দেশে মাত্র ৬% চাষি সরকারকে শস্য বেচেন। ফলে চাষিকে শুধু সহায়ক মূল্য দিয়ে বেশি দূর এগোনো যাবে না। আবার শুধু সহায়ক মূল্যের নিরিখেও ২০১৪-র পরের অবস্থা হতাশাজনক। ধানের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ বছরে সহায়ক মূল্যের ‘প্রকৃত বৃদ্ধি’ ঋণাত্মক। অর্থাৎ অন্য জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে, সেটা হিসেবে রাখলে চাষি ফি বছর আগের বছরের থেকে কম দামে ধান সরকারের কাছে বেচেছেন।

এই অক্টোবরে দেখা গেল, যে চোদ্দোটি শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সরকার ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে বারোটির বাজারদর সহায়ক মূল্যের থেকে কম। সহায়ক মূল্য ঘোষণা করার উদ্দেশ্য খোলা বাজারে দাম পড়লে চাষি সেই মূল্যে সরকারকে ফসল বিক্রি করতে পারবেন, বাজারদরের অনিশ্চিত চড়াই-উতরাই গায়ে লাগবে না। বাজারদর যদি সহায়ক মূল্যের কম হয়, তার মানে চাষি কম দামে বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। সহায়ক মূল্য নীতি খুব কাজে লাগছে না।

নেই মামার থেকে কানা মামা ভাল। প্রভাব কম হলেও ঋণ মকুব বা সহায়ক মূল্য বাড়ানোর আশ্বাস কৃষককে টানে। দিল্লি ও মুম্বইয়ের রাজপথে কৃষক মিছিলের মুখে ঋণ মকুবের, সহায়ক মূল্য বাড়ানোর দাবি শোনা গিয়েছে। কিন্তু শহরের মধ্যবিত্তের কাছে নীতিগুলোর জনপ্রিয়তা নেই। বড় কোম্পানির পুঁজিপতিরাও আগ্রহী নন। চাষি সহায়ক মূল্য বাড়াতে বললে মধ্যবিত্ত সরকারের খরচ বেড়ে যাওয়ার দোহাই দেয়। ঋণ মকুবের কথা তুললে ‘মরাল হ্যাজ়ার্ড’-এর গল্প শোনায়। কর্পোরেট সংস্থার ঋণ মকুব, কর ছাড় নিয়ে অবশ্য মধ্যবিত্তের হেলদোল নেই।

কৃষককে স্বস্তি দিতে ঋণ মকুব, সহায়ক মূল্যের প্রয়োজন ঠিকই। কিন্তু শুধু এতেই কৃষির সঙ্কট মিটবে? সময়ের দিক থেকেই হোক বা ভৌগোলিক ব্যাপ্তির দিক থেকে, এই নীতিগুলির সুফল সীমিত। ঋণ মকুব বা সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি এক বার করলে চলে না, বার বার করতে হয়। সুফল সবার কাছে পৌঁছয় না। কৃষি সঙ্কট আসলে কাঠামোগত।

এক, চাষবাসকে অর্থব্যবস্থার বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। শিল্প বা পরিষেবায় পর্যাপ্ত পরিমাণে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বহু মানুষ কৃষিতে রয়ে গিয়েছেন, কারণ অন্যত্র কাজ নেই। অন্য ক্ষেত্রগুলোয় কর্মসংস্থান হলে কৃষির ওপর চাপ কমবে, চাষির সঞ্চয় বাড়বে, যা লগ্নি হবে ও উৎপাদন বাড়াবে। আবার কর্মসংস্থান হলে লোকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, যা কৃষিপণ্যের দাম বাড়াবে, কৃষি লাভজনক হবে। কর্মসংস্থানের প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সোজা নয়। তবে বোঝা দরকার, এটা জরুরি প্রশ্ন।

দুই, বাণিজ্য নীতি। গোদা অর্থনৈতিক তত্ত্ব বলে— মুক্ত বাণিজ্যে আখেরে সবার লাভ। সেই ‘আখের’ কবে আসবে, যাঁরা সস্তা আমদানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে জীবিকা হারাচ্ছেন, তাঁরা কী ভাবে কাজ পাবেন, তা নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই। কিন্তু ধামাচাপা দিলে প্রশ্নগুলো অদৃশ্য হয়ে যায় না, বরং হিংস্র বিকৃত রূপে বেরিয়ে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে মুক্ত বাণিজ্যের শিকার আম আদমির রাগ ভিনদেশিবিদ্বেষী, ভূমিপুত্র রাজনীতির পিঠে চড়ে বেরিয়ে আসছে। ভারতেও খোলা বাজারি নীতির ফলে কৃষিপণ্যের দাম বাড়তে পারছে না, তাই চাষির বিপুল লোকসান। কৃষককে ফসলের ন্যায্য দাম দিতে হবে, প্রয়োজনমাফিক বাণিজ্য নীতি তৈরি করতে হবে।

তিন, কৃষিক্ষেত্রে সরকারি লগ্নি। জওহরলাল নেহরু-প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ আমলের পনেরো বছরে (১৯৫১-৬৫) কৃষির উৎপাদন দ্রুত হারে বেড়েছিল। অর্থনীতিবিদ পুলাপ্রে বালকৃষ্ণণ দেখিয়েছেন, কৃষি উৎপাদন ওই রকম উঁচু হারে বিশ শতকের শেষার্ধে আর বাড়েনি। ব্রিটিশ আমলে কৃষির যত্ন নেওয়া হয়নি, তাই স্বাধীনতার পরে চড়া হারে বেড়েছে— এটা সেই চড়া বৃদ্ধির একটা কারণ, সম্ভবত একমাত্র কারণ নয়। সরকার ওই সময় কৃষিতে বড় মাত্রায় লগ্নিও করছিল। ফলে উৎপাদন দ্রুত বেড়েছে। আশির দশক থেকে নয়া-উদারতাবাদী নীতির ঠেলায় সরকার কৃষিতে লগ্নি কমিয়ে আনে। আজকের কৃষির দুরবস্থার জন্য সরকারি লগ্নির অভাব অনেকটা দায়ী। বাঁধ, সেচ, পরিকাঠামো, বিপণন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, চাষিদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ— অনেক খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পরিসর আছে। ভারতের কৃষি উৎপাদনশীলতা বিশ্বের নিরিখে বেশ কম। দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার।

ঋণ মকুব, সমর্থন মূল্যের দাবিতে লড়াই চলুক। দেশের অর্ধেক মানুষ চাষবাসে যুক্ত। তাঁদের কথা রাজনীতির উঠোনে জায়গা পেলে গণতন্ত্র মজবুত হয়। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের কথাও বলুক।

আইআইটি, গুয়াহাটিতে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE