Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আত্মবলির মিছিল, দেশ নির্লিপ্ত

বহুমূল্য ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের প্রদীপ ভাসিয়ে গঙ্গার ধারে সান্ধ্য-সার্কাসের অনতিদূরে, কনখল ‘মাতৃসদন’-এ ২০১১ থেকে লাগাতার অনশনে আত্মবলি দিচ্ছেন একের পর এক সন্ন্যাসী। এঁরা নিজেদের গঙ্গার সন্তান বলে জানাচ্ছেন, তাই অন্য সকল পরিচয় মুছে ফেলে শুধু নিজেদের ‘মা’-এর রক্ষার জন্য, সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দীর্ঘ অনশন বরণ করছেন।

জয়া মিত্র
শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

ভারতজোড়া এই হিন্দু নবজাগরণের যুগে ধর্মের সমস্ত সুরক্ষা এসে ঠেকেছে গরুর গায়ে। এই যে গঙ্গা নদী, যাকে বলা হয় ভারতবর্ষের শুধু ভূগোল নয়, সংস্কৃতিরও জীবনরেখা, তার শুদ্ধতা রক্ষার জন্য অনশনে প্রাণ দিয়ে দিচ্ছেন একের পর এক সন্ন্যাসী, হিন্দুধর্মের ধ্বজাধারীদের তাতেও কিছুই এসে যায় না।

বহুমূল্য ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের প্রদীপ ভাসিয়ে গঙ্গার ধারে সান্ধ্য-সার্কাসের অনতিদূরে, কনখল ‘মাতৃসদন’-এ ২০১১ থেকে লাগাতার অনশনে আত্মবলি দিচ্ছেন একের পর এক সন্ন্যাসী। এঁরা নিজেদের গঙ্গার সন্তান বলে জানাচ্ছেন, তাই অন্য সকল পরিচয় মুছে ফেলে শুধু নিজেদের ‘মা’-এর রক্ষার জন্য, সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দীর্ঘ অনশন বরণ করছেন। ২০১১ সালে অনশনে প্রাণ দেন ৩৭ বছর বয়সি স্বামী নিগমানন্দ। অধ্যাপক জি ডি আগরওয়াল, সন্ত গোপাল দাসজির মৃত্যুর পর বর্তমানে কেরল থেকে আসা মাত্র ২৬ বছর বয়সি স্বামী আত্মবোধানন্দ (ছবিতে) অনশন করে যাচ্ছেন গত ১৩৬ দিন ধরে। তাঁর জীবনরক্ষার জন্য উৎকণ্ঠিত মানুষদের কাছে তিনি বার বার বলছেন, ‘‘আমার জন্য নয়, চিন্তা করুন গঙ্গার জন্য।’’ বছরের পর বছর একটিই দাবি নিয়ে প্রাণ দিচ্ছেন এঁরা: গঙ্গার অবিরল ধারা বজায় রাখতে হবে, গঙ্গাজলের নির্মলতা রক্ষা করতে হবে। এ কথা নতুন নয়। আশির দশকে বিহারে ভাগলপুরের কাছে কাগজিটোলা, ওরিয়োপ, বটেশ্বর থান— এই সব ছোট ছোট জেলে-গ্রাম থেকে যে ‘গঙ্গামুক্তি আন্দোলন’ শুরু হয়েছিল, তার অন্যতম ধ্বনি ছিল এই দাবি: ‘‘গঙ্গা কো অবিরল বহনে দো, গঙ্গা কো গঙ্গা রহনে দো।’’

১৯৭৫ থেকে গঙ্গার ওপর ফরাক্কা ব্যারেজ কাজ করতে শুরু করে। অবিরল প্রবাহে ছেদ পড়ে। সেই বাধা সবচেয়ে বেশি বেজেছিল জেলেদের, যাঁরা মাছ ধরতে সহজেই পটনা ভাগলপুর থেকে সাগর পর্যন্ত আসতেন। ইলিশ, চিতল, মহাশোল— লোনা আর মিষ্টি জলের সঙ্গমস্থলের অ-সুমার মাছ যাঁদের নৌকার খোল ভরে দিত। কিন্তু ফরাক্কা ব্যারেজ দিয়ে শুরু হল গঙ্গা সুরধুনীর মুক্তধারাকে বেঁধে তাকে নিজেদের সুবিধে মতো নিয়োগ করার। গঙ্গামুক্তির সেই যোদ্ধাদের এক জন বলেছিলেন, ‘‘গঙ্গা সত্যিই আমাদের মা, আমাদের খাবারের থালা ধরে দেয়।’’

দেশের সর্বোচ্চ পরিচালকমণ্ডলী, যাঁরা দেশের স্বার্থরক্ষার শপথবাক্য উচ্চারণ করে দায়িত্ব নেন, তাঁদের বাক্যগুলি শেষ পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে হাতির দাঁতের মতো— খানে কা অলগ, দিখানে কা অলগ। সেই ‘দিখানে কা দাঁত’-এর গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান থেকে ‘নমামি গঙ্গে’র দাপটে দেশের লোক ক্লান্ত। এক সময়ের বিশাল জন-আন্দোলনের ধ্বনিকে আজ ‘অবিরল ধারা নির্মল ধারা’ স্লোগানে পরিণত করা হল, এটা আড়াল করে যে, নদীর নির্মলতার প্রথম শর্ত তার প্রবাহ অক্ষুণ্ণ, অবাধ রাখা। প্রাচীন লোকজ্ঞান: ‘বহতা পানি নির্মলা’। আপন অববাহিকা থেকে সব জঞ্জাল বৃষ্টিধারায় পুষ্ট নদী ভাসিয়ে নেয় বলে তার নাম পতিতপাবনী। কিন্তু তারও তো মাপ আছে। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পুর আবর্জনা শুদ্ধির ব্যবস্থা যদি কাজ না করে, সরকার কী পদক্ষেপ করেছে, আমরা জানতে চাইতে তো পারিই।

গঙ্গাদূষণের সব দায় তীরে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষদের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায় নাগরিক চেতনা সক্রিয় নয় বলে। দু’পাশের খেত থেকে বয়ে আসা বিপুল কীটনাশক, কারখানার বিকট রাসায়নিক বর্জ্য বহন করা ‘পতিতপাবনী’র ক্ষমতার মধ্যে পড়ে না। সেচের জন্য, বাড়তে থাকা নগরায়ণের জন্য, বোতলে জল ভরে বিক্রির ‘শিল্প উন্নয়ন’-এর জন্য প্রতি দিন সব ক’টি নদী, উপনদীর অববাহিকা থেকে কোটি কোটি লিটার ভূজল টেনে তোলা অবাধ হলে নদীর প্রবাহ শুকিয়ে যায়, এ কথা সাধারণ মানুষ জানেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানেন না?

আর, বাঁধ? বহু মানুষের মতোই শ্রীনিগমানন্দের দাবি ছিল গঙ্গার জন্মঘর থেকে হরিদ্বার পর্যন্ত, অর্থাৎ পার্বত্য ধারায় নদীকে যেন স্বাভাবিক মুক্তি দেওয়া হয়, বাঁধ না ওঠে। তার আগে টিহরি বাঁধের বিরুদ্ধে জন-আন্দোলনের কথা, আন্তর্জাতিক জনমত বা বিশেষজ্ঞদের আপত্তির কথাও স্মরণীয়। আজ নদীর সেই পার্বত্য প্রবাহ বলতে কোনও স্বচ্ছ ধারা আর অবশিষ্ট নেই বললেও হয়। লোকচক্ষুর আড়ালে দুর্গম উচ্চতায় দেশের ছয় ইঞ্চি জমি রক্ষার জন্য যাঁরা অকল্পনীয় ব্যয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাঁরাই অক্লেশে দেশের পবিত্রতম নদীটির পার্বত্যধারার ওপর এমনকি চার কিলোমিটার দূরে দূরেও বাঁধ নির্মাণের বরাত দেন বহুজাতিক কোম্পানিদের। কাকে বলে দেশের স্বার্থ? কাকেই বা বলে সার্বভৌমিকতা? কোন ভূমির অধিকার, যেখানে সহস্রাধিক বছর ধরে বাস করে আসা মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে অস্তিত্ব হারাচ্ছে লক্ষ লক্ষ হেক্টর অরণ্য? সরকার যদি নিজে সৎ হত নিজের ঘোষিত নীতির বিষয়ে, তা হলে কেন এই দাবি নিয়ে প্রাণ দিতে হত গঙ্গাপ্রেমী সন্ন্যাসীদের যে, ‘‘গঙ্গাকে বাঁধমুক্ত অবিরল ধারা রাখতে হবে। এই নদীর দুই তীরে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বালিখাদ বা অন্য খননকার্য বন্ধ করতে হবে?’’

জঙ্গল কাটার, খোলামুখ খনি করার বিরুদ্ধে যাঁরা সবলে বাধা দিচ্ছিলেন, সরকার তাঁদের প্রায়ই ‘মাওবাদী, সুতরাং দেশের প্রধান বিপদ’ বলে চিহ্নিত করেছিল। মাতৃসদনে অনশনরত মানুষরা বেছে নিয়েছেন সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ পথ। সরকারের মানবিকতার কাছে এঁদের আমৃত্যু-যন্ত্রণার আবেদন। এ ক্ষেত্রে কী উত্তর তাঁরা পাচ্ছেন? সরকারি তরফ থেকে কেউ কোনও বার্তা নিয়ে এঁদের সঙ্গে দেখা করছেন না পর্যন্ত। বিরোধী পক্ষও নয়! যে কোনও সমাজের জীবনজীবিকা নির্ভর করে সে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ধরনের ওপর। এই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হওয়ায় শাসন-পরিচালনের গদি দখলে উৎসুক পক্ষদের কারও কিছু যায় আসে না— এই কি তা হলে মেনে নেওয়া হল?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Self Sacrifice Cleanliness Ganges
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE