E-Paper

নামভূমিকায়: এপ্রিল ২০২৩

রাজনীতির হাওয়া পড়তে জানেন। দলবদলে সিদ্ধহস্ত। পুলওয়ামা নিয়ে তাঁর মুখ খোলার মধ্যে কি কোনও রাজনৈতিক পালাবদলের ইঙ্গিত দিচ্ছেন সত্যপাল মালিক

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৩২
An image of Satya Pal Malik

সত্যপাল মালিক। ফাইল চিত্র।

বফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে তখন সারা দেশ উত্তাল। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছেন। কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করলেন সত্যপাল মালিক। যোগ দিলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের সঙ্গে। দু’বছর বিশ্বনাথ প্রতাপের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে সরব হলেন। ১৯৮৯-এর ভোটে জনতা দল তাঁকে আলিগড় থেকে প্রার্থী করল। লোকসভায় জিতে এলেন সত্যপাল। কেন্দ্রীয় সরকারের সংসদীয় ও পর্যটন বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীও হলেন। সরকার যদিও বেশি দিন টিকল না। সত্যপালের মন্ত্রিত্বের মেয়াদও ক্ষণস্থায়ী হল।

শুধু রাজীব গান্ধী আর বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ নন। সত্যপাল মালিক দেশের আরও দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চৌধরী চরণ সিংহ এবং অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করেছেন। কিন্তু কোনও সম্পর্কই বেশি দিন টেকেনি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে দু’একটি নয়, চারটি রাজ্যের রাজ্যপাল হিসাবে কাজ করেছেন। এখন পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা ও দুর্নীতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। একদা বিজেপির জাতীয় সহ-সভাপতি সত্যপাল ইঙ্গিত দিচ্ছেন, তিনি আগামী লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের হয়ে প্রচার করতে পারেন।

এ দেশের রাজনীতিতে এমন অনেক চরিত্র রয়েছে, সময়ের সঙ্গে যাঁদের দল বদলায়। অবস্থান বদলায়। কিন্তু রাজনীতি থামে না। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বাগপত থেকে উঠে আসা জাঠ নেতা সত্যপাল মালিক এই গোষ্ঠীর রাজনীতিকদের মধ্যে পড়েন।

মাত্র দু’বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন। সরকারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সত্যপালের রাজনীতির শুরু মিরাট কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচনে। তার পর নাম লেখান চৌধরী চরণ সিংহের ভারতীয় ক্রান্তি দলে। বাগপতের বিধায়কও হয়েছিলেন। তার পরে রাজ্যসভার সাংসদও। এর পরে রাজীব গান্ধীর উত্থান হল। তিনি কংগ্রেসে নাম লেখালেন। রাজীবও তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠালেন। কিন্তু বফর্স কামান কংগ্রেসের সঙ্গে সত্যপালের সম্পর্কে ইতি টেনে দিল। জনতা দল ঘুরে সত্যপাল গিয়েছিলেন মুলায়ম সিংহ যাদবের সমাজবাদী পার্টিতে। মুলায়ম তাঁকে দলের জাতীয় মহাসচিবের পদে বসিয়েছিলেন। তবে সত্যপালের দলবদলের অভ্যাস বদলাতে পারেননি। ২০০৪-এ বাজপেয়ী সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসতেই সত্যপাল বিজেপিতে নাম লেখালেন।

২০১৪ সাল। নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় এল। ক্ষমতায় এসেই প্রধানমন্ত্রী মোদী ইউপিএ সরকারের শেষবেলায় তৈরি জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন আইনে সংশোধনে উদ্যোগী হয়েছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম অধ্যায়ের পরে তৈরি ওই আইনে বলা ছিল, ৮০ শতাংশ জমির মালিক সায় না দিলে সেই জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। মোদী সরকার তাতে সংশোধনের চেষ্টা করায় প্রতিবাদ শুরু হল। রাহুল গান্ধী মোদী সরকারকে ‘স্যুট-বুট সরকার’ বলে তকমা দিলেন।

সত্যপাল মালিক তখন বিজেপির জাতীয় সহ-সভাপতি। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ নেতা। তাঁর সঙ্গে হরিয়ানা, পঞ্জাবের কৃষক সংগঠনগুলিরও মধুর সম্পর্ক। সত্যপালের নেতৃত্বে বিজেপির একটি অভ্যন্তরীণ কমিটি তৈরি হল। মোদী-শাহ তাঁকে দায়িত্ব দিলেন, আইনে রদবদল করতে গেলে চাষিরা চটে যাবেন কি না, তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সত্যপাল পরামর্শ দিয়েছিলেন, আইনে জমি অধিগ্রহণের শর্ত শিথিল না করাই ভাল। তাতে কৃষকদের মনে সংশয় তৈরি হবে। সত্যপালের কথা ফেলতে পারেননি মোদী-শাহ। সেই বিল হিমঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পরে মোদী সরকারের তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধেও কৃষক আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি সরব হয়েছিলেন। মোদী তখন কান দেননি। কিন্তু তাঁকে ওই তিন আইনও প্রত্যাহার করতে হয়েছিল।

এই ‘রাজনৈতিক বোধ’-এর মূল্য দিয়েই সত্যপাল মালিককে প্রথমে বিহার, তার পর জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল নিয়োগ করেছিলেন মোদী-শাহ। কাশ্মীরে জঙ্গি-আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে বরাবরই কোনও অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার বা আমলাকে রাজ্যপাল নিয়োগ করা হয়েছে। কোনও নিখাদ রাজনীতিককে নিয়োগ করা হয়নি। সত্যপালই প্রথম। মেহবুবা মুফতির সরকারের পতনের পরে সত্যপালই কার্যত জম্মু-কাশ্মীর চালিয়েছিলেন। তাঁকে রাজ্যপালের পদে রেখেই ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করা, জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য ভেঙে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরির মতো স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মোদী সরকার।

সেটাই বোধ হয় বিজেপির ‘কাল’ হল। পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় কেন্দ্রীয় সরকারের গাফিলতি ছিল বলে এখন তিনি অভিযোগ তুলেছেন। সেই জঙ্গি হামলাকে গত লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানো হয়েছিল বলেও ইঙ্গিত করেছেন। আরএসএস নেতার বিরুদ্ধে শিল্পসংস্থাকে জম্মু-কাশ্মীরে সরকারি প্রকল্পের মেয়াদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য উমেদারি করার অভিযোগ তুলেছেন। গোয়ায় রাজ্যপাল থাকার সময় সেখানকার দুর্নীতি নিয়ে মোদীকে বলেও ফল মেলেনি বলে নালিশ করেছেন।

দেশের রাজনীতিতে সত্যপাল মালিকের মতো ব্যক্তিরা ‘হাওয়া মোরগ’ নামে পরিচিত— যাঁরা আগেভাগেই রাজনীতিতে হাওয়ার দিকবদল টের পান। সত্যপাল কি ফের সেই হাওয়া বদলের টের পাচ্ছেন!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Satyapal Malik Congress Rajiv Gandhi Central Government

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy